মুজাহিদ আহমদ

৩১ মার্চ, ২০২০ ১৩:২৩

তরী ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠুক অবশেষে

খাঁচার ভেতরে পাখির ছটফটানির মতো ছটফটাচ্ছেন। ক্রমেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন। দৃষ্টিসীমা চার দেওয়ালের ভেতর আটকে আছে সেই কতদিন থেকে, এখন আর মনে পড়ছেনা। ভুলতে বসেছেন যারা- তারা তো আমাদের স্বজন, আমাদের আপনজন। তারা বসবাস করছেন পৃথিবীর সব চেয়ে উন্নত রাষ্ট্রে। পরিপাটি জীবনব্যবস্থা। সর্বাধুনিক গতি কিংবা ব্যবস্থাপনায় ছিলো তাদের জীবন-উদযাপন। কিন্তু আজ থমকে গেছে সব। ম্যাসাকার হয়ে যাচ্ছে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, রাত। ঘুম নেই, নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। কেনো এই ভয়াবহ থমকে যাওয়া? কোন সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে ঘটছে এসব? –তারপরও তারা মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে খবর নিচ্ছেন দেশের আপনজনেরা কেমন আছেন। তাগাদা দিচ্ছেন সাবধানে থাকার। তাদের নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে জানাচ্ছেন এইভাবে- ‘বলতে পারো এখানে আমরা জ্বলন্ত উনুনের উপর বসে আছি। আমাদের এলাকাই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু হারও সবচেয়ে বেশি এখানেই।

গৃহবন্দি অবস্থায় আছি আজ অনেক দিন। তোমাদের জন্য দোয়া করছি, আল্লাহতাআলা সবাইকে হেফাজত করুন। সবাই ভালো থেকো। সাবধানে থেকো।’ এরকম কথার পর চোখের সামনে যে কঠিন দৃশ্যের অবতারণা হয়, তারপরও কি বগল বাজিয়ে, হুলস্থূল করার ইচ্ছে জাগে? পাড়ার মোড়ে; টঙ দোকান ঘিরে আড্ডাবাজি করার মন চায়? এমনও খবর শোনা যাচ্ছে- ভয়ে লোকজন কান্নারও শক্তি পাচ্ছে না। তারাও আপনার-আমারই স্বজন-বন্ধু। এরাও এই আক্রান্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। তারাও আমাদের মতো শুরুর দিকে রঙ-তামাশা করে উড়িয়ে দিয়ে ছিলেন ঘাতক কোভিড-১৯ কে। কই, উড়ে তো যায়নি। বরং চেপে বসেছে। একদম চেপে বসার মতোই- চোখের সামনে গোটা পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। একেবারে কল্পনাতীতভাবে।

ঘাতক কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা ৭ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মৃতের সংখ্যা ৩৫ হাজার ছাড়িয়েছে। অবিরাম সতর্কবার্তা জানাচ্ছেন- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা করছিনা। আমরা অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কারণে-অকারণে জটলা পাকাচ্ছি। হাসিঠাট্টা বিরামহীনভাবে অব্যাহত রেখেছি। এসবে তথাকথিত শিক্ষিত ও সচ্ছল মানুষের সংখ্যাই বেশি। আমাদের জ্ঞান রাখা উচিত নির্ধারিত মৃত্যু এককথা আর মৃত্যু ডেকে আনা আরেক কথা।

উহানে যখন মানুষ মরছিল, ইতালিতে বসে ইতালির মানুষ তখন হাসাহাসি করছিলো। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি মনোবল না হারিয়ে ধৈর্য ও দূরদর্শিতার সঙ্গে তার দেশবাসীর উদ্দেশে যে ম্যাসেজটি পাঠিয়েছেন তার সরল বাংলা হলো- ‘আরও খারাপ পরিস্থিতির জন্যে আমাদের তৈরি থাকতে হবে।’ কিন্তু আমাদের মধ্যে এখনো কেনো জানি একটি উদাসীনতা কাজ করছে।

আমরা তো এখনো অনেক ভালো আছি। গত দুই দিনের পরিসংখ্যানও আমাদের আশাবাদী করে তুলছে। আমাদের বিশ্বাসী করে তুলছে- নাহ, আমাদের কিচ্ছু হবে না। তারমানে এই নয় যে, সরকারের বেঁধে দেওয়া নিয়ম, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ভেঙে হৈহৈ রব করতে করতে ব্যারিকেড ভেঙে অলিম্পিকের মাঠে ঢোকার মতো আমরা হাটে-বাজারে, মাটে-ঘাটে নেমে পড়বো। আর চার-ছক্কা বা গোল-গোল আনন্দে একজন আরেক জনের মাথার উপর লাফিয়ে উঠবো! এমনটাতো ঠিক হবে না। আশঙ্কার জায়গাটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে আসছে। লাফালাফি কিংবা নাচানাচির কিচ্ছু নেই। শঙ্কা হলো- এ ভালো থাকা কতটুকু সময় পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবো আমরা। কী ক্ষমতা আছে আমাদের। মাথার উপরের যে আকাশটি দেখছি, সেটি তো খুবই কালো; অন্ধকার। এই আকাশটি কালো থেকে কালো হয়ে উঠবে সময়ের ব্যবধানে। একদম নিকষ কালো। এই আকাশভর্তি অন্ধকার দেখে সাবধান হওয়া এখন সময়ের কঠিনতম দাবি। এটাই মূল কথা।

আজকের দিনেও আশপাশের কিছু দৃশ্য অবাক করছে। আমাদের কে শেখাবে। কে জ্বালাবে আমাদের বোধশক্তির নিভে যাওয়া সলতে। আমরা যেন কাণ্ডজ্ঞানহীন-ই রয়ে যাচ্ছি। আমরা যে একটা আশ্রয়ে দাঁড়াবো সে বোধটুকুও জাগছে না আমাদের। আমরা হাসি-ঠাট্টা-তামাশা করেই বেড়াচ্ছি এখনও। আমাদের কে শেখাবে। আমরা যদি না শিখি। নিজেদের হাঁটার জায়গাতো নিজেরাই তৈরি করতে হবে। আমাদের তো আরও আগে থেকেই সজাগ হবার কথা। আমরা সজাগ হচ্ছি না কেনো?

স্থানীয়ভাবে অনেক তরুণ, রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, ব্যক্তি উদ্যোগে সেই শুরু থেকেই লিফলেট, হ্যান্ডমাইক নিয়ে ঘুরে ঘুরে পাড়ায়-পাড়ায়, মহল্লায়-মহল্লায় গলা ভেঙে বলতে শুনলাম- নাগরিকদের জন্য সচেতনতামূলক বার্তা, কাউন্সিলিং। প্রশাসনিকভাবেও রাস্তার মোড়ে মাইক হাঁকিয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে বলতে শুনেছি- ‘আপনারা প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হবেন না। বের হলে মাস্ক, গ্লাভস পরে বের হবেন। বেশি বেশি করে হাত ধোবেন। অপরিচ্ছন্ন হাত চোখে-মুখে লাগাবেন না।’ কে শুনে কার কথা। শহরে ভেতরে হোমিওপ্যাথির মতো একফোঁটা কোনোমতে মানলেও শহরতলী কিংবা শহর থেকে একটু দূরে সরলেই ভিন্ন চিত্র। যা রীতিমতো লোমহর্ষক।

আমরা আমাদের নিরাপদে রাখার পাশাপাশি এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি সামনে এসেছে তা হলো- দিনমজুর, অভাবী মানুষ যারা ঘরে আছেন, তাদের জন্য এগিয়ে আসা। নিম্ন আয়ের এসব সাধারণ মানুষের কাছে সাধ্য অনুযায়ী খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। অবশ্যই বাইরে ডেকে এনে জটলা পাকিয়ে নয়। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান মানুষের সহযোগিতার হাত তাদের দিকে প্রসারিত করা। প্রতিটি পাড়ায়-মহল্লায় গ্রামে-গঞ্জে জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে খাবারের ব্যবস্থাটুকু করা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, স্বেচ্ছাসেবীসহ অনেক সংগঠন ও সংগঠনের লোকজন মাঠে আছেন। অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কাজ করছেন। বিশেষ করে এই মহাবিপর্যয় মোকাবেলায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ও উত্তরণ খেলাঘর আসর-এর সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক টিম মাঠে আছে খুব গোছানোভাবে। প্রয়োজনে এই টিমের সাহায্যও আমরা নিতে পারি।

সবশেষে বলি- সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই তরী ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠুক অবশেষে।

  • মুজাহিদ আহমদ: কবি ও সংবাদকর্মী

আপনার মন্তব্য

আলোচিত