অংকুর ভৌমিক

০২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ২২:৪৩

বিদেশী সিরিয়াল বন্ধের দাবি, কিন্তু দেশীয় নির্মাতারা কী বানাচ্ছেন?

একসময় বিটিভিতে সিন্দাবাদ, টিপু সুলতান, ম্যাকগাইভার, রবিনহুড, আলিফ লায়লা, এক্সফাইলস ইত্যাদি সিরিয়াল দেখানো হত যা অবশ্যই বিদেশী সিরিয়ালের খাতায় পড়বে। কোনদিন এইসব সিরিয়াল বন্ধের দাবি উঠতে শুনিনি যে এতে করে বিটিভির নিজস্ব অনুষ্ঠানের দর্শক কমে যাচ্ছে। কিন্তু এখন বাংলাদেশের শিল্পী, নির্মাতারা পথে নেমেছে বিদেশী সিরিয়াল বন্ধের দাবিতে।

ফেডারেশন অব টেলিভিশনস প্রফেশলানস অর্গানাইজেশনসের (এফটিপিও) ব্যানারে বুধবার সকালে তারা ‘‘শিল্পে বাঁচি, শিল্প বাঁচাই’ এই শ্লোগান নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশে মিলিত হন। আপনাদের বিদেশী চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধের দাবি মেনে নিলাম যেহেতু এটা শুধু আমাদের দেশের মানুষদের উদ্দেশ্য করে দেখানো হয়, আন্তর্জাতিক ভাবে না। কিন্তু এই যে সিরিয়াল আমদানি করে টিভিতে দেখানো এটা কেন নিষেধ হবে।

ধরে নিলাম কাল থেকে ‘সুলতান সুলেমান’ দেখানো বন্ধ হলো, এর বিপরীতে আপনারা কী দেখাবেন? আপনাদের হাতে কি দেখানোর মত রিসোর্স আছে? যদি না থাকে তাহলে আপনাদের এই দাবি কতটুক যৌক্তিক? এই দুয়েকটি সিরিয়াল আপনাদের পুরো ব্যবসার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালো?

আপনারা প্রতিযোগিতা করেন পারলে তাদের সাথে। বানান ভালো নাটক, সিনেমা। মানুষ তখন দেখবে না কেন। মানুষ কি ‘আজ রবিবার’ নাটক দেখেনি, একুশে টিভির 'বন্ধন', ছোট ছোট ঢেউ নামে একটি জনপ্রিয় নাটক ছিল এগুলা কি মানুষ দেখেনি? আগুনের পরশমণি, জয়যাত্রা, মোল্লা বাড়ির বউ, শ্রাবণ মেঘের দিন, মেঘের পর মেঘ, হাঙর নদী গ্রেনেড, জীবন থেকে নেয়া থেকে হালের আয়নাবাজি, টেলিভিশন...এইসব সিনেমা কি মানুষ উৎফুল্ল হয়ে হলে গিয়ে দলবেঁধে দেখেনি? দেখেছে...ভালো কাজ মানুষ দেখেছে এবং অভিবাদন ও জানিয়েছে।

বিগত ১০ বছরে ভালো ধারাবাহিক নাটক ধরলে ৪২০, ৫১বর্তী, হাউজফুল এই কয়টি নাটক ছাড়া ভালো কাজ কি হয়েছে। প্রতিটি চ্যানেলে আপনারা দেখাবেন টক শো আর বিভিন্ন শিল্পী দিয়ে রাত ১২ টার পরে লাইভ গান আর ঘণ্টায় ঘণ্টায় একই খবর চৌদ্দবার করে পড়া এইগুলো দিয়ে কয়দিন চালাবেন আর।

প্রতিযোগিতার বাজার থেকে আপনারা পালাতে চাইলেও পালাতে পারবেন না। আপনারা এইসব বন্ধ করলে মানুষ এগুলা নেটে ডাউনলোড করে দেখবে। ইয়াং জেনারেশনের কয়জন বাংলাদেশের চ্যানেল দেখে আর কয়জন পিসিতে গেম অফ থ্রোনস, ফ্রেন্ডস, প্রিজন ব্রেক, হাউজ অফ কার্ডস দেখে এইটার একটি জরিপ করেন। দেখবেন আপনারা আছেন তালিকার তলানিতে। ভারতীয় সিরিয়াল মানুষ কেন দেখে, এগুলা অপসংস্কৃতি সব মেনে নিলাম আপনাদের কথা। আপনারা দেশের দর্শকদের জন্য কি বানিয়েছেন। আমাদের প্রত্যেকের বাসায় ৫০ ঊর্ধ্ব বা বৃদ্ধ বয়সের মানুষেরা আছেন। আমরা চাইলেই আমাদের বিনোদনের জন্য বিকল্প একটি মাধ্যম বেছে নিতে পারি, কিন্তু তারা একা একটি বাসায় কী করেন সারাদিন তা কি আপনাদের ভাবনায় এনেছেন কখনো। তাদের তো আছে ওই এক টিভির বাক্স। এটা দেখে তারা তাদের সময় পার করেন। অধিকাংশ ঘরেই গেলে দেখবেন এই বৃদ্ধ মানুষেরা বা গৃহিণীরা এইসব ভারতীয় সিরিয়াল দেখছে কারণ তাদের কাছে সময় কাটানোর আর কিছু নেই।

আপনারা তৈরি করুন বৃদ্ধদের জন্য ভালো একটি দেশী সিরিয়াল, কাজে লাগান আপনাদের অতি মূল্যের মেধা, তাদের জন্য বানান কিছু। তা করবেন না খালি দোষ দিবেন ভারতীয় সিরিয়ালের।

একটি কথা এখানে বলতেই হয় যে, অবশ্যই ভারতীয় সিরিয়ালের দর্শক টেনে রাখার একটি ক্ষমতা আছে যা আমাদের এখনো নেই বা তৈরি হয়নি। নাহলে বছরের পর বছর ধরে কিভাবে এইসব সিরিয়াল তারা চালিয়ে যাচ্ছে।

যে প্রজন্মের আইডল হয়ে যায় তথাকথিত মডেল নামক কিছু মানুষজন, যারা পেয়ে যায় অল্পতেই তারকা খেতাব তাদের দ্বারা আপনাদের মানসম্মত কাজ দেয়ার ঘোষণাটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। এদের নিয়ে আপনারা কি মানের কাজ দিবেন তা ঈদের কয়েকটা প্রোগ্রাম দেখলেই বুঝা যায়। গাজী টিভিতে একটা নাটক প্রচারিত হয় 'সুপার গার্লস' নামে। এইখানে মডেল নামক নারী অভিনয়শিল্পীরা কি ডায়লগ দেন, কি অভিনয় করেন তারাই ভালো জানে। এটি হালের মানুষদের নিয়েই তৈরি নাটক এটি কয়জন দেখেন তার কি হিসাব আছে, বা সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নাটক নিয়ে ভালো কোন রিভিউ আছে কি? নেই, কারণ তরুণদের জন্য বানানো নাটক তরুণরাই দেখছে না।

আপনারা ক্যাটরিনা-অক্ষয়ের 'দে দানা দান' ছবির বৃষ্টির গানের সুর হুবহু নকল করে দেশের 'মিলন-মম' কে দিয়ে অশ্লীলতারও নীচের স্তরে নেমে গান তৈরিতেই ব্যস্ত থাকবেন। যেটা কোন সুস্থ নির্মাতা বা অভিনয়শিল্পীদের দ্বারা কাজ করা সম্ভব না। দেশীয় শিল্পীরা এখানে তেড়ে এসে বলবেন, বাইরের গান ঠিকই দেখবেন শুধু আমরা করলেই দোষ। এখানে বলতেই হয়, তাদেরটা তো দেখতে আসলেই ভালো লাগে, চিত্রায়ন হয় ভালো মানসম্মত, আপনারা যদি ঐটা দেখে হাফপ্যান্ট পরে পানিতে নেমে গিয়ে নিজেদের ক্যাটরিনা ভাবেন তাহলে তো সমস্যা।

মীরাক্কেল নকল করে এনটিভিতে 'হা-শো' নামের নিম্নমানের একটি শো বানাবেন আবার আশা করবেন এগুলো মানুষ দেখবে। একই ভাবে জি বাংলার 'দিদি নাম্বার ১' নকল করে গাজী টিভি বানিয়েছে 'আজকের অনন্যা' নামক একটি অনুষ্ঠান না এইটাও দর্শক টানতে ব্যর্থ। না ভাই এভাবে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়।

এভাবে খুঁজলে আরো অনেক উদাহরণ হয়তো বের করা যাবে কিন্তু এতে কাজের কাজ কিছু হবে না। ভীতু ছাত্রের মত পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে লাভ নেই আপনাদের পরীক্ষা দিতেই হবে, এ থেকে পালানোর উপায় নেই। তাই ভালোমত পড়াশোনা করে প্রতিযোগিতায় নেমে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ভালো কাজ মানুষ দেখবেই, কাজ তৈরি করার দায়িত্ব তাই আপনাদের।

তাই অন্যকে দোষ না দিয়ে নিজের ঘরের সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহারে নজর দেয়াই উত্তম বৈকি!

আমাদের দেশেই ফেরদৌসি মজুমদার, বিপাশা, শমী, আফসানা মিমি, মাহফুজ আনাম, জাহিদ হাসানরা ভালো মানের নাটক, সিনেমা উপহার দিয়েছেন। তাই ভালো কাজ এদেশে হবে না এটা কখনোই সম্ভব না। আমাদের দেশে অত্যন্ত মেধাবী নতুন, পুরানো অভিনয়শিল্পী ও গুণী নির্মাতারা আছেন যারা পূর্বে ভালো কাজ করেছেন, যারা এখন শুধু সুস্থ প্ল্যাটফর্ম না পেয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন।

তাই যোগ্য মানুষের হাতে সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দিতে পারলেই দেশীয় শিল্প আবার জেগে উঠবে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই বিদেশী জিনিসকে আমরা প্রতিহত করবো আমাদের ভালো এবং উন্নত কাজের মাধ্যমে। খেলায় অংশ না নিয়ে শুধু প্রতিহত করার মানসিকতা আমাদের আরো দুর্বলই করবে, উন্নত কখনোই নয়।

  • অংকুর ভৌমিক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত