মাহমুদা খাঁ

১৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ২২:৩২

চা শ্রমিকদের ভূমি রক্ষা আন্দোলনের ১ বছর : আজও দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি জীবন

বলা হয়ে থাকে, ১৯২১ সালের চা শ্রমিকদের 'মুল্লুক চলো' আন্দোলনের পরই উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চান্দপুর-বেগমখানের চা শ্রমিকদের ভূমি রক্ষার আন্দোলন। আন্দোলন শুরুর পর প্রায় প্রতিদিন মিছিল সমাবেশ হতে থাকে উক্ত ধানী জমিতে। শ্রমিকরা লাগাতার প্রায় ৫ মাস সেই আন্দোলন চলমান রাখেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন এক প্রকার বাধ্য হয়ে আপাতত এই জোন স্থাপন স্থগিত রেখেছে।

বলা বাহুল্য, এই ধানী জমিতে নির্ভরশীল হচ্ছে ১২০০ এর অধিক পরিবার, যারা কোনরূপ চা বাগানের কাজের সাথে জড়িত নয়। তাদের পরিবারের একমাত্র আয়-উপার্জন হচ্ছে এই জমিকে ঘিরে। এখন যদি এই জমিতে সরকার ইকোনমি জোন স্থাপন করে, তাহলে এসব প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষকে রাস্তায় বসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। যে জমিতে বছরে ৫৯ হাজার মণ ধান, যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা ও ৮০/৯০ লক্ষ টাকার সমপরিমাণের সবজি চাষ হয়, সে জমিকে অকৃষি খাস জমি দেখিয়ে প্রশাসন সম্পূর্ন ভাবেই এক ভয়ঙ্কর মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে- সেটি ইতিমধ্যে সবার জানা হয়েছে।

চান্দপুর-বেগমখান চা শ্রমিকদের ভূমি রক্ষা আন্দোলনে চোখে পড়ার মতো ছিল নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহন। শতকরা নব্বই ভাগ নারী ছিলেন এই আন্দোলনের মূল প্রাণ । তাদের কন্ঠেই প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল- "আমার মাটি আমার মা, কেড়ে নিতে দিব না", "রক্ত দিব জীবন দিব, ধান্য জমি দেব না"।

জোন বিরোধী আন্দোলনের একজন সংগঠক হিসেবে এসকল শ্রমিকদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তাদের সাথে থেকে খুব কাছ থেকে দেখেছি তারা কতটুকু নির্যাতিত, নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত। সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছে তারা খুবই অবহেলিত। যদিও বাংলাদেশ সরকার একটি ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে তাদেরকে নাগরিকত্বের অধিকার দিয়েছে, কিন্তু দেয়নি তাঁদের জীবনমানের উন্নয়নের সামান্যতম সুযোগ-সুবিধা।

২৩ কেজি চা পাতি তোলার বিপরীতে শ্রমিকরা মজুরি হিসেবে মাত্র ৮৫ টাকা পান, যেটি কিছুদিন পূর্বেও ছিল ৬৯ টাকা। সেই সাথে শ্রমিকদের নাম মাত্র মূল্যে রেশন দেওয়া হয়। প্রতিজন শ্রমিক ১ টাকা ৩০ পয়সা কেজি হিসাবে প্রতি সপ্তাহে পান ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম চাল বা আটা। সেটাও আবার সব সময় পাওয়া যায় না। এখন এই অনুন্নত সমাজে আদর্শ পরিবার ধরেও যদি হিসাব করা হয়, তা হলে মাথাপিছু পড়ে সর্বোচ্চ ২৫০ গ্রাম চাল (আদর্শ পরিবারে ৪ জন সদস্য ধরা হয়। দুই জন কাজ করলে পান ৩.২৭০+৩.২৭০=৬.৫৪০ কেজি চাল। তাহলে দিন প্রতি প্রতিজনের ভাগে পড়ে ২৭৭ গ্রাম চাল।) বর্তমান বাজারে এই ৮৫ টাকায় সংসার নির্বাহ করা কিভাবে সম্ভব, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

চা শ্রমিকের অর্ধেকেরও বেশি নারী, আর এই নারীদের অবস্থা আরও খারাপ। আগে শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পেতেন না। কাজ না করলে খাবার জুটবে না, তাই বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা এই সময়টাতেও কাজ করেছেন। এমনও হয়েছে যে কাজ করতে করতে চা বাগানের মাঝেই চটের বস্তা বা পলিথিনের উপর বাচ্চার জন্ম হয়েছে। বর্তমানে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তা যথেষ্ট নয়। এখনও প্রসুতিকালে তারা মাতৃত্বকালীন ছুটি ঠিকভাবে পান না! দেড় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি কোনো মতেই গ্রহনযোগ্য নয়। আবার পূর্ণ ছুটি ভোগের কথা থাকলেও বাস্তবে তা হতে দেখা যায় না। যদিও চা শ্রমিকরা দাবি জানিয়ে আসছেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি দেশের অন্যান্য পেশায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের সমপর্যায় করার জন্য।

ডাঃ নিবাস চন্দ্র পাল তার ‘চা শ্রমিকদের কথা’ বইতে উল্লেখ করেছেন, 'চা বাগানের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ নারীই রক্তশূন্যতার মাঝে গর্ভধারণ করেন। অপুষ্টি ও বাল্যবিবাহ এর অন্যতম কারণ।' ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী, প্রতিটি চা বাগানে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র থাকার কথা থাকলেও অনেক চা বাগানে ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবার কোনো সুবিধা নেই। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে কোন ধরনের পরিবহনের ব্যবস্থা নেই। একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় পা এবং মাচা। যেসব বাগানে ডিসপেনসারি রয়েছে, সেখানে নামমাত্র ওষুধ ছাড়া জীবনরক্ষাকারী কোনো ওষুধই মেলে না। বেশির ভাগ বাগানেই কোন ডাক্তার, ওষুধ ও নুন্যতম চিকিৎসা সেবা নেই।

ফিরে আসি আবার চা শ্রমিকের ভূমি রক্ষার দিকে। সরকারি খাস খতিয়ান হিসেবে যে অকৃষি জমি ডানকানকে ১৮৯০ সালে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, সেই অকৃষি খাস জমিকে চা শ্রমিকের পূর্বসূরিরা ১২৫ বছর আগে ফসলি জমিতে রূপান্তরিত করেছেন। ১২৫ বছর যাবত ফসল ফলানো, প্রতি বছর বিঘা প্রতি সাড়ে তিন মণ চাল অথবা আটার সমপরিমাণ রেশনের মূল্যে এই জমির দাম পরিশোধ করা হয়েছে বহু আগে। ডানকান চুক্তিমতো জমি ব্যবহার না করায় যেহেতু আইন অনুযায়ী এই লিজ বাতিল করা হয়েছে, তাহলে ১৯৯৭ সালের খাস জমি বন্দোবস্ত আইন অনুযায়ী এই জমির স্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়ার অগ্রাধিকার রয়েছে চা শ্রমিকদের। জমি যদি লিজ দিতে হয়, তাহলে শ্রমিকদেরই দিতে হবে।

ইকোনমি জোনের নামে শ্রমিকের জীবন মান উন্নয়নের যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের কাছ থেকে, সেটি যে ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু নয়- সেটা প্রতিয়মান হবে যদি আমরা দেখি ইকোনমি জোন কোন প্রেক্ষিতে এবং কিসের জন্য করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল আইন ২০১০ অনুসারে, অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমি ৪ ধরনের কাজে ব্যাবহার করা যাবে-
(ক) রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা: রপ্তানীমুখী শিল্পের জন্য নির্ধারিত;
(খ) অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াকরণ এলাকা: দেশীয় বাজার চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত শিল্পের জন্য নির্ধারিত;
(গ) বাণিজ্যিক এলাকা: ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, ওয়্যারহাউজ, অফিস বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত;
(ঘ) প্রক্রিয়াকরণ মুক্ত এলাকা: আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন ইত্যাদির জন্য নির্ধারিত।

ফলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, বিপুল কর্মসংস্থানের কথা বলে কৃষি জমি অধিগ্রহণ করে অর্থনৈতিক অঞ্চল করা হলেও সেখানে আসলে কার স্বার্থরক্ষিত হবে? জমি হারানো চা শ্রমিক আর তার পরিবারের, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নাকি দেশি-বিদেশি লুটেরা পুঁজিপতি ও বিনিয়োগকারীদের?

তাই ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর থেকে চলা আন্দোলন আজ এক বছরে পর্দাপন করেছে। আজ পর্যন্ত চা শ্রমিকদের দাবি একটাই- আমাদের উন্নত জীবন আর চাকুরীর লোভ দেখিয়ে লাভ নেই, আমরা আমাদের মাকে চাই, মায়ের বিকল্প আর কোনো কিছুই হতে পারেনা। পূর্বেও আমাদের অনেক লোভ দেখিয়ে হবিগঞ্জ তথা সিলেটের অনেক চা বাগানের জমি দখল করা হয়েছে।

চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্প। অথচ এই বৃহৎ শিল্পের শ্রমিকদের জীবনমান কাছ থেকে দেখলে যে কারোও চোখ কপালে উঠবে। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠে এক কাপ চা পান না করলে আমাদের যাদের সকালের যাত্রাই শুভ হয় না, তারা কি জানি এই চা শ্রমিকরা নামিদামি হোটেল কিংবা রেস্টুরেন্ট এর এক কাপ চায়ের মূল্যের সমপরিমাণ মূল্যও পায় না!

সোনারগাঁও হোটেলের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ব্রেকফাস্ট টি ১২০ টাকা, দার্জিলিং টি ১২০ টাকা, গ্রিন টি ১২০ টাকা, অলিম্পিক টি ১৮০ টাকা, আইস টি ১৪০ টাকা ছিল কয়েক দিন আগেও। এখন সবগুলোর দাম বেড়ে ১৯৪ টাকা হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এই চায়ের উৎপাদক, তাঁরা কি দুই কাপ চায়ের দামও পাবেন না? তাঁরা পাতা শুকিয়ে বড়ি বানিয়ে চিনির বদলে লবণ দিয়ে চা খান।

টেলিভিশনের ক্যামেরায় আমরা সাজানো বাগানে হাস্যরত মালির অভিনয় দেখি, সংসদে ইতিহাস দখলের লড়াই দেখি, কিন্তু চোখের সামনে জীবন্ত মানুষ মরে মরে যে ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে; আমরা তা দেখব না? ব্রিটিশ উপনিবেশ, পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর আজও চা শ্রমিকরা নিম্ন মজুরি আর মানবেতর জীবন পার করছে। আজও দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি চা শ্রমিকের জীবন।

 

লেখক: কেন্দ্রিয় সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও সংগঠক, চান্দপুর-বেগমখান ভূমি রক্ষা আন্দোলন

আপনার মন্তব্য

আলোচিত