শেখ মো. নাজমুল হাসান

১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ ১২:৩৮

কেমন ছিল বিজয়ী বাংলাদেশের প্রথম সকাল!

গোলাগুলির শব্দ পেলেই বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া ততদিনে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে বিল পরিবেষ্টিত ফাঁকা মাঠের মধ্যে বাড়ী আমাদের। বর্ষাকালে চারিদিকে থৈ থৈ পানি, দ্বীপের মত ভাসতে থাকে বাড়ীটি। বর্ষাকাল ছাড়া বাকি সময়গুলিতে দিগন্ত বিস্তৃত ধু ধু ফসলের মাঠের মধ্যে আমাদের বাড়ী। বাড়ীর পিছনের দিকে ছিল একটা ন্যাড়া বাহা ভিটে। এই ভিটের মাটি খুঁড়ে বাঙ্কার বানানো হয়েছিল। অনেকগুলি বাঙ্কার, বাড়ীতে বসবাসকরী সবগুলি পরিবারের লোকজন একসাথে বাঙ্কারে গিয়ে লুকনোরমত ব্যবস্থা ছিল।

আমাদের বাড়ীর চারপাশে কয়েক কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে আর কোন বাড়ীঘর ছিল না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আসার সময়ে অনেক দূরে থাকা অবস্থায়ই তাদেরকে দেখা যেতো এবং তাৎক্ষণিকভাবে দোয়া-কালাম পড়তে পড়তে সবাই বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নিতো।

এতো গণ্ডগ্রামে সাধারণত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেতো না। আমাদের বাড়ীতে ঘন ঘন হামলা দেবার কারণ, আমরা ছিলাম মুক্তিযোদ্ধা পরিবার। আমার বাবা, বড়ভাই, মেঝোভাই সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আত্মীয়স্বজন মিলে মোট বত্রিশজন মুক্তিযোদ্ধা। সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানোর মূল দায়িত্বে ছিলেন আমার বাবা। আমার দু ভাইসহ ছোট ফুফুর ছেলে বটু ভাই, তিনজন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। ফলে আমাদের বাড়ী ছিল অনেকটা মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রের মত। কেউ মুক্তিযুদ্ধে যেত চাইলে আমাদের বাড়িতে এসে খোঁজ-খবর নিতো এবং মুক্তিযুদ্ধে চলে যেতো।

আশেপাশের কোন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা কোন অপারেশন করার পরিকল্পনা করলে বেজ হিসেবে বেঁছে নিতো আমাদের বাড়ী। মুক্তিযোদ্ধা-বাড়ী হিসেবে আমাদের বাড়ীর পরিচিতি এবং বিশ্বস্ততার পাশাপাশি এর বিচ্ছিন্ন অবস্থান অপারেশনের বেজ হবার জন্য ছিল উপযুক্ত। ফলে পুরো যুদ্ধকালীন আমাদের বাড়ীটি ছিল একটা মিনি ক্যন্টনমেন্ট।

গরুরগাড়ি ভরে ভরে অস্ত্রপাতি, গোলাবারুদ এনে পলিথিনে মুড়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তা লুকিয়ে রাখা হতো। বড় বড় ড্রাম ও খালি তেলের টিনে গুলি ভরে মাটির তলে লুকিয়ে রাখা হতো। এলএমজি, এসএমজি, বন্দুক, রাইফেল আরও কত যে অস্ত্রপাতি থাকতো তার ইয়ত্তা নাই। শুধু মাটির তলে কেন; খড়ের গাঁদা, কলাগাছের ঝোপ, রান্নাঘরের মাচা, ঘরের ভিত, ধানের কোলা, ছাইয়ের গাদা, খোলা পায়খানার চাল সর্বত্রই লুকানো থাকতো অস্ত্র ও গোলা-বারুদ। খালি তেলের টিনের মধ্যে গুলি ও গ্রেনেড বোঝাই করে মুখ এঁটে পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো।

আমাদের গ্রামের বোধ হয় এমন কেউ ছিল না যে অস্ত্র চালাতে জানতো না। আমার বাবা এবং ভাইয়েরা প্রায় সবাইকেই অস্ত্র চালনা শিখিয়েছিল। ফলে যারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি তারাও অস্ত্র চালাতে জানতো। বাঙ্কারে এবং তার আশেপাশেও গর্ত খুঁড়ে রাখা হতো অস্ত্র ও গোলা-বারুদ। যদি পাকসেনারা আক্রমন করে বসে তবে যেন লড়াই করা যায় সে জন্য এ সতর্কতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। আমার ভাইয়েরা গ্রামের সবাইকে ক্রলিং করা শিখিয়েছিল। বিপদ এলে যেন ক্রলিং করে গোলাগুলি করা যায় এবং আত্মরক্ষা করা যায়।

ষোলই ডিসেম্বর সকাল। চারিদিকে গোলাগুলি হচ্ছে। ভয়াবহ গোলাগুলি। দূরের গ্রামগুলিতে গোলাগুলি হলেও ফাঁকা মাঠের ভিতর দিয়ে তার বিকট শব্দ ভেসে আসছে। একটানা গোলাগুলি ও গ্রেনেড ফাঁটার শব্দ, এক মুহূর্তর জন্যও থামছে না। ক্রমাগত গোলাগুলির শব্দ। মাঝে মাঝে গ্রেনেড ফাঁটার শব্দ এবং তা থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছে। আকাশ ছেঁয়ে যাচ্ছে গ্রেনেডের ধোঁয়ায়।

আমি ছোট হলেও বুঝে গেছি এখন বাঙ্কারে গিয়ে পালাতে হবে। কিন্তু কেউ পালাচ্ছে না। রাঙ্গাভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “কেউ পলাচ্ছে না ক্যা? রাঙ্গাভাই বলল, “আর পলাতি অবি না, বাংলাদেশ স্বাধীন অয়ে গ্যাছে।” আমি তো স্বাধীনতা বুঝি না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “স্বাধীন ওলি কি গুলাগুলি করতি অয়?” রাঙ্গাভাই বলল, “আরে ওতো আনন্দ করতিছে। নিজিরা নিজিরা ফাঁকা যাগা গুলাগুলি করতিছে মানুষ মারতিছে না।” চল আমরাও মজা করি।

যেখানে যতো অস্ত্র, গোলা-বারুদ লুকানো ছিল একের পর এক বের করে স্তুপ করা হলো। আসলেই এক মিনি ক্যান্টনমেন্ট। গ্রামের সব মানুষ জড় হয়েছে আমাদের বাড়ীতে। সবাই অস্ত্র, গুলি, গ্রেনেড হাতে নিয়ে ফাঁকা মাঠে চলে গেল। শুরু হলো ক্রমাগত গুলি ও গ্রেনেড ফাটিয়ে আনন্দ করার এক মহা-আনন্দমেলা। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলল সে আনন্দ বন্যা।

সকালে যখন চারিদিকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, মানুষের মধ্যে বয়ে যাচ্ছিল আনন্দের ফোয়ারা, তখন আমাদের বাড়ীতে চলছিল শোকের মাতম। মা চিৎকার করে কাঁদছিল, মা’র সাথে কাঁদছিল আরও অনেকে। বুকফাঁটা সে কান্না।

বাবা ফেরেননি, সেই ১৪ই আগস্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে সেই থেকে বাবা নিখোঁজ। ফিরে আসেননি আমার দাদাভাই এবং মেঝোভাই। তারা বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন তাও আমরা জানি না। আশেপাশের গ্রামের কেউ কেউ তখন মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে। তাদের কাছে খবর পাওয়া গেছে কমান্ডার জাহাঙ্গীর আলম ভাটিয়াপাড়া অপারেশনের সময়ে মারা গেছেন। কমান্ডার জাহাঙ্গীর আলম আমার বড়ভাই।

মেঝোভাই সেই যে যুদ্ধে গেছেন তারপর থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাবা যে নিখোঁজ হয়েছেন তাও দু ভা্ইয়ের কেউই জানেন না। দু ভাইয়ের কারও খোঁজও তারা কেউ জানেন না। দুজনই কমান্ডার, দুজনের যুদ্ধক্ষেত্র ভিন্ন ভিন্ন। তারা কে কোথায় আছেন কেউ জানে না। বাড়ী থেকে আমরা কেউই জানি না বাবা, বড়ভাই এবং মেঝোভাই এরা কেউ বেঁছে আছেন নাকি মরে গেছেন। আমরা বাড়ীতে বেঁচে আছি না মরে গেছি তাও জানেন না আমার বড় দু ভাই।

সবার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসছে, আমার ভাইয়েরা ফিরে আসছে না। নানানজনের কাছে নানান খবর শোনা যাচ্ছে। একেকটা খবর আসে আর বাড়ীতে শুরু হয় কান্নার মাতম। সে কি কান্না। চারিদিকের গোলাগুলির শব্দকে ছাড়িয়ে যায় শোকের সে মাতম।

আমাদের জন্য বিজয়ী-স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রক্তলাল সূর্যদয় সুখের ছিল না, বিজয়ের সুখ অনুভব করার মতো কোন অবস্থাই আমাদের ছিল না। আমাদের জন্য বিজয়ের সকালটা ছিল খুবই শোকার্ত এবং কান্নাভেজা। ভাইদের সংগ্রাম এবং পিতার রক্তের উপর দিয়ে ভেসে আসা বিজয়ের রক্তিম সকালের রক্তেরসাথে মিশে গিয়েছিল আমাদের শোকার্ত চোখের জল। পিতার লাল রক্তেরসাথে আমাদের নীলকষ্টগুলো একাকার হয়ে সবুজ হয়ে ঘিরে আছে রক্তের লাল বৃত্ত। এ আমার বাংলাদেশ।

  • শেখ মো. নাজমুল হাসান : লেখক, চিকিৎসক।

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত