আলমগীর শাহরিয়ার

০৩ জুন, ২০১৮ ২১:২০

তরুণদের মধ্যে মাদকাসক্তির মত প্রযুক্তি আসক্তি বাড়ছে

এদেশের তরুণ-তরুণীদের কাছে তিনি ঈর্ষনীয়রকম জনপ্রিয়। এ জনপ্রিয়তা তাঁর কালও হয়েছে বারবার। কারোর উপর আক্রমণ, আঘাত আর কুৎসা রটনার তীব্রতা বলে দেয় তাকে তাঁর শত্রুশিবির কতটা ভয় পায়। মুহম্মদ জাফর ইকবালের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। যেহেতু তিনি এদেশের তরুণদের নিয়ে ভাবেন, কাজ করেন তাদের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাময় এক বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বাসী করে তুলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নিরলস কাজ করেন - সেটা ধর্মান্ধ, পাকিস্তানি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী গোষ্ঠীর কাছে কোনদিনই সহ্য হয়নি। হবেও না। তাতে কিছু যায় আসেও না। সত্যকে হয়ত সাময়িক জনপ্রিয় মিথ্যার আবরণে ঢেকে ফেলা যায় কিন্তু সত্য সুন্দর ও সকল মহিমা নিয়ে চিরদিনই উদ্ভাসিত। যা হোক, গতকাল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলোর ইশকুলে "মানুষের ভবিষ্যৎ" নিয়ে কথা বলতে এসেছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। মোটাদাগে ৩টি বিষয়ে নিবদ্ধ ছিল তাঁর আলোচনাটি: ১. বই, ২. টেলিভিশন, ৩. ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি।

তরুণদের কাছে জনপ্রিয় এ সাহিত্যিক ও অধ্যাপকের আলোচনার বড় অংশজুড়ে ছিল প্রযুক্তি ও প্রজন্মভাবনা। বলাবাহুল্য, সোশাল মিডিয়া তাঁর আলোচনার মূল কেন্দ্রে ছিল। আলোচনায় অনেক কিছুই ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। একই সঙ্গে অপরিমেয় আশাবাদের। তিনি জানান, এই শতাব্দীর গোঁড়ার দিক থেকে ইন্টারনেট ও ব্যান্ডউইথ সহজলভ্য হবার পর এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের নতুন প্রজন্মের সৃষ্টিশীলতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিশেষকরে ফেসবুকের বহুল ব্যবহার কমবয়সীদের তো বটে বড়দেরও যেকোন সিরিয়াস কাজে অখণ্ড মনোযোগ নষ্ট করে দিচ্ছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকরাও এখন শতভাগ মনোযোগ দিয়ে একটা জার্নাল লেখা বা গবেষণা কাজ করতে পারছেন না।

প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতা(Easy access to technology) না চাইলে নানা অপ্রয়োজনীয় ও অদরকারি ঘটনার দিকে মানুষের মনঃসংযোগ ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি তাঁর পড়া সাইকোলজির একটা আর্টিকেল উদ্ধৃত করে বলেছেন, প্রযুক্তি আসক্তি অনেকটা মাদকাসক্তির মত হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট সময় পর পর যেমন মাদকসেবীরা মাদক সেবন না করলে শরীরে একটা প্রতিক্রিয়া হয় প্রযুক্তি আসক্তি বিশেষ করে ফেসবুক এডিকশন এ সময়ে তরুণ-তরুণীদের কাছে ঠিক তেমনটাই হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মানব সভ্যতায় কয়েকটা প্রজন্ম ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হবে। আজ থেকে ৫০ বছর পর ফেসবুকের আবিষ্কারক জুকারবার্গকে পৃথিবীর মানুষ নেতিবাচক চোখে দেখবে বলেও তিনি তাঁর বক্তৃতায় জানান। জুকারবার্গের অন্যতম এক সহযোগী এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, আমরা ফেসবুকের মধ্য দিয়ে সভ্যতার বিকাশ ও সৃষ্টিশীলতার অনেক বড় ক্ষতি করেছি।

আলোচনার আরেকটা অংশজুড়ে ছিল টেলিভিশন। আমেরিকার বিভিন্ন গবেষকদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তিনি জানিয়েছেন, পৃথিবীতে শিশুদের মধ্যে অটিজম বেড়ে যাবার একটা বড় কারণ ছিল টেলিভিশনের আবিষ্কার ও আসক্তি । ১-২ বছর বয়স একটা শিশুর চারপাশে হেসেখেলে, ভেঙ্গেচুরে, স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠার বয়স (Natural Growing Period)। স্বাভাবিক বিকাশের এই পথ ও প্রক্রিয়া রুদ্ধ করে দেয় টেলিভিশনের অতিবাস্তবিক ও অপরিচিত জগত। টেলিভিশনের জায়গা এখন দখল করেছে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ বা এরকমজাতীয় নানা ডিভাইস। বিশেষ করে এসব ডিভাইসে গেম খেলায় আসক্ত করানো একটা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের পথে অনেক বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এখনকার বাবা-মা তাদের শিশু সন্তানদের এসবে অভ্যস্ত করে খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে ঘুম পাড়ানো সব করাচ্ছেন কিন্তু তারা জানেন না কতবড় ক্ষতিই না তিনি তাঁর সন্তানের করছেন।

এসব সফিস্টিকেটেড ডিভাইস ব্যবহারের জন্য এই ছোট্ট শিশুটির মন প্রস্তুত না। সাময়িক খুশি হবার অন্তরালে শরীর ও মনে একটি প্রবল নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যা তাকে অটিস্টিক বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী করে তুলতে পারে। আমাদের মনে রাখা উচিত এসব ডিভাইস বড়দের ব্যবহার উপযোগী করে বানানো। শিশুকে বিভিন্নরকমের খেলনা কিনে দিন। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, আমরা যারা গ্রামে বড় হয়েছি তাদের বছরান্তে মেলায় কিছু হালকা খেলনা কেনা ছাড়া আর তেমন কোন খেলনা কেনার সুযোগ ছিল না কিন্তু প্রকৃতি থেকে অজস্র খেলনা কুঁড়িয়ে নিয়ে খেলেছি। শহরে বেড়ে উঠা শিশুটির সে সুযোগ নেই। তবু তাকে সাধ্যমত খেলার পরিবেশ দেবার চেষ্টা করুন। তার সুন্দর বিকাশ ও ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করুন।

স্যার তাঁর আলোচনায় বইয়ের সহজলভ্যতা একদিন জ্ঞানকে রাজদরবার বা এলিট শ্রেণির কাছ থেকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল বলে জানান। যা মানুষের বিকাশ ও সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করেছে। আবার মানুষই একদিন আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিশাল লাইব্রেরি পুড়িয়েছিল। যার আগুন নিভতেই মাস ছয়েক সময় লেগেছিল। তাছাড়া, জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি ও উৎকর্ষতার নানাদিক নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। সহস্রাধিক জীবনায়ু লাভের পাশাপাশি আগামী ৫০ বছরে পৃথিবীতে অনেক অভাবনীয় পরিবর্তন দেখে যাওয়া সম্ভব হবে বলেও তিনি তাঁর বক্তৃতায় জানান। প্রশ্নোত্তর পর্বে উইলিয়াম এফ অগবার্নের "Cultural Lag" থিওরি উদ্ধৃত করে স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যন্ত্রের উন্নতি ও অগ্রগতির সঙ্গে মানুষ যে তাল মেলাতে পারে না এবং এর ফলে সমাজে যে অভিঘাত তৈরি হয় এর থেকে মুক্তির পথ কী?

- বরাবরের মত আশাবাদী হৃদয় নিয়ে জানিয়েছেন অভ্যস্ত হতে বা খাপ খাওয়াতে একটু সময় লাগবে। প্রযুক্তি শেষমেশ ধ্বংস নয়, মানুষের কল্যাণ আর মঙ্গলেই আসবে। এমনকি ধ্বংসোন্মুখ গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যেতেও।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত