আরিফ জেবতিক

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ১৬:৩৩

সিনহার পরিণতি কী শিক্ষা দেয়

বাঙালি এত্তোগুলো কিউট আছে। এসকে সিনহা সাহেব যে অসুস্থ ছিলেন না, তাঁকে জোর করে পদত্যাগ আর বিদেশ যেতে বাধ্য করা হয়েছে-এটা উনার বই প্রকাশের আগে এরা টের পায়নি! তাই এখন হা হুতাশ চলছে।

বাস্তবতা হচ্ছে এস্টাবলিশমেন্ট, বাংলা কথায় ক্ষমতা যাদের হাতে থাকবে, তারা ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে সব চেষ্টা করবে। যে কোনো ধরনের থ্রেট, সেটা যেদিক থেকেই আসুক না কেন, সেই থ্রেটটা তারা সরিয়ে দেবে। যতক্ষণ আপনি থ্রেট না, ততক্ষণ আপনি যা ইচ্ছা করুন, একটা সীমারেখা পর্যন্ত আপনাকে চরতে দেয়া হবে। কিন্তু খুঁটি ছিঁড়তে গেলেই পেছনে পাচুনের বাড়ি। আমরা সেই উপমহাদেশের মানুষ, যেখানে এককালে শাসক তার ভাইয়ের মাথা কেটে কারারুদ্ধ বৃদ্ধ বাবাকে উপহার পাঠিয়েছিল এই ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থেই।

সিনহা সাহেবকে আওয়ামী লীগই চিফ জাস্টিস করেছিল। উনার আরও অনেক গুন ছিল নিশ্চয়ই, তবে সবচাইতে বড় দুটো জিনিস বিবেচনায় ছিল বলে আমার ধারনা, তার প্রথমটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তিনি সঠিক রায় দেয়ার সাহস দেখিয়েছিলেন, এবং আরেকটি বিষয় হচ্ছে তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নৃতাত্ত্বিকতায় সংখ্যালঘু-আওয়ামী লীগ উনাকে বড় পদে দিয়ে এই দুই শ্রেণিকে আত্মবিশ্বাস দিতে চেয়েছিল এবং একটা ভালো মেসেজ দিতে চেয়েছিল। ঐতিহ্যগত ভাবে আওয়ামী লীগ এই দুই সেগমেন্টের ভোটের বড় অংশ পায়, তাঁরা ধরেই নিয়েছিল যে এখান থেকে উঠে আসা লোক তাদের বিরুদ্ধাচারণ করবে না।

কিন্তু সিনহা সাহেবের সাথে আওয়ামী লীগের টানাপড়েন লাগল বিচারপতিদের অভিশংসন করার ক্ষমতা কার হাতে থাকবে, সেই প্রশ্নে। এটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে থাকবে নাকি সংসদের হাতে থাকবে-এটা নিয়ে টেনশন তৈরি হচ্ছিল।

এখানে সিনহা সাহেব একটা বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন। তিনি আদালতে সরকারি উকিলবাবুকে বললেন, ‘পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রীকে ইয়ে (অযোগ্য) করল। সেখানে কিছুই (আলোচনা-সমালোচনা) হয়নি। আমাদের আরও পরিপক্বতা দরকার।’ আমার মতে এই মন্তব্য করার আগে যা চলছিল, সেটা ছিল নিজেদের মাঝে একটু দড়ি টানাটানি। অর্থাৎ ঐ যে আগেই বললাম, 'একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে চরে খাওয়ার' মতো ব্যাপার। কিন্তু এই মন্তব্য আওয়ামী লীগের এন্টেনায় অন্য সিগনাল নিয়ে এলো। সিনহা সাহেবের মনে কী আছে কী নেই, সেটা খতিয়ে দেখার কোনো উপায় নেই, কিন্তু তিনি পাকিস্তানের বিষয়টি চিন্তা করেছেন-এটাই ক্ষমতাসীনদের শেইকি করে তোলার জন্য যথেষ্ট। এর পরিণামে সিনহা বাবুকে যেতেই হতো। এই রিস্ক আওয়ামী লীগ রাখবে না।

এরকম কাণ্ড বিএনপি আমলেও হয়েছিল। বি চৌধুরী প্রেসিডেন্ট হিসেবে সজ্জন একটা ইমেজ তৈরি করেছিলেন, কিন্তু যেই মাত্র তার ভাবসাব দেখে মনে হলো যে তিনি বাঁশের চেয়ে বড় কঞ্চি হওয়াটা মনে মনে ভাবছেন, তখন বিএনপি তাকে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে রেললাইনের উপর দিয়ে দৌড়ানো শুরু করল।

সুতরাং সিনহা সাহেবের পরিণতির এটাই মোদ্দা কথা।

এখন আওয়ামী লীগের একেবারে পেছন সারির এক্টিভিস্টরা যেভাবে ' সিনহা সাহেবের অনেক দুর্নীতির কথা আমরা জানি, হু হু, একটু ওয়েট করেন, বের করে দেখাচ্ছি' টাইপের ভাব ভঙ্গি করছেন, এটা একেবারেই ফালতু একটা স্ট্র্যাটেজি। এগুলো সত্য হোক কি মিথ্যা হোক, পাবলিক এসব বিশ্বাস করবে না। সিনহা সাহেব দুর্নীতি করে নিজের নামে নিজের ব্যাংকে দুই কোটি টাকার চেক নিবেন - উনারে এত বেকুব মনে করে না পাবলিকে। আমার কাছে বরং ওবায়দুল কাদেরের প্রতিক্রিয়া লাইনটা ভালো লেগেছে। উনি ইগনোর করার মুডে চলে গেছেন।

এখন কথা হচ্ছে, সিনহা সাহেবের বইয়ের কোনো প্রতিক্রিয়া কি হবে? আমার ধারনা, মিডিলক্লাসে এই বইয়ের কিছু প্রতিক্রিয়া হবে। কিন্তু সেটা মতিউর রহমান রেন্টুর 'আমার ফাঁসি চাই' ধরনের বিধ্বংসী কিছু হবে না। সিনহা সাহেবের বইটা দ্রুতই অনুবাদ হয়ে বাজারে আসবে, সেটা নিষিদ্ধও হয়ে যেতে পারে-তারপর পাবলিক মুড়ি মুড়কির মতো এই বই সংগ্রহ করবে। কিন্তু রেন্টু ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের যে ক্ষতি করতে পেরেছিলেন, সিনহার বই তেমন আকারের ক্ষতি করতে পারবে না।

সিনহার পরিণতি শিক্ষা দেয়- আমরা যতোই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান বলে কিছু প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করি না কেন, আমাদের দেশে আসলে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এখনও গড়ে উঠতে পারেনি। সবগুলোই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান- সবার সুতোই একই নাটাইয়ে বাঁধা।

আর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলে এই জনপদে গণতন্ত্রের সুফল আমরা অদূর ভবিষ্যতে পাব-এমন কোনো লক্ষণ আপাতত দেখছি না।

  • আরিফ জেবতিক: লেখক, সাংবাদিক।
  • [ফেসবুক থেকে সংগৃহীত]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত