মো. মুদ্দত আলী

১৯ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:৫২

কিংবদন্তি নেতা ফরিদ গাজী

হবিগঞ্জ-১ (বাহুবল- নবীগঞ্জ) আসনের বার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, সাবেক প্রাথমিক গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী ছিলেন একজন কিংবদন্তি জাতীয় নেতা। আজ (১৯ নভেম্বর) তার ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।

শৈশবকাল থেকে তিনি জনসাধারণের কল্যাণে কাজ করে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। তিনি জমিদার পরিবারের হয়েও জমিদারী প্রথাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যা মানুষ কোনদিন ভুলবে না। ফরিদ গাজীর বর্ণাঢ্য জীবনে রয়েছে অনেক অজানা কাহিনী। নির্বাচনী এলাকাসহ সিলেট তথা সারা দেশে সুনাম অর্জন করেন তিনি।

দেওয়ান ফরিদ গাজী প্রথম জীবন কেটেছে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, প্রতিরোধ, অতঃপর বিজয়ের মধ্য দিয়ে সফলতা ও এনেছেন ঘরে। ২য় জীবন কেটেছে দেশ পুনর্গঠনে ও গণতন্ত্রের মঞ্চ বিনির্মাণে। প্রশ্ন জাগে, কেন এই ত্যাগ? অবশ্যই তার উত্তম ইতিহাসের ধূসর পাতায় রয়েছে এবং তিনি নিজেও এখন শুধু ইতিহাস। এতদিন ছিলেন তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের আলোময় সাক্ষী হিসেবে। তরুণ বয়সের তাজা রক্তের স্রোতে মাতৃভূমিকে টেনে আনেন ‘পাকিস্তান’ এ। কিন্তু সাধের পাকিস্তানে অচিরেই মোহ ভঙ্গ হয়ে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক পন্থায় নতুন লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরিতে সঙ্গী হন অনেক নেতার। পুরো পাকিস্তানি আমল তিনি ছিলেন প্রতিবাদী ও সংগ্রামী। এই সত্য উপলব্ধি করেই জনগণ তাকে ‘নেতা’ বানিয়েছেন ভোটের মাধ্যম তা ও বহুবার।

দেওয়ান ফরিদ গাজী হযরত শাহজালাল (র:) এর অন্যতম সফরসঙ্গী হযরত তাজউদ্দিন কোরেশী (রা:)-এর ১৬তম বংশধর ছিলেন। তিনি ১৯২৪ সালে ১ মার্চ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার দিনারপুর পরগনার দেবপাড়া গ্রামে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দেওয়ান ফরিদ গাজী ৬ ছেলে ২ মেয়ে সন্তানের জনক।

তিনি যে সব আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, ক. আসামের বাঙাল খেদাও আন্দোলন, খ. লাইন প্রথার বিলোপ, গ. ৪৭ এর ঐতিহাসিক গণভোট, ঘ. ৫২ ভাষা আন্দোলন, ঙ. ৬৬র ৬ দফা আন্দোলন, চ. ৬৯ এর ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, ছ. ৭০-এর নির্বাচন ৭১ এর মহান মুক্তিযোদ্ধা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, জ. ৯৪ সিলেট বিভাগ আন্দোলন সহ দেশের সবকটি ঐতিহাসিক কর্মকাণ্ডে তিনি ছিলেন প্রথম কাতারে।

স্কুল অধ্যয়ন কালেই ১৯৪২ সালে ‘কুইট ইন্ডিয়া’ ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে নিজেকে যুক্ত করেন। কলেজ জীবনে আসাম মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সিলেট এম.সি কলেজ শাখার সাধারণ সম্পাদক ও প্রাদেশিক শাখার সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি সিলেট আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি এ পদে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি সিলেট আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে সিলেট সদর আসনের এমপি ছিলেন। তিনি একাধিক বার সরকারের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করেন।

১৯৭০ সালে সামরিক শাসনের অধীনে দেশে সাধারণ নির্বাচন হলে তিনি সিলেট সদর আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির আহবানে আন্দোলনে যোগদান করেন। পরে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে অগ্রসৈনিক ছিলেন। ১৯৫২-১৯৫৫ সন পর্যন্ত সিলেটের সাপ্তাহিক যুগভেরী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় শান্তি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তিনি এ সময় সিলেট গভর্নমেন্ট হাইস্কুল ও রসময় মেমোরিয়াল হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

১৯৫১ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সিলেট কমিটি গঠনে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে তদানীন্তন সিলেট মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক হন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে ৪নং ও ৫নং সেক্টরে বেসামরিক উপদেষ্টার ও উত্তরপূর্ব রণাঙ্গনের আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি সিলেট আসন থেকে বিপুল ভোটে প্রথম জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারে ১ম স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী পরে বাণিজ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি হবিগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং জাতীয় সংসদে ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য ও ২০০৮ সালের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

একাত্তরের নয় মাস তার নির্ঘুম রাত জাগা এবং অনাহারে অর্ধাহারে ‘স্বাধীনতা’র জন্য দিগ্বিদিক ছুটে চলাকে বাহুবল- নবীগঞ্জ সিলেটবাসী তথা বাঙালি জাতি কখনো ভুলবেনা। ইতিহাসের বরপুত্র হিসেবে তিনি বার বার আমাদের প্রেরণার উৎস হিসেবে থাকবেন। সত্যই তিনি জনগণের নেতা। দেওয়ান ফরিদ গাজী মানুষের কল্যাণেই জীবনের আরাম-আয়েশ ভুলে সারাজীবন কাজ করেছিলেন। অনেক পরিকল্পনা রেখেছিলেন উন্নয়নের কাজে হাত দিতে। মৃত্যুর পথযাত্রী হিসেবে ও খোঁজ নিয়েছিলেন এলাকার মানুষের। কিন্তু আমরা দেওয়ান ফরিদ গাজীকে চির-বিদায় দিতে হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সৎ যোগ্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানবপ্রেমী মানুষ।

আজ থেকে ৯ বছর পূর্বে যদিও প্রিয় নেতাকে হারিয়ে নির্বাক হয়েছিলাম সেই মুহূর্তে অনেক স্মৃতিগুলো হারিয়ে ফেলেছিলাম। তাই অদূর ভবিষ্যতে এলাকাবাসীর সামনে ধারাবাহিক স্মৃতিগুলো প্রকাশ করব। গাজী সাহেবের ৯তম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রিয় নেতার আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

  • মো. মুদ্দত আলী : কেন্দ্রীয় তাঁতী লীগের সদস্য; সভাপতি হবিগঞ্জ জেলা তাঁতী লীগ; সাবেক চেয়ারম্যান পুটিজুরি ইউনিয়ন পরিষদ; সাবেক ভিপি সিলেট সরকারি বাণিজ্যিক মহাবিদ্যালয়; সাংগঠনিক সম্পাদক সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম মুক্তিযোদ্ধা-৭১’ হবিগঞ্জ জেলা।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত