মুজাহিদ আহমদ

১০ এপ্রিল, ২০২০ ১৯:০৬

স্টেথোস্কোপ হাতে যে মানুষ দাঁড়িয়ে

আগামী ভোরটা আপনাদের। যে ভোরটার প্রতিক্ষায় আজ পুরো পৃথিবী। আর আপনারা বলতে বুঝাচ্ছি, আপনারা—যারা চিকিৎসক। যিনি স্টেথোস্কোপ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এ মুহূর্তে দুনিয়াজুড়ে মৃতের সংখ্যা লাখ ছুঁই ছুঁই। কঠিন একটা সময়ের ভেতর দিয়ে পৃথিবী সামনের দিকে এগুচ্ছে। কোনো মানুষ অন্য কোনো মানুষের দিকে, কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রের দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পাচ্ছে না, কষ্ট হচ্ছে। সহজভাবে এগিয়ে আসতে পারছে না কেউ কারো সাহায্যে। আলোর মাঝেও বিরাজ করছে তীব্র অন্ধকার। চারদিক থেকে কানে এসে আঁচড়ে পড়ছে—লাশ, লাশ শব্দ! ডানে বামে, সামনে-পেছনে কোথাও কোনো আশার প্রদীপ কেউ দেখাতে পারছেন না! ঐ দূরে—কেরোসিনবিহীন সলতে আর কতক্ষণ জ্বলবে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না—আলো কোথায়? এই এখন কি তখন লাশের সংখ্যা লাখের কোঠা ডিঙাবে এমন একটা অবস্থা যখন বিরাজ করছে—তখন আপনারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মানুষের জন্যে লড়ে যাচ্ছেন। এই লড়ে যাওয়া কোনো খ্যাতি, নাম-যশ কামানোর জন্য নয়। একেবারে মন থেকে মানুষকে ভালোবেসে—মানুষের সংকটময় মুহূর্তে মাথার পাশে দাঁড়িয়েছেন স্টেথোস্কোপ হাতে, দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন, ছুটোছুটি করছেন মানুষের বিপন্ন জীবন মেরামতের জন্য। নিজের জীবনের কথা অনেকটাই ভুলে গেছেন অথবা তুলে দিচ্ছেন মৃতদের বাহনে; কফিনে। মানুষকে সারিয়ে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শক্তি যোগাচ্ছেন—স্যালুট আপনাদের।

দেখুন, হে মহান চিকিৎসক—আপনাদের দিকে একটা সোনালী ভোর এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। যে ভোরের জন্য পৃথিবীর কোটি কোটি বাসিন্দা অপেক্ষার প্রহর গুনছেন। আলো! আলো! বলে চিৎকার করছেন। আর্তনাদ করছেন। যে সময়ে সারি সারি মৃত মানুষ নিয়ে অস্থির হয়ে আছে পৃথিবী। অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁপছে প্রতিটা হৃদয়। কখন আলো ফুটবে, কখন আলোকিত হবে জনপদ? কাছে থেকে দেখা যাবে স্বজনের মুখ। এই এক জপমালা প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি চোখ-মুখে। কোটি কোটি মানুষের সেই কাঙ্ক্ষিত ভোর, ভোরের সূর্য, নরম আলোর ঝলকানি এই তো আপনাদের চোখে-মুখে দেখা যাচ্ছে—গলে পড়বে জনপদে, খেলে যাবে পৃথিবীময়।

যুদ্ধের মাঠ থেকে যারা পালাবার, তারা তো পালাবেই। নানা অজুহাতে তারা পালাবেই। তারা কত কিছুর কঠিনতর দোহাই দিবে। তারা জন্মেছে তাদের নিজেদের জন্যে। তাদের কাছে দেশ, দেশের মানুষ নস্যি। সব কিছু গোল্লায় যাক এতে তাদের কিছু যায় আসে না। এরা কিন্তু সংখ্যায় খুবই কম; খুবই নগণ্য।—তাতে যুদ্ধ থেমে যায় না। যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরেন যারা—তাদেরে সময় চিনে রাখে; ইতিহাস চিনে রাখে। ইতিহাস তাঁদেরে ভুলে না। এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগেই যারা ঘরে ফিরেন তাদেরও চিনে রাখে সময়, চিনে রাখে ইতিহাস। এখানে দুই গোত্রেরই নাম হয় ভিন্ন। যারা আগে ফিরেন তারা—পলাতক। যারা পরে ফিরেন তারা জয়ী, তারা বীর। তারা মাটি ও মানুষের গর্ব। আর যুদ্ধে, দুর্যোগে কিছু লোক থাকে আখের গুছানোর ধান্দায়, তারা পেছনে থাকে, পেছন সারির মানুষ। তাদেরে ইতিহাস নাম দেয়—চোর, ধান্দাবাজ অথবা বাটপার। সব শেষে এরা তো চোরই থেকে যায়। নিজের কাছে, মহাকালের কাছে। আর যারা চোর তারা তো চোরই। কবর বুঝে না, শ্মশান বুঝে না। তাদের কাছে কাফনের কাপড়, বাবার ধুতি, মায়ের শাড়ি সবই এক। এরা দুর্যোগ বুঝে না, অনাহারি বুঝে না, অসহায়ের মুখের খাবার বুঝে না, মৃত্যুও বুঝে না। এরা বুঝে চুরি। তাই, তারা কেড়ে নিতে পারে মানুষের মুখের খাবার, পরনের বস্ত্র, রিলিফের চাল।

পৃথিবীর মোড়ল যারা, তারাও যেন ইতোমধ্যে অকৃতকার্য হয়ে পড়েছেন। চোখে-মুখে নিরাশার চিহ্ন। যেন কোথাও কোনো আলোক বিন্দু খোঁজে পাচ্ছেন না তারা। লাশ পুড়তে পুড়তে কিংবা কবর খুড়তে খুড়তে সব শক্তি খুইয়ে ফেলেছেন। আর শক্তি পাচ্ছেন না। মৃত্যুর লাগাম টেনে ধরার কোনো সুযোগ কাছে আসছে না। এখনও অধরা থেকে যাচ্ছে। মুক্তির রশি কোন দিক থেকে এনে কোন দিকে জোড়া লাগাবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। করোনা [কোভিড ১৯] প্রশ্নে তারা কেউ কারো দিকে তাকানোর সুযোগ নেই। তাদেরও পিঠ যেন দেওয়ালে আটকে পড়েছে ক্রমেই। ঘোষণা দিচ্ছেন—‘জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’ আছেন তারা। এরকম এক মহাবিপর্যয়ের মুহূর্তে লুটপাট আর কমিশন বাণিজ্য নিয়ে ঘুম হারাম আমাদের দেশের কিছুসংখ্যক নাগরিকের। লজ্জা! এ লজ্জার কোনো সীমা নেই, অন্ত নেই। আমরা বুঝতে শিখি নি—পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। হোক সেটা ভালো কিছু অথবা মন্দ কিছু। চলমান মহাবিপর্যয়টিও স্থায়ী হবে না। ইতিপূর্বেও অনেক বিপর্যয়ের দেখা পেয়েছে পৃথিবী। পৃথিবী আছে, বিপর্যয় টিকে নি।

প্রবাসে থাকা বেশ কিছুসংখ্যক বাংলাদেশী করোনায় [কোভিড ১৯] আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এ সংবাদ আমাদের জন্য বড়োই কষ্টের, পীড়া দিয়ে যাচ্ছে। এমন অনেক আছেন আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরবেন এই আশায় বুক বাঁধি। যারা সুস্থ আছেন কর্মভেদে তারা কেউ কেউ কোয়ারেন্টিনে আছেন। যারা চিকিৎসা পেশায় তারা কর্তব্যচ্যুত হননি। মানুষের হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। পালিয়ে যান নি। মানুষ রক্ষার শপথ নিয়ে বরং ঝাঁপিয়ে পড়েছেন স্ব-স্ব হাসপাতালে, ক্লিনিকে। তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন মাঠে থেকে অদৃশ্য শক্তির সাথে। মানুষের আপদকালে নিজের জীবন ও পরিবারের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে—করোনার কামড় থেকে টেনে টেনে মুক্ত করছেন মানবপ্রাণ। তাদের প্রচেষ্টায় একে একে মুক্ত হচ্ছেন আক্রান্ত মানুষ; হাসি মুখে ফিরছেন ঘরে। যারা এ কঠিন কাজ করছেন—আমরা তাদেরে শুধু অভিনন্দিত করছি না। দাঁড়িয়ে বীর খেতাবে ভূষিত করি। আমাদের হৃদয়ে নির্মাণ করি তাদের নামে— স্টেথোস্কোপ হাতে, সিনা উঁচু করে দাঁড়ানো মানুষের একেকটা ভাস্কর্য। এরা আমাদের। এরা বাংলাদেশের। এরা বিপদে ভয় করেনা। আগলে রাখে না নিজেকে। এরা বাঙালি বীর। বীরের জাত। সামনে পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক তারা মোকাবেলা করবেন, এ আশায় বুক বাঁধতেই পারি।

এ সংকটে কাউকেই দোষারোপ না করি। একক কারো দোষে করোনার এই দুর্যোগ আমাদের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের দুর্গে প্রবেশ করেনি। বিতর্কে আপাতত না জড়াই, করোনা কার তৈরি-মানুষের না স্রষ্টার। এই কঠিন সংকটে শুধু অনুধাবন করতে শিখি— এর বিস্তার ও পরিস্থিতি কতটুকু ভয়ানক।সামাজিকভাবে সচেতনতা ছাড়া আমাদের আপাতত এর থেকে রেহাইয়ের আর কোনো দরজা খোলা আছে কি না বলা মুশকিল। আমাদের কিছু ভুল আছে, তা হলো—করোনার [কোভিড ১৯] ভয়াবহতার চৌহদ্দি কত বড়, পরিণতি কী তা বুঝতে দেরি করা। দেরিতে বুঝেছি ফলে আশঙ্কাজনকভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ছে। ওয়ার্ল্ডও মিটার ইনফোতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়—মহামারি করোনাভাইরাসে বিশ্বজুড়ে মৃতের সংখ্যা এখন প্রায় ৯৬ হাজার। এই লেখা তৈরি পর্যন্ত শুক্রবার [১০ এপ্রিল] ৯৫ হাজার ৭২২ জন। আর আক্রান্তের সংখ্যা এখন ১৬ লাখ ৩ হাজার ৭১৯ জন। ইউরোপের যে কয়েকটি দেশে প্রাণহানির সংখ্যা বেশি এর মধ্যে— ইতালি ১৮ হাজার ২৭৯ জন । স্পেন ১৫ হাজার ৪৪৭জন, ফ্রান্স ১২ হাজার ২১০, যুক্তরাজ্য ৭ হাজার ৯৯৭ জন। যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ প্রাণহানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে ১ হাজার ৯০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ফ্রান্সে ১ হাজার ৩৪১ জন এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

২০১৯-এর ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। দেশটি এখন করোনার সংক্রমণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তবে আমেরিকা ও ইউরোপে এটা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির তথ্যমতে, শনাক্ত রোগীর সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রে—চার লাখ ৫৫ হাজার ৪৫৪। এর পরে আছে স্পেন—এক লাখ ৫২ হাজার ৪৪৬। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যেই করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তারা বলছেন—নতুন করোনাভাইরাসের ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে চাইলে জরুরি ভিত্তিতে আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। এদিকে, চলতি মাসের ৮ তারিখে বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। শুক্রবার [১০ এপ্রিল] পর্যন্ত ৪২৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর। এদের মধ্যে ২৭ জন মারা গেছেন।এ পর্যন্ত ২১ জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এই সময়ে আমাদের উচিৎ কী সেটা আমাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা যে বার্তাটি আমাদের কাছে বারবার পৌঁছাতে চেষ্টা করছেন, সেটি হলো—আপাতত এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে, চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধই হচ্ছে মোক্ষম পথ। আমাদেরকে প্রতিরোধের পথেই হাঁটতে হবে।

খেয়াল করছি—অন্ধকার প্রতি মুহূর্তেই গাঢ় হচ্ছে। চারদিক থেকে কেবলই চিৎকার শোনা যাচ্ছে। হা-হুতাশে বাতাস ভারি হয়ে উঠছে ক্রমেই। গরম শ্বাস-প্রশ্বাসে সম্মুখটা ধূমায়িত। অন্ধকারের ভেতর থেকে শুধু আর্তনাদ ভেসে আসছে—বাঁচতে চাই, আমরা বাঁচতে চাই। বিশ্বাস করি অন্ধকার গাঢ় হওয়া মানে একটা আলোকিত ভোরের দিকে যাত্রা। আর প্রত্যাশিত ভোর একটা রঙিন সূর্য নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসা। এগুচ্ছে—ভোর। ভোর আসবেই, আসবে নতুন সূর্য নিয়ে। যে ভোরের অপেক্ষায় বাংলাদেশ, যে সূর্যের অপেক্ষায় গোটা পৃথিবী।সেই ভোর, সেই সূর্য আপনাদের। আপনারা যারা চিকিৎসক। স্টেথোস্কোপ হাতে ছুটছেন, মানুষের জীবন মেরামত করতে; অসুখ সারাতে।

  • মুজাহিদ আহমদ: কবি ও সংবাদকর্মী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত