জাহাঙ্গীর হোসাইন চৌধুরী

১০ ডিসেম্বর, ২০১৯ ১০:৩৮

মানবাধিকার দিবস ও বাস্তবতা

মানুষের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা এবং মানবতাবোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে ঘোষিত হয় সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, ১৯৫০ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩১৭তম প্ল্যানারি সভায় ৪২৩(ভি) প্রস্তাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিবছর ১০ ডিসেম্বর যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব মানবাধিকার দিবস।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে, চলতি বছর ৭১তম বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালিত হচ্ছে। মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সরকার, মানবাধিকার সংগঠন ও সামাজিক সংগঠনগুলো। এই দিবস পালনে যতটা থাকে আনুষ্ঠানিকতা তার সামান্যতম অংশও বাস্তবায়িত হলে বিশ্ব থেকে নির্বাসিত হতো বিচার বহির্ভূত হত্যা, গুম, শিশু ও নারী নির্যাতন, শ্রমিক নির্যাতন, বর্ণবৈষম্য, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ধর্মীয় উগ্রতা, সন্ত্রাস, রাহাজানিসহ হাজারো ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধ।

মানবতা ও মানবাধিকারের বিচারে বর্তমান বিশ্ব এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, দেশে দেশে চলছে গণহত্যা আর জাতিগত নিধনযজ্ঞ। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর দেশটির সেনাবাহিনী ও সংঘবদ্ধ বৌদ্ধ অধিবাসীদের অভিযান এর দৃষ্টান্ত। একদশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের একটার পর একটা দেশে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অবৈধ যুদ্ধ, এসব যুদ্ধে মারা গেছে লাখ লাখ নিরীহ মানুষ। হত্যা, ধ্বংস, অনাহার আর জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বিভিন্ন অঞ্চলে পাড়ি জমাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ, কেঁড়ে নেয়া হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের ভূমির অধিকার। একই ভাগ্য বরণ করছে ভারতের কাশ্মীরের অধিবাসীরা, চলতি বছর ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ঘোষণার মধ্য দিয়ে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেঁড়ে নেওয়া হয়। সামরিক বাহিনী কর্তৃক হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তারসহ নানা ধরণের মানবাধিকার বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই তালিকায় যোগ হয়েছে চীনের শিংজিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যালঘু উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর নাম। চীনের উইঘুর মুসলিমদের বিরুদ্ধে নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণগ্রেপ্তার অভিযান অনেক দিন ধরেই চলছে। গত দুই বছর ধরে নির্যাতন-নিপীড়ন ও গণগ্রেপ্তার অভিযান আরও জোরদার করেছে দেশটির সরকার। জাতিগত, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় মুছে ফেলতে উইঘুরদের পাশাপাশি কাজাখ জাতিগোষ্ঠী ও অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীর অন্তত ১২ লাখ সদস্যকে বন্দিশিবিরে বন্দি করে রাখা হয়েছে, ফলে ঐসব অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে।

মানবাধিকারের আক্ষরিক অর্থ হলো মানুষের অধিকার। অর্থাৎ মানুষকে মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য যে সকল অধিকার দরকার তাই মানবাধিকার। বলা হয়েছে মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের একধরণের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানবাধিকার সব জায়গায় সমান এবং সবার জন্য সমান ভাবে প্রযোজ্য, এ অধিকার সহজাত ও আইনগত অধিকার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হলো এসব অধিকারের রক্ষণাবেক্ষণ করা। সহজভাবে বলতে গেলে, মানুষের জীবন ধারণের অধিকার, সম্পদের অধিকার, মান-মর্যাদা ও ইজ্জতের অধিকার, খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বাসস্থানের অধিকার, চিকিৎসার অধিকার, আর্থিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার, যাতায়াত ও স্থানান্তরের অধিকার, নারী ও শিশুর অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, ভোটের অধিকার, বাক স্বাধীনতার অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, কৃষক-শ্রমিকের অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সমতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার ইত্যাদি। জাতিসংঘ কর্তৃক মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা পত্রে উপরোক্ত অধিকারগুলিকে মানুষের অধিকার বা মানবাধিকার ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজও বিশ্বের কোথাও মানুষের এসব অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণা আজ পরিণত হয়েছে নিছক আনুষ্ঠানিকতায়।

আমাদের মহান সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানকে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসাবে স্থান দেওয়া হয়েছে, কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমরা সাংবিধানিক ভাবে মানুষের এই মৌল-মানবিক অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠায় এখনো পুরোপুরি সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের দেশের সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি মানবাধিকার সংরক্ষণের কথা থাকলেও মানুষ প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, গুম, খুন-খারাবি, শ্রমিক নির্যাতন, শিশু শ্রম, মানব পাচার, ঘুষ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, রাহাজানিসহ নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে। আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের অভাব এবং জনগণের অসচেনতার কারণেও হচ্ছে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ফলে সঠিক মৌল-মানবিক অধিকার ভোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ জনগণ। আইনের অপব্যবহার, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, জনগণের অজ্ঞতা ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে আমাদের দেশের অতীত ও বর্তমান সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মানবাধিকার সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার জন্মগত মৌলিক অধিকার, মানবতার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনে মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু আমরা মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়ে বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র ও সরকারকে আরও সচেষ্ট হতে হবে, মানবাধিকার সুদৃঢ় করার জন্য ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সংবিধান ও গণতন্ত্র সুরক্ষায় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকারের প্রতিটি সংস্থাকে। মানবাধিকার উন্নয়ন ও সংরক্ষণে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলিকে নিরপেক্ষ ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাছাড়া মানবাধিকার সুরক্ষায় দরকার সামাজিক ব্যাধি নির্মূল ও সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের মধ্যে মানবাধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সামাজিক ব্যাধি নির্মূলের পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে মানবাধিকার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে সুশীল সমাজ, সংবাদ মাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

  • জাহাঙ্গীর হোসাইন চৌধুরী: মানবাধিকার কর্মী।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত