সৈয়দ রাসেল

২৫ ফেব্রুয়ারি , ২০১৭ ১৪:১৯

‘ঠিক’ এবং আওয়ামী লীগের জন্য একটি সতর্কবার্তা

ক'দিন আগে সিলেটের প্রথম সারির দায়িত্বশীল এক আওয়ামী লীগ নেতা অনুষ্ঠান শেষ করে চা পর্বে মিলিত হয়েছিলেন। সাংবাদিকদের সাথে ঘরোয়া আলোচনায় তখন উঠে আসে আওয়ামী লীগের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথকতা। আওয়ামী রাজনীতি কোথায় ছিল, কোথায় এসেছে আর কোথায় যাবে এমন প্রশ্ন-উত্তর উঠে আসে আলোচনায়। একজনের প্রশ্ন ছিল- কেমন চলছে আওয়ামী লীগের চলমান রাজনীতি? প্রশ্নের উত্তর হোক আর নিজের মনের কথা হোক, তিনি বলতে শুরু করলেন। প্রথমেই উঠে আসে ৭৫ পরবর্তী রাজনীতির কথা। সিলেটে কারা কারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, আর নিজের প্রাণ বাঁচাতে দলের সাথে ‘বেইমানি’ করে কারা গেলেন আত্মগোপনে। আত্মগোপনকারীদের মধ্যে উঠে আসে বর্তমান সময়ের অনেক প্রভাবশালী নেতার নামও। লেখার বিষয়বস্তু এটা নয়, তাই আজ ওদিকে যাচ্ছি না।

তাঁর কথায় আক্ষেপ চলে আসে। বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতির কথা বলতে গিয়ে তিনি চরম একটা সত্য তুলে ধরলেন। যে সত্য একদিন আওয়ামী লীগের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। তখন বসে বসে পতন দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।

বললেন- ‘বিগত বিএনপি জোট সরকারের আমলে একটা মিছিল সমাবেশ ডেকে মানুষ পাওয়া যেত না। মহানগরীর ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের জনে জনে ফোন করা হত। কিন্তু মিছিলে মানুষ হতো না। তারপর ছোট পরিসরেই কর্মসূচি শেষ করতে হত। আর এখন একটা কর্মসূচি ঘোষণা করলেই হলো। ওই দিন কর্মসূচি শুরুর এক ঘন্টা আগেই নেতা-কর্মীদের পদভারে মাঠ ভারি হয়ে ওঠে। অবস্থা দেখে বড় মাপের নেতাদেরকেও তাজ্জব বনে যেতে হয়। এটাও খারাপ না বরং আশার কথা। এই আশার মাঝে তবে শঙ্কা হলো অন্য জায়গায়।’

তিনি বলছিলেন- ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এবং ৭৫ এর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত সময়ে সময়ে দেশের প্রতিটা মানুষই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে। মাত্র ৩-৪ বছর আগে যারা দেশের বিরোধীতা করেছে, তাদেরকেও দেখা যায় মিছিলের অগ্রভাগে। রাজনীতির সামনের সারিতে। হঠাৎ করে দেশের সবার আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠার খেসারত দিল সেই আওয়ামী লীগই। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট ইতিহাসের একটা ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড দেশের রাজনীতিকে একেবারেই ওলট-পালট করে দিলো। বাদবাকি সবাই জানেন। আশঙ্কা ওই জায়গাতেই। চলমান সময়ে হঠাৎ করেই সবার আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কিংবা নতুন করে নামে-বেনামে আওয়ামীকেন্দ্রীক রাজনীতির ধারক-বাহক হয়ে ওঠা আমাদেরকে আবার সেই ১৫ আগস্ট মনে করিয়ে দেয়। এছাড়া আরো একটি শ্লোগান আমাদেরকে নতুন করে ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে যায়।’

আশঙ্কার কথা বলতে গিয়ে সিলেটের প্রভাবশালী ওই নেতা বলেন- ‘কয়েক বছর আগেও সভা সমাবেশে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শুনে ভালোলাগা থেকে কর্মীরা হাততালি দিতো, সভা-সমাবেশ কিংবা জনসমুদ্র কাঁপাতো জয়বাংলা শ্লোগানে। শ্লোগানটা এখনো আছে এবং কর্মীদের তেজদীপ্ত করে তুলে, তবে বর্তমানে তাঁর সাথে যোগ হয়েছে ‘ঠি...ক’ শব্দের ব্যবহার। এই ‘ঠিক’ শব্দটি কখনোই আওয়ামী লীগ কিংবা প্রগতিশীল কোন রাজনৈতিক দলের শ্লোগান নয়। বিগত সময়ে এই ‘ঠিক’ শব্দটি জামায়াত-শিবির এবং বিভিন্ন মৌলবাদি সংগঠনের সভা-সমাবেশে শোনা গেলেও বর্তমানে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের মঞ্চে। তাহলে কোন পথে এগুচ্ছে আওয়ামী লীগ?'

সেদিন ওই আওয়ামী লীগ নেতার বক্তব্যটা ভালো লেগেছিল বলে বিষয়টা একদিন এক বড় ভাইয়ের কানে তুলেছিলাম। শুনে তিনি বললেন- 'যিনি এই বক্তব্য দিয়েছেন তিনি কি জানেন না যে কোন ছেলে শিবির-ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে এসেছে? সবই হয়েছে তাঁদের ছত্রছায়ায়। ওদেরকে চিহ্নিত করতে গেলে আওয়ামী লীগের দু’দিনের বেশি সময় লাগার কথা না। কিন্তু আওয়ামী লীগ যদি জেগে থেকেও ঘুমের ভান করে, তবে এই আওয়ামী লীগকে আর জাগানো যাবে না।'

নিজেদের শক্তি সামর্থ্য দেখানোর জন্য কিংবা নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য বর্তমানে সিলেটের আওয়ামী লীগ নেতারাও জামাত-শিবির পোষেন, এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এজন্য জামায়াত-শিবিরকে সিলেটের আওয়ামী রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠার অভিযোগ প্রভাবশালী কিছু আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে দীর্ঘদিন থেকেই। এই সম্পর্কের প্রভাবও পড়েছে বর্তমান ছাত্রলীগের জেলা ও মহানগর কমিটিতে। কাউন্সিলের আগে শিবির-ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীর পক্ষে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতারা সরাসরি অবস্থান নেওয়ায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে তারা আসীন হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদে। এ নিয়ে ছাত্রলীগের বড় একটা অংশ নাম ধরে ধরে তাদের বিগত দিনের দলীয় পরিচয় প্রকাশ করেছে। তারপরও কমিটিতে কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং সময়ে সময়ে তারা নেতৃত্বে আসছে। 'জয় বাংলা'র পরিবর্তে এদের কণ্ঠ থেকেই আসছে মৌলবাদি শ্লোগান। মাত্র ক'দিন বাদেই আবার সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন। আবারো কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হবে শিবির-ছাত্রদল থেকে আসা সুযোগসন্ধানী ‘হাইব্রিড’ নেতারা, একথা দ্বিধাহীন বলে দেয়া যায়।

আজ জামায়াত-শিবির ঘরানার অনেক পরিচিত মুখ সভা-সমাবেশে এসে অকপটে বলছে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। ওদের মুখ থেকে শব্দটা যতোটা না আশার বানী শোনায় তার চেয়ে বেশি জাগায় শঙ্কা। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে তারা ঠিকই স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে আর আওয়ামী লীগাররা দিচ্ছেন হাততালি, বাইরে গিয়ে পিঠ চাপড়েও দিচ্ছেন। সিলেটের এই মুখোশধারী সুযোগসন্ধানী লোকগুলোকে কে না চেনে। তবু আওয়ামী লীগে কোন ভাবান্তর নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ওই উড়ে এসে জুড়ে বসা নেতারাই মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের ‘প্রাণ’। এই প্রাণই একদিন যদি প্রাণঘাতি হয়ে ওঠে, তাহলে আরেকটা ১৫ আগস্ট অবশ্যম্ভাবি।

সম্প্রতি সিলেটে অনুমোদন পেয়েছে বেশকিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে আরো অনেকগুলো। এখানে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সম্পাদক অনেক চিহ্নিত জামায়াত ঘরানার লোককেও আওয়ামী লীগ নেতারা দিয়েছেন ‘আওয়ামী লীগের সার্টিফিকেট’। চিহ্নিত জামায়াত দলীয় অনেক সাংবাদিককে জনসম্মুখে তুলে ধরা হচ্ছে আওয়ামী লীগ বলে। এসব ঘটনা শুধু শঙ্কাই না, পঁচাত্তরকে গভীরভাবে মনে করিয়ে দেয়। এই পক্ষটা এত বেশি আওয়ামী লীগের পিঠে সওয়ার হচ্ছে যে, খুব কম সময়ে তারা পৌঁছে যাচ্ছে ক্ষমতার কাছাকাছি। কাউকে ছুরি মারতে হলে তার খুব কাছাকাছি যেতে হয়। কাছে যাওয়ার কাজটাতে তারা খুব তাড়াতাড়ি সফল হয়েছে, এখন শুধু ছুরি বসানোর অপেক্ষা। সময় সুযোগে আওয়ামী লীগের পিঠে ছুরি বসাতে ওদের হাত একটুও কাঁপবে না। এছাড়া বর্তমানে নামে-বেনামে হওয়া ভূঁইফোড় সংগঠনগুলোর ব্যপারেও আওয়ামী লীগকে আরো সতর্ক হতে হবে। এই ভূঁইফোড় সংগঠনগুলো ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের জন্য অশনি সংকেত।

এতদিন দিলো ‘নারায়ে তাকবির’ শ্লোগান, আর আজ বলছে ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’। আসলে তারা কারা? নিজেদের পিঠ বাঁচাতে তারা এসে আওয়ামী লীগে যুক্ত হচ্ছে নাকি আওয়ামী লীগ ধ্বংসে এটা তাদের দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ- এটা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। আর যদি আওয়ামী লীগ এদের ব্যপারে মাথা না ঘামায়, তাহলে এর খেসারত আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে। ঘটবে আরো একটি পঁচাত্তরের পুনরাবৃত্তি।

শেষ কথা হচ্ছে- নেতাকর্মীদেরকে এটা বিশ্বাস করতে হবে, টানা একমাস আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগের মিছিলে আসলেই কিংবা ‘জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু’ বললেই আওয়ামী লীগ হওয়া যায় না। আওয়ামী লীগ করতে হলে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করতে হয়।

 

লেখক : সাংবাদিক 

 

আপনার মন্তব্য

আলোচিত