সাগর লোহানী

২৩ আগস্ট, ২০১৯ ১৪:২৩

তারুণ্যের উদ্দামতা রুখে দেওয়ার অধিকার কারও নেই

ফ্যাশন তারুণ্যের অধিকার। চুলদাড়ি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করবে, ছেঁড়াফাটা জিন্স পরবে, পাড়ার রোয়াকে বসে আড্ডা দেবে, উচ্চস্বরে হেঁড়ে গলায় গান গাইবে, হইচই করে পাড়া মাথায় করবে, বাগানের ফুল-ফল চুরি করে দৌড় দেবে, লুকিয়ে সিগারেট ফুঁকবে, পাড়ার বা ক্লাসের মেয়ে বা ছেলেটার দিকে আড় চোখে চেয়ে থাকবে, প্রেমপত্র বা প্রেমমেসেজ দেবে, এমনকি ভাব হলে পার্কে গায়ে গা লাগিয়ে বসে প্রেম করবে, এটাই তো তারুণ্যের প্রকাশ!

আমাদের কৈশোর কিংবা যুবা বয়সে আমরাও এ পথে হেঁটেছি। হেঁটেছি বললে ভুল হবে আসলে দৌড়েছি। কখনও কখনও মাত্রা ছাড়ানো গতিতে। বাবা-মা-অভিভাবক-শিক্ষক এমনকি পাড়ার মুরুব্বীদের কাছেও বকা খেয়েছি। শাসন করেছেন আমাদের তাঁরা সকলেই। বাবা-মার কাছে মারও খেয়েছি কম না। এটাই স্বাভাবিক। এসবের মধ্য দিয়েই জীবনের করণীয়ের সীমারেখা খুঁজে পেয়েছি।

তখন সবে কলেজে ক্লাস শুরু করেছি। রমনা ভবনে জিন্সের থান পাওয়া যাচ্ছে। একটা ট্রাউজার বানিয়ে ফেলেছি বেশ ফ্যাশন মতো। ওটা পরে বের হবো, নানী বললেন, “প্যান্টটা পরে তারপর সেলাই করিয়েছিস? আর কখনও খুলবি না?” আমার জীবনের দ্বিতীয় জিন্স একটা ছাপা চকরা-বকরা মার্কা। বানাবার পরে আমার শরীরের নিম্নাংশ বিশ্বের শত এয়ারলাইন্সের সাইনবোর্ডের আকৃতি ধারণ করলো। মা মুখ বাঁকা করে শুধু বললেন, “ছিঃ, মান ইজ্জত আর রইলো না”।

খুব মনে আছে ঐ চকরা-বকরা এয়ারলাইন্সের নাম সাঁটানো জিন্স পরে ভয়ে ভয়ে কলেজে ঢুকলাম। আমাদের ক্লাসরুম সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান পাশে আর বাঁপাশে Director of Guidance এর রুম। সে সময়ে দুজন DOG -র দায়িত্বে ছিলেন। একজন ফাদার বার্কমেয়ার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিমানবাহিনীর পাইলট ছিলেন অবসরে মিশনারির কাজে যুক্ত হন, বেশ হাসিখুশি কিন্তু যখন শাসন করতেন তখন তাঁর প্রতিটি কথা বুকে শেল হয়ে বিঁধতো। আর অন্যজন আমাদের ইংরেজির শিক্ষক ফাদার বেনাস, ভাল গিটার এবং পিয়ানো বাজাতেন আর অদ্ভুত বাংলায় রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, কেউ তাঁকে কখনও হাসতে দেখেছে বলে মনে হয় না।

দুজনের চোখ এড়াবার প্রচেষ্টায় নিচতলার বারান্দায় পা দেবার মুহূর্তে নিচের অফিস রুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন প্রিন্সিপাল ফাদার পিশোতো, যেন পড়বি পড় মালির ঘাড়ে, সে ছিল দরজার আড়ে! Good morning Father বলবার সাথে সাথে উনি উত্তর দিয়েই আমার প্যান্টের দিকে তাকিয়ে একটু বিস্ময়ের ভ্রুকুঞ্চনসহ আমায় নিয়ে দাঁড় করালেন দোতলায় যাবার সিঁড়ির দুটো ধাপ উপরে, আমি তো অপেক্ষায় একটা নিশ্চিত পানিশমেন্টের, আমার চেয়ে ৬ ইঞ্চি লম্বা মানুষটা আমায় ঘুরিয়েফিরিয়ে প্যান্টে লেখা নামগুলো দেখলেন তারপর আমায় জিগ্যেস করলেন 'ইন্টারফ্লুগ কোন দেশের এয়ারলাইন্স?' উত্তর দিলাম, শুনে সামান্য হেসে, go to your class', বলেই চলে গেলেন ফিজিক্স ল্যাবের দিকে।

প্রমাদ গুনলাম DOG-র ডাক পাবার। কিন্তু কিছুই হল না। কলেজের দু'বছরে এমন কতশত ঘটনা ঘটিয়েছি আমরা যা কিন্তু আজকে ভাবা যায় না। এক বন্ধু সেই ১৯৭৮ এ ফ্যাশনেবল চুলের কাট আর কানে দুল পরত, একজন তো একদিন একটা টিশার্ট পরেই এলো পেছনে লেখা "গেলি"! নটরডেম কলেজের ক্লাস বাঙ করে মধুমিতায় শুক্রবারের মর্নিংশো কিম্বা ক্যান্টিনে তাস পেটা তাও আবার ...... , থাক অত কথা বলে কাজ নেই!

বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি, ততদিনে ভাববাদী ভাবনা অপসৃত হয়েছে সম্পূর্ণ। গোঁফ জোড়া বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে। উপরের ঠোঁট ছাপিয়ে নেমেছে অনেকটা। ফ্যাশন ধীরে ধীরে স্টাইলের রূপ নিচ্ছে। একদিন খাবার টেবিলে মা বললেন, “তোর বাপী বলেছে, সাগরের ঐ ‘মেথর সর্দার’ মার্কা গোঁফটা কাটতে বলো”। আমি শুনলাম, মুচকি হেসে খাওয়া শেষ করলাম। মা বুঝলেন ঐ গোঁফ অমনই থাকবে।

আসলে আমাদের সময়ে অভিভাবক-শিক্ষকদের শাসনের ছড়িটা আমাদের অন্তঃস্থ ছিল, তাই সীমা নির্ধারণে ভুল হয়নি।

কিন্তু আজ যখন দেখি চুলের কাট কেমন হবে সে নির্দেশনা দেয় পুলিশ আর জনপ্রতিনিধি পার্কে বসে থাকা তরুণ-তরুণীকে অপদস্থ, লাঞ্ছিত করে তখন খুব কষ্ট পাই। আমাদের সন্তানকে এমত অসম্মান করবার অধিকার তো আমরা পুলিশ বা প্রশাসনকে দেইনি।

কী পোশাক পরবে, কী চুলের কাট হবে, তা দেখার দায়িত্ব আপনার নয়। আপনার কাজ অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার রোধ করা। ওরা কোনো ইভ টিজিং করছে কিনা, চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ, হত্যা বা মাদকে আসক্ত হচ্ছে কিনা তা দেখা আপনার দায়িত্ব।

পুলিশ তাদের এই (অ)কাজের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেছে, 'কেউ উদ্ভট পোশাক পরলে, উদ্ভট স্টাইলে চুল কাটলে, যা দৃষ্টিকটু ও অস্বাভাবিক, সেটি তার জীবনযাত্রায় অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।'

বাহ, এদেশের পুলিশ মনস্তত্ববিদ হয়ে হয়ে উঠেছে! ওনারা সাইকিয়াক্ট্রিক সিদ্ধান্ত দিলেন যে 'এ প্রবণতা থেকেই নয়ন বন্ডদের জন্ম হয়'।

তা পুলিশ সাহেব, লক-আপে সারারাত ধরে যে পুলিশেরা ধর্ষণ করে তাদের চুলের কাট কেমন থাকে? নির্যাতিত নারীর জবানবন্দি থানায় ভিডিও করে যখন ভাইরাল করা হয় তখন ঐ ওসির পোশাক কেমন থাকে? এরাও কি তবে কোন '.... বন্ড' হয়? এমনতর অসংখ্য ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না।

আসলে আপনাদের অবদমিত আকাঙ্ক্ষার ছায়া তরুণদের মাঝে দেখলে আপনাদের জ্বালা ধরে। আর তখনই এমনতর উদ্ভট কাজে আপনার মনোনিবেশ ঘটে এতে দুটো লাভ হয় আপনাদের।

প্রথমত, আপনাদের জীবনে যা আপনারা করতে পারেননি তা অন্যদের করতে না দিয়ে অসামান্য তৃপ্তি লাভ; দ্বিতীয়ত, আপনাদের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, অসততা থেকে সাধারণ মানুষের চোখ অন্যদিকে সরিয়ে রাখা।

আপনারা যা করছেন চুল কেটে, অপমান করে সেটাই হয়তো এই তরুণদের পুলিশ/প্রশাসনের প্রতি নেতিবাচক জেদের সৃষ্টি করছে। আর এ থেকে তারা সমাজের কাছে অপরাধ না করেও 'অপরাধী' বনে যাচ্ছে। ওদের তারুণ্যের ইগোতে আঘাত করে আপনারাই ওদের অপরাধে প্রবৃত্ত হবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। মনে রাখবেন, অযাচিত বাঁধ দুকূল ভাসিয়ে দেয়।

জনসাধারণের স্বাধীনতা খর্ব করে নয় অবাধ স্বাধীনতার সুস্থতা বজায় রাখতে মানুষের মাঝে নিরাপত্তার মানসিক আবহ তৈরি করুন, এতে পুলিশের লাভ, সমাজের লাভ, রাষ্ট্রের লাভ হবে।

  • সাগর লোহানী: সম্পাদক ও প্রকাশক, বাঙালীয়ানা

আপনার মন্তব্য

আলোচিত