মাসকাওয়াথ আহসান

১০ ডিসেম্বর, ২০১৬ ১৫:০০

শাকিল: প্রেম ও রাজনীতির কবি

সদ্য প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিলের মৃত্যুর আগে লেখা কবিতাটি বেশ কয়েকবার পড়লাম। আপাত: দৃষ্টিতে এটিকে কোন মানবীর জন্য বিরহগাথা বলেই মনে হবে। যে কোন পাঠক বিষয়টিকে সেভাবেই দেখবেন।

সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে আমার কাছে কবিতাটির পৃথক অর্থব্যঞ্জনা চোখে পড়েছে। অনেক কবির কবিতায় প্রেম-বিরহকে রূপক ও প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

কবি মাহবুবুল হক শাকিল স্বদেশকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। তার জীবন আবর্তিত হয়েছে স্বদেশের মাটি ও মানুষের সেবা করে। তার দেশের প্রতি ভালোবাসাকে ছাপিয়ে যাবার মতো অন্য কোন ভালোবাসার অবকাশ ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-এ তিনি প্রাণপাত করেছেন। যে রকম তীক্ষ্ণ মেধা ও ফটোজেনিক মেমোরি সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি; তাতে অনায়াসে অন্যদের মত একটি গতানুগতিক আরামদায়ক ক্যারিয়ারের পিছে ছুটতে পারতেন তিনি। সেটা তিনি করেননি। কারণ দেশমাতৃকার প্রতি তার অঙ্গীকার ছিলো ঋজু। তাই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের জন্য তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আর পাঁচটা সাধারণ পার্থিব চিন্তার মানুষের মতো করে জীবনকে কখনোই দেখেননি তিনি। সুতরাং তার লিখে যাওয়া শেষ কবিতার মাঝে পার্থিব প্রেম খুঁজে পাওয়া খুবই সরলীকৃত এক ভাবনা।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই কবিতার প্রতি তার সুতীব্র আগ্রহ চোখে পড়েছে। সাহিত্যের ছাত্র হয়েও যেসব জটিল রূপকধর্মী কবিতা আমার পক্ষে স্মৃতিতে রাখা সম্ভব হয়নি; সেইসব কবিতা তিনি শুনিয়ে দিতে পারতেন যে কোন জায়গায়; যে কোন সময়। আসলে তিনি ছিলেন কাব্যের মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিক টানাপড়েনের ক্রান্তিকালে তার পক্ষে সম্ভব হয়নি কবিতা লেখার অবসর জোগাড় করা। তাই অবসরে মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে জীবনানন্দ দাশ; জয় গোস্বামী থেকে আবুল হাসান থাকতো তার চিন্তায়। তিনি আসলে ছিলেন একজন কবিতাশ্রয়ী মানুষ।

অনেক চড়াই-উতরাই-এর মাঝ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি যখন মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের কাঙ্ক্ষিত সরণিতে হাঁটতে থাকে; শাকিল তখন নিজে কবিতা লেখার খানিকটা অবসর পান। এই কবিতা চর্চার সময়টিতে তিনি লক্ষ্য করেন, তার স্বপ্নের বাংলাদেশ এর অসাম্প্রদায়িক-পরমতসহিষ্ণু-সাম্য ভাবনার অঙ্গীকার ফেলে ক্রমশ: কট্টরপন্থী-লুণ্ঠক ঔপনিবেশিক ভাবনার রাজনীতির সঙ্গে প্রেম জুড়ে দিয়েছে। শেষ কবিতায় তিনি প্রেমিকার অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার বেদনাকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন; তা আসলে রাজনৈতিক আদর্শের স্বৈরিণী হয়ে পড়ার বেদনাগাথা। কবিতা তো এরকমই হয়। এর নানা অর্থ দ্যোতনা থাকে।

আমাদের সমাজটি সেইভাবে নন্দনভাবনাকে আত্মস্থ করতে না পারায়; মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অনায়াসে বখে যাওয়া লোক বলে দিতে পারে। এরা প্রত্যাশা করে প্রত্যেকটি মানুষই একটি গড়পড়তা জীবন যাপন করবে। একারণেই এখানে মাঝারি চিন্তার বাইরের মানুষদের " মিসগাইডেড জিনিয়াস" বলে নিরুৎসাহিত করা হয়। অথবা নিজেদের আবদ্ধ চিন্তার খর্ব গজ-ফিতা দিয়ে প্রতিটি মানুষকেই মাপতে চেষ্টা করে চিন্তা-বামনেরা। কেবল কবি শাকিল নন; যুগে যুগে প্রতিটি এবাভ এভারেজ সৃজনশীল মানুষের দিকে পাথর ছুঁড়েছে কাব্যহীন মোহরমনা স্থূল মানুষেরা।

তাতে অবশ্য সৃজনশীল মানুষদের কিছু এসে যায়না। একজন গালিভারের পক্ষে লিলিপুট চিন্তার সংকীর্ণতাকে বুঝে ওঠা খুবই কঠিন। কারণ অনন্য চিন্তার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে সমাজের স্টেরিওটাইপড ক্লিশে কুচিন্তাগুলোকে তারা বুঝতেই পারেনা।

কবি শাকিলের "মন খারাপের গাড়ী" বাংলাদেশের সমাজ-রাজনৈতিক বিবর্তনের বিষণ্ণ কাব্য।

যারা কবিতা ভালোবাসেন তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারেন, কবি শাকিল যখন বলছেন, প্রেমিক কখনো খুনি হতে পারে না; খুনি হয় কাপুরুষেরা; সেটা সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কেই বিপন্ন উপলব্ধি।

  • মাসকাওয়াথ আহসান : সাহিত্যিক, সাংবাদিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত