ঈশিতা দেব

২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:৫৭

পরিবর্তনটা খুবই দরকার এখন

আমরা সকলে দূর থেকে টিপ্পনি কাটতে পছন্দ করি। কোন খুঁত অথবা ভেজাল দেখলে তা দূর থেকে উপভোগ করি, উপদেশ দিয়ে দেই অথবা হতাশাযুক্ত দীর্ঘ দীর্ঘ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করি। অথচ একবারের জন্যও আমরা নিজেকে সে জায়গায় রেখে চিন্তা করি না যে, সেখানে আমি থাকলে কি করতাম। অথবা এই জায়গায় আমার মত কেউ থাকা উচিত ছিল। আত্মবিশ্বাসের অভাব আমাদের কক্ষনো সে কাজের জন্য নিজেকে উপযুক্ত ভাবতেই দেয় না। সবাই কেমন যেন স্রোতের ঠেলায় গা ভাসিয়ে দেই প্রতিবার, প্রতিক্ষেত্রে। উচিত স্থানে উচিত কথা বলার মত মেরুদণ্ডযুক্ত মানুষের বড্ড বেশি অভাব।

আমরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গালি দেই। ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর ধরণ নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করি। অথচ এই চিরাচরিত নিয়মের বাহিরে কেউ কোন নতুন আইডিয়া প্রবর্তন করলে তার উপর বিরক্ত হই। নিজের ক্রমাগত খারাপ রেজাল্ট অথবা পড়াশুনায় অনীহার জন্য উচ্চস্বরে এই শিক্ষাব্যবস্থাকে দায়ী করতে থাকি বছরের পর বছর। কিন্তু এতে লাভ কি? কিচ্ছু না। আমাদের নিজস্ব হতাশা বার বার আমাদের একই গোয়ালের গরুর দলে ফেলে যাচ্ছে, আর চিরাচরিত শিক্ষাব্যবস্থা যেমন ছিল, তেমনই থাকছে। আমরা কক্ষনোই এর বাইরে গিয়ে চিন্তা করতে পারি না যে, যদি অবস্থার পরিবর্তন নিয়ে আসতে হয়, তবে আমাদেরকেই তেমন জায়গায় পৌঁছাতে হবে, যেখানে গেলে অন্তত আমাদের দ্বারা এর সূত্রপাত ঘটানো সম্ভব।

আমারা নানান কারণে প্রতিনিয়ত দেশকে গালি দেই। মানব স্বভাব, তার মস্তিষ্কের আয়তনের বাইরে কল্পনা করতে পারে না। আমরা শুধু বাকির খাতায়ই চোখ ডুবিয়ে রাখতে ভালোবাসি, প্রাপ্তির খাতা বরাবরই আমাদের জন্মগত অধিকার! মানছি, খুঁত সব দেশেরই আছে। সিস্টেম লস সর্বত্রই কমন ফেনোমেনা। কিন্তু সে খুঁত যেমন মানুষের দ্বারা ঘটছে, তেমনি আমাদের মত মানুষই পারে সে খুঁত সারাতে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সহজ পথ হল পলিটিক্স। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের রাজনীতির হাতেখড়ি হয় ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে। অথচ সেক্ষেত্রেও অনীহা! ছাত্রজীবনের সমাপ্তির সাথে সাথে আমরা রাজনৈতিক জীবনেরও বিসর্জন দেই একগাদা হতাশার কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। সেক্ষেত্রেও নিজের সার্টিফিকেটের কম সংখ্যামানের দায় চাপাই রাজনীতির ঘাড়ে। অথচ আমরা সবাই জানি, ১৮ ঘণ্টা শিটের ভেতর চোখ ঢুকিয়ে রাখার মত ছাত্র-ছাত্রী আমরা কেউ নই। যা পড়ার, তা পরীক্ষার আগের রাতেই আমরা কমবেশি পড়াশুনা করি। যে সময়টুকু আমরা রাজনীতিতে ব্যয় করি, তা হয়ত আড্ডা, নেশা অথবা গেমস জাতীয় আনপ্রোডাক্টিভ কাজে আমরা ব্যয় করতাম। তা না করে পলিটিক্স এর মত প্রোডাক্টিভ কাজে ব্যয় করা ক্ষতির কিছুই নয়। আমাদের নিজস্ব দায় অথবা পরিস্থিতি আমাদেরকে এই জগতে বেঁধে রাখতে পারে না, এতে পলিটিক্স এর কোন দোষ নেই, থাকতে পারে না। অবশ্য পলিটিক্স কে মানুষ ক্ষমতার অপব্যবহারের অস্ত্র হিসেবে চালিয়ে দেয়, যা আমাদের দেশের সাপেক্ষে অবশ্যই বাস্তব, কিন্তু সত্য নয়। এ ধ্যান-ধারণাও একপ্রকার সিস্টেম লস এর-ই ফসল। পলিটিশিয়ানদের কাজ শুধুমাত্র দাপট দেখিয়ে ঘুরে বেড়ানো মোটেই নয়। আমরা মেনে নেই বা না মেনে নেই, পলিটিক্স হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোত্তম জায়গা। একটা দেশের সমস্ত ভবিষ্যৎ নির্ভর করে পলিটিশিয়ানের একটা সাইন এর উপর। তাই সেখানে মানুষগুলোও সর্বোত্তম হওয়াটা অতিশয় বাঞ্ছনীয়।

অথচ সর্বোত্তম মানুষগুলোও পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে দেশে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে পাড়ি জমায় বিদেশে। দেশ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তারা সার্ভ করে অন্য দেশকে। সেখানে নিজের মেধার সর্বোৎকৃষ্ট বিকাশ ঘটিয়ে তারা অর্জন করে বৈদেশিক ডিগ্রী। আর আমরা তাদের অভাবনীয় সাফল্য দেখে ঘরে বসে হাততালি দেই। এতে দেশের অল্প একটু মান-সম্মান বৃদ্ধি ছাড়া লাভ কিছুই হয় না, দেশ দেশের মতই রয়ে যায়, কার্বন-ডাই-অক্সাইড আর সিস্টেম লস কোলে নিয়ে স্থবির বসে থাকে।

ভেবে দেখুন, একজন ব্যাংকারের একটি ভুল সিদ্ধান্ত বড়জোর একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ কেলেঙ্কারি ঘটায়। কিন্তু একজন পলিটিশিয়ানের ভুল সিদ্ধান্ত সমগ্র দেশের চিত্র ওলট-পালট করতে পারে। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, একজন ছাত্রের সমস্যা শুধুমাত্র একজন ছাত্রই ভালোভাবে বোঝে। একজন নাগরিকের সমস্যা একজন নাগরিকই বোঝে। শিক্ষক কক্ষনোই ছাত্রের মত করে চিন্তা করতে পারে না, চাইলেও। তাই পরিস্থিতির পরিবর্তন নিয়ে আসতে হলে এসব ছাত্রকেই শিক্ষকের অবস্থানে নিজ যোগ্যতায় পৌঁছাতে হবে। একজন নাগরিককেই নিজ যোগ্যতায় নগর চালানোর দায়ভার নিতে হবে। কেউ একদিনে ক্ষমতাশীল পজিশনে বসার সুযোগ পায় না। সাধনা করে, বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে ক্ষমতা, যোগ্যতা অর্জন করে দেখাতে হয়। দূর থেকে হাই-হুতাশ করে কিচ্ছু লাভ হয় না। দেশে সুস্থ পরিবর্তন নিয়ে আসার জন্য সুস্থ পরিচালকের খুবই প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, সে স্থানে পৌঁছানোর পর আমাদের আসল লক্ষ্য পাল্টে গেলে তা নিজের এবং পরবর্তী জেনারেশনের জন্য কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা কল্পনারও বাইরে। কিন্তু আমরা আসলে কিছুটা কাঁকড়া সম্প্রদায়ের মত। নিজের অবস্থার উত্তরণ হোক বা না হোক, অন্যকে টেনে নিচে নামানোতে বিশাল ওস্তাদ!

দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো উচিত। আর কত! একটা ফেমাস ডায়ালগ আছে, "কোন দেশই পারফেক্ট নয়, একে পারফেক্ট বানাতে হয়।" সমস্যার গান বন্ধ করে এখন সমাধানের গান রচনা করা উচিত। সবাই একসাথে ঘটনাটা বুঝবে না, আমি জানি। কিন্তু আমরা যে কয়েকটা মানুষ ব্যাপারটা উপলব্ধি করছি, তারা নিজ নিজ স্থানে পরিবর্তন নিয়ে আসলে ঠিক কতটা শোধরানো সম্ভব, নিজেই ভেবে দেখুন। আপনি বদলান, আপনার পাশের লোকটা আপনার দেখাদেখি বদলে যাবে কছুদিন পর। ভুলে গেলে চলবে না, পরিবর্তনটা খুবই দরকার এখন। এবং অল্প একটু সচেতন হলে পরিবর্তন আসবেই।

  • ঈশিতা দেব : শিক্ষার্থী, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
  • এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত