রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

০৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:১৭

আকাঙ্ক্ষা

এই যে ছাত্রেরা এখানে আমাকে আহ্বান করেছে এটা আমার আনন্দের কথা। ছাত্রদের মধ্যে আমার আসন আমি সহজে গ্রহন করতে পারি। সে কিন্তু গুরুরূপে নয়, তাদের কাছে এসে, তাদের মধ্যে বসে।

কিন্তু আমার বিপদ এই যে, হঠাৎ আমাকে বাইরে থেকে বৃদ্ধ বলে ভ্রম হয়, তাই যাদের বয়স অল্প তারা যখন আমাকে ডাকে, কাছে ডাকে না, আমার জন্যে  তফাতে উচ্চ করে মঞ্চ বাঁধে। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাবার জন্যেই লোকালয়ের বাইরে আমি একটা জায়গা করেছি সেখানে ছেলেদের আমিই কাছে ডেকেচি। সে কেবল ছেলেদের উপকারের জন্যে নয়, আমার নিজের উপকারের জন্যে। উপকারটা কি একটু বুঝিয়ে বলি।

মানুষের মনে অহঙ্কার পদার্থ প্রবল। সেইজন্যে যখন তার বয়স বাড়ে তখন সে মনে করে সেই বয়স বাড়ার মধ্যেই বুঝি তার কারণ আছে। বিশেষতঃ তখন যদি সে বুড়োদেরই সঙ্গ ধরে থাকে তাহলে তার সেই অহঙ্কারটা আরো বেড়ে ওঠে। তখন সে মস্ত কথা ভুলে যায় যে যেটাকে সে বড়ো বলছে সেইটাই তার  হ্রাস হয়ে যাওয়া। যার ভবিষ্যৎ কমে এলো অতীতের বাড়তির বড়াই করে তার ফল কি? বৃদ্ধই যদি সংসারে গৌরব করবার জিনিষ তা হলে বৃদ্ধকে বরখাস্ত করবার জন্যে ভগবান এত তাড়া করতেন না।

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, বুড়োদের ওপর বাঁধা হুকুম রয়েছে জায়গা ছেড়ে দেবার জন্যে। নকীব হাঁকছে, সরে যাও, সরে যাও। কেনরে বাবু ষাট, পয়ষট্টি বছরের পাকা আসন ছাড়ব কেন? ঐ যে আসছেন মহারাজা, ঐ যে কুমার, ঐ যে কিশোর। ভগবান কেবলি ফিরে ফিরে তরুণকে মর্ত্যরে সিংহাসনে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তাঁর কি কোনো মানে নেই? তার মানে এই যে, তিনি তাঁর সৃষ্টিকে পিছনে বাঁধা পড়ে থাকতে দেবেন না। নূতন মন নূতন শক্তি বারে বারে নূতন করে তাঁর কাজ যদি না আরম্ভ করে, তাহলে অসীমের প্রকাশ বাধা পাবে। অসীমের ত জরা নেই। এই জন্যে বুদ্বুদের মত জরা কেবলি ফেটে মিলিয়ে যায়, আর পৃথিবীর কোল জুড়ে তরুণ ফুলের মধ্যে তরুণ প্রভাতের আলোয় দেখা দেয় তরুণের দল। ভগবান কেবলি নূতনকে বাঁশি বাজিয়ে ডাকছেন, আর তারা দলে দলে আসচে, আর সমস্ত জগৎ আদর করে তাদের জন্যে দ্বার খুলে দিচ্চে।

ভগবানের সেই আহ্বান শোনবার জন্যেই শিশুদের মধ্যে, বালকদের মধ্যে আমরা বসি। তাতে আমার একটা মস্ত উপকার হয়, অন্যান্য বৃদ্ধদের মতো আমি নবীনকে অশ্রদ্ধা করিনে, ভাবীকালের আশার উপর আমার অতীতকালে আশঙ্কার বোঝা চাপিয়ে দিইনে। আমি বলি ‘ভয় নেই! পরীক্ষা কর, প্রশ্ন কর, বিচার কর, সত্যকে ভেঙে দেখতে চাও আচ্ছা আঘাত কর। কিন্তু সামনের দিকে এগোও।” ভগবানের বাঁশির ডাক আমারো বুকের মধ্যে বেজে ওঠে। তখন আমি বুঝতে পারি যে, বৃদ্ধের সর্তক বিজ্ঞতা বড় সত্য নয়, নবীনের দুঃসাহসিক অনভিজ্ঞতা তার চেয়ে বড় সত্য। কেননা এই অনভিজ্ঞতার ঔৎসুক্যের কাছেই সত্য বারে বারে আপন নূতন শক্তিতে নূতন মূর্ত্তিতে প্রকাশ পান; এই অনভিজ্ঞতার অক্ষুন্ন বলেই পুরাতনের পর্ব্বতপ্রমাণ বাঁধা ভাঙে এবং অসাধ্য সাধন হতে থাকে।

বৃদ্ধ সেজে আমি তোমাদের উপদেশ দিতে চাইনে। আমি কেবলমাত্র তোমাদের এই কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে তোমরা নবীন। তোমরা যে বার্ত্তা বহন করে এনেছ সেই বার্ত্তা তোমরা ভুললে চলবে না। এই পৃথিবী থেকে সকল প্রকার জীর্ণতাকে তোমরা সরিয়ে দিতে এসেছ; কেননা জীর্ণতাই আবর্জ্জনা, জীর্ণতা যাত্রাপথের বাঁধা। এই জীর্ণতাকে যারা আপন বলে মমতা করে তারাই সত্যিকারের বৃদ্ধ। পৃথিবীতে তাদের কাজ ফুরিয়েচে, মনিব তাদের জবাব দিয়েচেন। তারা সরে পড়বে। কিন্তু তোমরা নবীন, তোমাদেরই হাতে পৃথিবীর ভার নূতন করে পড়েচে, তোমাদের ভবিষ্যৎকে আচ্ছন্ন হতে দিয়ো না, পথ পরিষ্কার কর।

কোন পাথেয় নিয়ে তোমরা এসেচ? মহৎ আকাঙ্ক্ষা। তোমারা বিদ্যালয়ে শিখবে বলে ভর্ত্তি হয়েচে। কি শিখতে হবে ভেবে দেখ। পাখী তার বাপ মায়ের কাছে কি শেখে? পাখা মেলতে শেখে, উড়তে শেখে। মানুষকেও তার অন্তরের পাখা মেলতে শিখতে হবে, তাকে শিখতে হবে কি করে বড় করে আকাঙ্ক্ষা করতে হয়। পেট ভরাতে হবে। এ শেখাবার জন্যে বেশী সাধনা দরকার নেই; কিন্তু পুরোপুরি মানুষ হতে হবে এই শিক্ষার জন্যে যে অপরিমিত আকাক্সক্ষার দরকার তাকেই শেষ পর্য্যন্ত জাগিয়ে রাখবার জন্যে মানুষের শিক্ষা।

এই যুগে সমস্ত পৃথিবীতে য়ুরোপ শিক্ষকতার ভার পেয়েচে। কেন পেয়েচে? গায়ের জোরে আর সব হতে পারে কিন্তু গায়ের জোরে গুরু হওয়া যায় না। যে মানুষ গৌরব পায় সেই গুরু হয়। যার আকাক্সক্ষা বড় সেইতো গৌরব পায়।  য়ুরোপে বিজ্ঞান, ভূগোল, ইতিহাস প্রভৃতি সম্বন্ধে বেশী খবর রেখেচে বলেই আজকের দিনে মানুষের গুরু হয়েচে একথা সত্য নয়। তার আকাঙ্ক্ষা বৃহৎ, তার আকাঙ্ক্ষা কোনো বাধাকে মানতে চায় না, মৃত্যুকেও না। মানুষের যে বাসনা ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্যে, সেটাকে বড় করে তুলে মানুষ বড় হয় না, ছোটই হয়ে যায়; সে যেন খাঁচার ভেতরে পাখীর ওড়া, তাতে পাখীর সার্থকতা হয় না। কিন্তু জ্ঞানের জন্যে আকাঙ্ক্ষা প্রাকৃতিক শক্তিগুলিকে আবিষ্কার করে, তাকে মানুষের অধিকারে আনবার জন্যে আকাক্সক্ষা, যাতে মানুষ মরুকে জয় করে ফসল পায় রোগকে জয় করে স্বাস্থ্য পায় দূরত্বকে জয় করে নিজের গতিপথ অবারিত করে, তাতেই মানুষের মনুষ্যত্ব প্রকাশ পায়। তাতেই প্রমাণ হয় যে, মানুষের জাগ্রত আত্মা পরাভবকে বিশ্বাস করে না; কোনো অভাব দুঃখ দুর্গতিকেই সে অদৃষ্টের হাতের চরম মার মনে করে মাথা পেতে নিতে অপমান বোধ করে; সে জানে যে তার দুঃখ মোচন তার নিজেরই হাতে, তার অধিকার প্রভুত্বের অধিকার। য়ুরোপ এমনি করে আকাক্সক্ষার ‘পাখা’ বড় করে মেলতে পেরেচে বলেই আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে শিক্ষা দেবার অধিকার সে পেয়েচে। সেই শিক্ষাকে আমরা যদি পুঁথির বুলি শিক্ষা, কতকগুলি বিষয় শিক্ষা বলে ক্ষুদ্র করে দেখি তাহলে নিজেকে বঞ্চিত করলুম। মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সমস্তই তার অধীনে। এই মনুষ্যত্ব হচ্ছে আকাঙ্ক্ষার ঔদার্য্য, আকাঙ্ক্ষার দুঃসাধ্য অধ্যবসায়, মহৎ সংকল্পের দুর্জ্জয়তা।

য়ুরোপের লোকালয়ে য়ুরোপের মানুষ বিপুল আকাঙ্ক্ষাকে নিয়তই নানাক্ষেত্রে প্রকাশ করচে এবং জয়ী করচে, সেই দেশব্যাপী মহৎ উদ্যমের সঙ্গে সঙ্গে তাদের শিক্ষা। তাদের বিদ্যালয়ে শিক্ষা এবং তাদের জীবনের শিক্ষা পাশাপাশি  সংলগ্ন। এমন কি যে বিদ্যা তারা শিক্ষকদের হাত থেকে গ্রহন করেচে সে বিদ্যা তাদের আপন দেশেরই সাধনার ধন, তার মধ্যে শুধু ছাপার অক্ষর নেই। তাদের আপন দেশের লোকের কঠিন তপস্যা আছে। এই কারণে সেখানকার ছাত্র শুধু যে কেবল শিক্ষার বিষয়কে বইয়ের পাতায় দেখেচে আর গ্রহন করেচে তা নয়; মানবাত্মার কর্তৃত্ব, তার দাসত্ব, গ্রষ্টত্ব চারিদিকেই দেখচে। এতেই মানুষ আপনাকে চেনে এবং মানুষ হতে শেখে।

যে দেশে বিদ্যালয়ে কেবল দেখতে পাই, ছাত্র নোটবুকের পত্রপুট মেলে ধরে বিদ্যার মুষ্টিভিক্ষা করচে, কিংবা পরীক্ষার পাশের দিকে তাকিয়ে টেক্সট্ বইয়ের পাতায় পাতায় বিদ্যার উঞ্ছবৃত্তিতে নিযুক্ত, যে দেশে মানুষের বড় প্রয়োজনের সামগ্রী মাত্রেই পরের কাছে ভিক্ষা করে সংগ্রহ করা হচ্ছে, নিজের হাতে লোকে দেশকে কিছুই দিচ্চে না - না স্বাস্থ্য, না অন্ন, না জ্ঞান, না শক্তি; যে দেশে কর্ম্মের ক্ষেত্র সংকীর্ণ কর্ম্মের চেষ্টা দুর্ব্বল, যে দেশে শিল্পকলায় মানুষ আপন প্রাণমন আত্মার আনন্দকে নব নব রূপে সৃষ্টি করচে না; যে দেশে অভ্যাসে বন্ধনে সংস্কারের জালে মানুষের মন এবং অনুষ্ঠান বদ্ধ বিজড়িত; যে দেশে প্রশ্ন করা, বিচার করা নূতন করে চিন্তা করা ও সেই চিন্তা ব্যবহারে প্রয়োগ করা কেবল হাতের যে নেই তা নয় সেটা নিষিদ্ধ এবং নিন্দনীয়, সেই দেশে মানুষ আপন সমাজে আত্মাকে দেখতে পায় না, কেবল হাতকড়া, পায়ের বেড়ি এবং মৃতযুগের আবর্জ্জনারাশিকেই চারিদিকে দেখতে পায়, জড় বিধিকেই দেখে, জাগ্রত বিধাতাকে দেখে না।

যদি মূলের দিকে তাকিয়ে দেখি তা হলে দেখব আমাদের যে দারিদ্র সে আত্মারই দারিদ্র্য। মানবাত্মারই অপমান চারিদিকে নানা অভাব নানা দুঃখরূপে ছড়িয়ে রয়েছে। নদী যখন মরে যায় তখন দেখতে পাই গর্ত্ত এবং বালি; সেই শুণ্যতা সেই শুষ্কতার অস্তিত্ব নিয়ে বিলাপ করবার কথা নেই, আসল বিলাপের কারণ নদীর সচল ধারার অভাব নিয়ে। আত্মার সচল প্রবাহ যখন শুষ্ক তখন আচারের নীরস নিশ্চলতা।

সৃষ্টিকে যে সত্য বহন করচে সে সত্য সচল। সে নিরন্তর অভিব্যক্তির ভিতর দিয়ে বিকাশের নব নব পর্ব্বে উর্ত্তীণ হচ্চে । তার কারণ, সত্য অসীমকে প্রকাশের জন্যই। যেখানেই তাকে কোন একটা সীমার বাঁধ বেঁধে চিরকালের মত বদ্ধ করবার চেষ্টা করা হয় সেখানেই তাকে ব্যর্থ  করা হয়। মানবাত্মার ধারা নিয়ত এই অসীমের দিকে ধাবিত হচ্চে বলেই  কেবলই নব নব রূপে সৃষ্টি বিকাশ করতে সে অগ্রসর হচ্চে। আত্মার পক্ষে “স্বাভাবিক জ্ঞানবল ক্রিয়া চ;” জ্ঞানের পথে বলের পথে নিত্য সক্রিয়তাই তার স্বভাব।  বদ্ধ সংসারের বেড়ি হাতে পায়ে পরিয়ে দিয়ে তার এই ক্রিয়া বন্ধ করে দেওয়াই তাকে তার স্বভাব থেকে বিচ্যুত করা । এই নিষ্ক্রিয়তাকে মুক্তি বলে না, এইটেই তার বন্ধন।

আমাদের দেশে কেবলই এই বাণী শুনতে পাই, যা চলবে না সেইটেই শ্রেষ্ঠ, জীবনের চেয়ে মৃত্যুটাই বড়। এর আর কোন মানে নেই এর মানে অভ্যস্ত আচারের প্রতি, জড় ব্যবস্থার প্রতি আস্থা। সেই আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা একেবারেই চলে গিয়েচে যে আত্মার পক্ষে “স্বাভাবিকী জ্ঞানবল ক্রিয়াচ।” কিন্তু সত্য শিক্ষা মানুষকে কি বলচে ? “আত্মানং বিদ্ধি।”  আত্মাকে জান। “নাল্পে সুখমস্তি , ভূমৈব বিজিজ্ঞাসিতব্য।” অল্পে সুখ নেই, ভূমাকেই জান। এই আত্মাকে জানতে হলে ভূমাকে জানতে হলে পৈতৃক সঞ্চয়টীকে বাক্সে বন্ধ করে দিবানিদ্রা দিলে চলবে না। কেবলই চলতে হবে, সৃষ্টি করতে হবে। ভগবান নিয়ত সৃষ্টি করেই আপনাকে জানচেন, মানবাত্মাও কেবল তেমনি করেই আপনাকে জানতে পারে, মৃত পিতামহের কাছে কিংবা জীবিত প্রতিবেশীর কাছ ধার করে নয়, ভিক্ষা করে নয়।

অতএব, প্রকৃত শিক্ষা জ্ঞান সমুদ্রের যে বন্দরে নিয়ে যাচ্চে, সে বন্দর কোথায়? যেখানে এই উপদেশের সার্থকতা আছে - “আত্মানং বিদ্ধি, ভূমৈব বিজিজ্ঞাসিতব্য।” মানুষ যেখানে সুমহৎকে পায় অর্থাৎ মানুষ যেখানে সেই ত্যাগের শক্তি পায় যে ত্যাগের দ্বারা সে সৃষ্টি করে, যে শক্তির দ্বারা সে মৃত্যুকে অতিক্রম করে। কিন্তু আজকের দিনে ভারতবর্ষ বিদ্যা সমুদ্রে এই যে মহভিড় করা খেয়ায় পাড়ি দিচ্চে সামনের কোন বন্দর সে দেখতে পাচ্চে বলত? দারোগাগিরি, কেরাণীগিরি, ডেপুটীগিরি। এইটুকু মাত্র আকাক্সক্ষা নিয়ে এতবড় সম্পদের সামনে এসে দাঁড়িয়েচে এর লজ্জাটা এতবড় দেশ থেকে একেবারে চলে গেছে। এরা বড় করে চাইতেও শিখলে না? অন্য দারিদ্র্যের লজ্জা নেই কিন্তু আকাক্সক্ষার দারিদ্রের মত লজ্জার কথা মানুষের পক্ষে আর কিছুই নেই। কেন না, অন্য দারিদ্র বাহিরের, এই আকাক্সক্ষার দারিদ্র আত্মার।

এই জন্য আজ আমি তোমাদের এই কথাটুকু বলতে দাঁড়িয়েচি - আকাঙ্ক্ষাকে বড় কর। শক্তি কারো বড় কারো ছোট - কিন্তু আকাঙ্ক্ষাকে আমরা ছোট করবো না। আকাঙ্ক্ষাকে বড় করার মানেই আরামকে অবজ্ঞা করা, দুঃখকে স্বেচ্ছাপূর্ব্বক গ্রহণ করা। এই দুঃখকে গৌরবে বহন করবার অধিকারই মানুষের। আমাদের শাস্ত্রে একটা কথা বলে, ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।” এই সিদ্ধিটা কিসের? শুধু বাইরের নয় - এই সিদ্ধি হচ্চে আপনাকে উপলব্ধি করা, সেই উপলব্ধি যা কর্ম্মে আপনাকে প্রকাশ করে।

আমাদের আকাঙ্ক্ষাকে ছোটকাল থেকেই কোমর বেঁধে আমরা খর্ব্ব করি। অর্থাৎ সেটাকে কাজে খাটাবার আগেই তাকে খাটো করে দিই। অনেক সময়ে বড় বয়সে সংসারের ঝড়ঝাপটের মধ্যে পড়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষার পাখা জীর্ণ হয়ে যায়, তখন আমাদের বিষয় বুদ্ধি অর্থাৎ ছোট বুদ্ধিটাই বড় হয়ে ওঠে কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, শিশুকাল থেকেই আমরা বড় রাস্তায় চলবার পাথেয় ভার হালকা করে দিই। নিজের বিদ্যালয়ে ছোট ছোট বালকদের মধ্যেই সেটা আমি অনুভব করি। প্রথমে কয় বৎসর একরকম  বেশ চলে কিন্তু ছেলেরা যেই থার্ডক্লাসে গিয়ে পৌঁছায় অমনি বিদ্যা অর্জ্জন সম্বন্ধে তাদের বিষয় বুদ্ধি জেগে ওঠে । অমনি তারা হিসাব করে শিখতে বসে। তখন থেকে তারা বলতে আরম্ভ করে আমরা শিখব না আমরা পাশ করব । অর্থাৎ যে পথে যথাসম্ভব কম জেনে যতদূর সম্ভব বেশী মার্ক পাওয়া যায় আমরা সেই পথে চলবো।

এই ত দেখচি শিশুকাল থেকেই ফাঁকি দেবার বুদ্ধি অবলম্বন। যে জ্ঞান আমাদের সত্যের দিকে নিয়ে যায়, গোড়াথেকেই সেই জ্ঞানের সঙ্গে অসত্য ব্যবহার। এর কি অভিশাপ আমাদের দেশের উপর লাগচে না? এই জন্যেই কি জ্ঞানের যজ্ঞে আমরা ভিক্ষার ঝুলি হাতে বাইরে বসে নেই? আপিসের বড় বাবু হয়েই কি আমাদের এই অপমান ঘুচবে? আজকের দিনে দেশের লোকেরা-যুবকেরা পর্য্যন্ত বলচে যে ঋষিরা যা করে গেচেন তার উপর আমাদের কিছু ভাববার নেই, কিছুই করবার নেই, এর মানে বুঝতে পেরেচ? এইটেই ঘটেচে আমাদের কর্ত্তৃক প্রবঞ্চিত বিদ্যাদেবীর অভিশাপে। যে সমাজে কিছুই ভাববার নেই, কিছুই করবার নেই, সমস্তই ধরা বাঁধা সে সমাজ কি বুদ্ধিমান শক্তিমান মানুষের বাসের যোগ্য? সে সমাজ ত মৌমাছির চাক বাঁধবার জায়গা। দশ পনেরো বছর ধরে শিক্ষা লাভ করে আপন চিত্ত শক্তির পক্ষে এমন অদ্ভূত অপমানকর কথা অন্য কোন দেশে এতগুলো লোক এত বড় নিলর্জ্জ অহঙ্কারের সঙ্গে বলতে পারেনি। সকল বড় দেশে যে বড় আকাঙ্ক্ষা মানুষকে আপন শক্তিতে আপন ভাবনায় আপন হাতেই সৃষ্টি করবারই গৌরব দান করে, আমরা সেই আকাঙ্ক্ষাকে কেবল যে বিসর্জ্জন করেচি তা নয়, দল বেঁধে লোক ডেকে বিসর্জ্জন করেচি তা নয়, দল বেঁধে লোক ডেকে বিসর্জ্জনের ঢাক পিটিয়ে সেই তালে তান্ডব নৃত্য করচি।

কিন্তু আপন দুর্গতি নিয়ে খুব জোরে অহঙ্কার করলেই যে সেই দুর্গতির বিষ মরে এ্ই আশা যেন না করি। আকাক্সক্ষাকে ছোট করবো, সাধনাকে সংকীর্ণ করবো, কেবল অহঙ্কারকেই বড় করে তুলব এত, আপনাকে তেমনি ফাঁকি দেওয়া যেমন ফাঁকি শিক্ষা এড়িয়ে পরীক্ষায় মার্কা পেয়ে নিজেকে বিদ্বান মনে করা। যেখানে ফল দেখা যায় সেখানেই চেয়ে দেখি ডিগ্রি পেলুম, চাকরি করলুম টাকা হল, কিন্তু জ্ঞানের ঋণ, জ্ঞানের ক্ষেত্রে, শোধ করতে পারলুম না, সেখানে সমস্ত বিশ্বের কাছে মাথা হেট করে চেয়ে রইলুম। তোমাদের আমি দূর থেকে উপদেশ দিতে আসিনি। স্বদেশের এতদিনকার যে পুঞ্জীভূত লজ্জা, যে লজ্জাকে আমরা অহঙ্কারের গিল্টি করে গৌরব বলে চালাতে চেষ্টা করচি সেইটেই ছদ্ম পরিচয় ঘুচিয়ে তোমাদের কাছে উৎঘাটিত করে দেখাতে চাই। তোমাদের বয়স কাঁচা, তোমাদের বয়স তাজা, তোমাদের উপর এই লজ্জা দূর করবার ভার। তোমরা ফাঁকি দেবে না ও ফাঁকিতে ভুলবে না, তোমরা আকাক্সক্ষাকে বড় করবে, সাধনাকে সত্য করবে। তোমরা যদি উপরের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়িয়ে প্রস্তুত হও তা হলে সকল বড় দেশ যে ব্রত নিয়ে বড় হয়েচে আমরাও সেই ব্রত নেব। কোন ব্রত ? দান ব্রত।

যখন না দিতে পারি তখন কেবল হয়ত ভিক্ষা পাই, যখন দিতে পারি তখন আপনাকে পাই। যখন দিতে পারব তখন সমস্ত পৃথিবী আগবাড়িয়ে এসে বলবে,“এসো, এসো, বোস।” তখন জোড় হাত করে একথা কাউকে বলতে হবে না,“ আমাকে মেরো না, আমাকে বাঁচিয়ে রাখো।” তখন সমস্ত মানুষ আপন গরজেই আঘাত হতে আমাদের বাঁচাবে। ছোট চিন্তা মনেও স্থান দিতে নেই, ছোট প্রার্থনা মুখেও উচ্চারণ করতে নেই।  “ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমস্তি।” সেই ভূমাকে যদি অন্তরে ভুলি এবং বাহিরে লক্ষ্য না করি তা’হলে অন্য যে কোন সুখ সুবিধা আমরা চেয়ে চিন্তে যোগাড় করিনে কেন না, তাতে আমাদের দেশের সর্ব্বনাশ হবে।

* ১৩২৬ বাংলার ১৮ই কার্ত্তিক (১৯১৯ সালের ৭ই নভেম্বর) শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজ হোস্টেলে প্রদত্ত রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত