রানা মেহের

২০ নভেম্বর, ২০১৬ ২৩:২০

আসছে ফালগুনে আমরা দ্বিগুণ হবো

মঞ্চে কথা বলছিলেন একজন, সাদা শাড়ি পরা নাজমা আপা। কী স্পষ্ট উচ্চারণ! কী সুরেলা করে বলা, যেন রূপকথার গল্প বলছেন!

উনার বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, মা অগ্রণী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। খালেদ মোশাররফ যখন যুদ্ধে, তাঁর ছেলে-মেয়েরা রয়ে গেছে ঢাকায়। নাজমা আপার বাবা গেছেন সেই ছেলে-মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে আসতে। পাকিস্তানিরা শর্ত দিল, নিতে পারো বাচ্চাদের। কিন্তু নিজেদের কাছে যদি রাখতে না পারো কখনো, তোমাদের সব সহায়-সম্পত্তি দিয়ে দিতে হবে আমাদের। বাবা বললেন, ওরা চাইলে আমাদের সবকিছু নিতে পারে এমনিতেই। তার থেকে এই শর্তে মুক্তিযোদ্ধার দুটো ছেলে-মেয়ে যদি বাঁচে, বাঁচুক না।

অপরিচিত দম্পতির অপরিচিত দুটো বাচ্চা এলো বাসায়। নাজমা আপার নিজেরই তখন একটা শিশু হয়েছে। সবাই থাকে একসাথে। এর মধ্যে একদিন এক ফুপু আর আপার সেই ছোট্ট বাচ্চা বাসায়। কিছু তরুন ছেলে এসে খালেদ মোশাররফের বাচ্চাদের নিয়ে যেতে চাইলো। ফুপু বাঁধা দেয়ায় গুলি লাগলো ফুপুর পায়ে, আপার বাচ্চা একটুর জন্য বেঁচে গেল গুলির হাত থেকে। খালেদ মোশাররফের ছেলেকে নিয়ে গেল ওরা, মেয়ে রয়ে গেল তাদের কাছে। যুদ্ধের পর মোশাররফ দম্পতি যখন নিতে আসলেন তাকে, সে যাবে না। নাজমা আপার আম্মাকে সেও আম্মা ডাকে।

অনুষ্ঠানের পর আপাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপা, এই যে অপরিচিত দুটো বাচ্চার জন্য আপনার ফুপু আহত হলেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে, মারা যেতে পারতো আপনার নিজের ছোট্ট শিশু, মনে হলে কষ্ট হয় না আপনার? রাগ হয় না? উনি বললেন, মুক্তিযোদ্ধারা তো জানতো না আমরা কেমন মানুষ, তারা শুধু এসেছিল তাদের কমান্ডারের বাচ্চাকে নিয়ে যেতে। মাগো, যুদ্ধের সময় কেউ অচেনা ছিল না মা। আমরা সবাই যেন সবাইকে চিনতাম। ১৬ই ডিসেম্বরের ক'দিন আগে আমি আব্বাকে বললাম- আব্বা, আমার এক পাকিস্তানী বান্ধবী তার দেশে ফিরতে পারেনি, তার অনেক বিপদ। আব্বা তাকে গিয়ে নিয়ে আসলেন। আম্মা পরে নিজে তার বাংলাদেশি পাসপোর্ট করিয়ে পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনে আমাদের কাছে। কত মানুষকে আশ্রয় দিয়েছেন আব্বা-আম্মা। কত মানুষ সাহায্য করেছে আমাদের। যুদ্ধে আমাদের অনেক গল্প মা, অনেক গল্প।

আমি, পৃথা আপু আর বিটন ভাই বসেছিলাম একদম শেষের সারিতে। আমাদের পাশে বসেছিলেন চুলে ঝুঁটি করা এক ভদ্রলোক। কারো পানি লাগলে পানি দিচ্ছেন, পেছনে গিয়ে বলে আসছেন আস্তে কথা বলতে। একটু পরে শুনি মঞ্চে ডাকা হচ্ছে উনাকে, কিন্তু যেতে চাচ্ছেন না। উনি ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা ইশতিয়াক হোসেন হিডি বীরপ্রতীক। যুদ্ধ শেষে চার নেতা যখন ঢুকলেন দেশে, হিডি ভাই ছিলেন তাদের স্বাগত জানানোর দায়িত্বে। যুদ্ধে এমনকি যোগ দেয়ার আগেই নিজের শহরে ব্যাংক গার্ডের কাছে থাকা বন্দুক নিয়ে হত্যা করেছিলেন এক পাকিস্তানি সৈন্যকে।

আর ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের আরেক মুক্তিযোদ্ধা হারিস ভাই, মূলত তার সাথে দেখা করতেই গিয়েছিলাম আমরা। শিশুর মতো একটা মানুষ। পাকিস্তানি বাহিনীর ত্রাস এই লোক নিজের কথা কিছুই বলতে চান না। শুধু বলেন সহযোদ্ধাদের কথা। মেজর হায়দার, কর্ণেল হুদা, আরো কতজন। একবার তাঁকে আটকালো পাকিস্তানি বাহিনীর একটা দল। গাড়িতে বসা তাঁর পরিবারের সদস্যরা মারা যাচ্ছেন উৎকণ্ঠায়। দুটো মাত্র সুরা মুখস্থ ছিল তাঁর, বেঁচে গেলেন সেইবার। তখনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, Nobody will force me to what language I speak or what religion I follow.

তিনি পাবলিক ফোরামে কথা বলা পছন্দ করেন না, টিভির অনুষ্ঠানে আসতে চাননা। আমরা বারবার জোর করায় বললেন, শোনো, আমরা যখন গ্রামের মাঝ দিয়ে যেতাম, গ্রামের লোকেরা পানি খাওয়াতো আমাদের, খেতে দিতো। তারপর আমরা তো চলে যেতাম। ঝোঁকের মাথায় সাহায্য করে বিপদে পড়তো গ্রামের সেই লোকগুলো। আমাদের সাহায্য করার অপরাধে গ্রামকে গ্রাম মানুষদের মেরে ফেলতো পাকিস্তানিরা। যোদ্ধাতো তারাই। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তখন মুক্তিযোদ্ধা। আমি কেন প্রিভিলেজ পাবো একা? একা কেন কথা বলবো?

আমাদের চোখে তখন টলমল করছে জল। এই মানুষগুলোকে ছুঁয়ে দেখতে পারার আনন্দ। ৭১ এর সেই দিনগুলোকে নিজের চোখে দেখতে পারার রোমাঞ্চ। ঘোর কাটে না। গত ক'দিনে কিংবা ক'মাসে যেই আশা হারিয়ে যাচ্ছিলো একটু একটু করে, এই মানুষগুলো কত অবলীলায় চারপাশ উজ্জ্বল করে দিয়ে যান। আমাদের আর কিছু না থাকুক, একটা ১৯৭১ আছে। এই সাম্প্রদায়িকতা, এই মৌলবাদীতা ঘেরা সময় থাকবে না চিরদিন। আমাদের আর কিচ্ছু দরকার নেই। শুধু সেই সময়ের শক্তিটা দরকার। আমাদের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিযোদ্ধা। আসছে ফালগুনে আমরা দ্বিগুণ হবো।

 

  • রানা মেহের : ব্লগার, এক্টিভিস্ট।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত