খলিল রহমান

২৫ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০৮

হাওরের কৃষক জানে কখন কী করতে হয়

হাওর। দিগন্ত-বিস্তৃত ফসলের মাঠ। বসন্ত বাতাসে এখানে দোল খায় সোনালি ধানের শীষ। হাওর আবার কখনো জলেভাসা জনপদ। জল-জোছনার মেলবন্ধনে নয়ন জুড়ায়। যখন আফাল জাগে, জীবন তখন উথাল-পাতাল ঢেউয়ের। জীবন এখানে সংগ্রামের। শাহ আবদুল করিমের মন-মজানো গানের। হাওরে দুঃখের সঙ্গে আছে সুখ। আছে প্রেম-বিরহের মধুর কাব্য।

এ জনপদের মানুষ লড়তে জানে, ভেঙে আবার গড়তে জানে। হাওরের জল, মাছ, গাছ, ফুল-পাখি সব, এ জনপদের মানুষের নিত্যসঙ্গী। আত্মার পরম আত্মীয়। হাওরের ধান, সে তো কৃষক পরিবারের প্রাণ-স্পন্দন। এই ধানেই চোখে আনে আনন্দের বাণ। মুখে আনে সুখের গান।

এসব আপনার জানা গল্প। তাই ভণিতা রেখে মূল কথায় আসি। হাওরে এখন ধান কাটার মৌসুম চলছে। কৃষকেরা চিন্তিত। কারণ, বন্যার শঙ্কা আছে। বৃষ্টি হচ্ছে মেঘালয়ে। বৃষ্টি হচ্ছে ভাটিতে, সুনামগঞ্জে। তবে হাওরে এই সময় ঝড়, বৃষ্টি আর ঢলের খেলা নতুন কিছু নয়। কৃষক এসব থোরাই কেয়ার করেন। কৃষকেরা জানেন, কখন কী করতে হবে। কখন কোন ধান কাটতে হবে। আর সেই কাজটি গতর খাটিয়ে তারা করেন। কৃষকের ঘরের নারীরা করেন, বয়সী মানুষেরা করেন, জোয়ানেরা করেন, কিশোর-কিশোরী, শিশু সবাই মিলে করেন।

বিজ্ঞাপন

এখন তারা মাঠে। এ সময় অন্য কে কী করল সেটিতে তাদের খুব একটা আসে-যায় না। তারপরও রাষ্ট্রযন্ত্র, সমাজের ভদ্র লোকেরা, নেতারা, সমাজকর্মীরা তাঁদের পরামর্শ দেবেন, সহযোগিতা করবেন, এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু খেয়াল করুন, কদিন থেকে কৃষকদের একটা ভয়ের মধ্যে রাখার চেষ্টা চলছে। একটা অস্থিরতা, তাড়াহুড়া সর্বত্র। কৃষকেরা কি কাঁচা ধানও কেটে ফেলবেন। এত ভয়, এত তাড়াহুড়া কীসের। ফসল রক্ষায় ১৩২ কোটি টাকার বাঁধ হয়েছে। এসব বাঁধ জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে হাওরজুড়ে। এসবের কি কোনো মূল্য নেই। তাহলে ভয়টা কাদের? কৃষকের না অন্য কোথাও।

হাওরপাড়ের ৮০ বছর বয়সী কৃষককে আবহাওয়ার সর্তক বার্তা বোঝানো, কখন ঢল আসবে, কখন ফসল তুলতে হবে, এসব সবক দেওয়ার একটা সীমা থাকা দরকার। ওই কৃষক কিন্তু হাওর দেখে, হাওর বুঝেই চুল-দাড়ি পাকিয়েছেন। তাপানুকুল কক্ষে বসে যে কাগুজে পরিকল্পনা কিংবা স্ক্রিপ্ট লেখা হয় এসব ওই কৃষকের মাঠের জ্ঞানের কাছে নস্যি। কৃষকের চিন্তা-ভাবনা খাঁটি। তিনি আকাশে তাকিয়ে বুঝেন কখন বৃষ্টি হবে। উত্তরের পাহাড়ে চোখ রাখলেই ঢলের মাপ পেয়ে যান। যা করার তারাই করবেন। তবে তাদের পাশে থাকাটা ভালো। এটা আমাদের দায়িত্ব, কারো কারো কর্তব্য। মাঠে নানা শ্রেণি ও পেশার লোকজন যাচ্ছেন, ধান কাটছেন, কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছেন। তাদের অবশ্যই সাধুবাদ। তবে মনে রাখতে হবে, এটাতে যেন বাড়াবাড়ি না হয়। লোক দেখানো কিংবা সস্তা খবরের শিরোনাম হওয়ার চেষ্টা যেন না থাকে। কৃষকেরা যেন সত্যিই বুঝেন, যা হচ্ছে সেটা তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা থেকে; করুণা বা দয়া থেকে নয়।

দেশের একজন আলোকিত মানুষ সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইন গত বুধবার মারা গেছেন। তিনি ওইপদে থাকাকালে একবার সুনামগঞ্জে এসেছিলেন। তখন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক ছিলেন জনাব জাফর সিদ্দিক। প্রয়াত সা’দত হুসাইনকে নিয়ে তিনি তাঁর ফেসবুকে দুদিন ধরে ‘স্মৃতি অমলিন’ শিরোনামে লিখছেন। বেশ সুখপাঠ্য। সুনামগঞ্জের কথাই বেশি। প্রথম পর্বে ১৬ বছর আগে ওই দিনের কথা বলতে দিয়ে তিনি লিখেছেন, সার্কিট হাউজে সা’দত হুসাইনসহ রাতের খাবার খেতে বসেছেন তাঁরা। সচিব মহোদয়ের পাশের চেয়ারে বসা জেলা প্রশাসক অতিথির প্লেটে এটা-ওটা তুলে দিচ্ছেন। একবার-দুবার দেওয়ার পর সচিব সাহেব তাঁকে এটা না করতে বললেন। এরপর সার্কিট হাউসের কর্মীদের ইশারা করলেন। পরে ওই কর্মীরা এসে সচিব সাহেবের প্লেটে যা যা প্রয়োজন তুলে দিলেন। জনাব জাফর সিদ্দিক বলছেন, আমি তখন বুঝলাম, আমি যেটা করছিলাম সেটা আমার পদের কাজ নয়, যারা খাবার পরিবেশন করছেন এটা তাদের কাজ।

বিজ্ঞাপন

হাওরে এখন কৃষকের যে কাজ, সেটি তাঁদের নির্বিঘ্নে করতে দেওয়া উচিত। কী বলেন?

খলিল রহমান: লেখক, সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত