ডা. জোবায়ের আহমেদ

০৫ মে, ২০২০ ১৬:৫৮

টিপ অব দ্য আইসবার্গ

করোনা পরিস্থিতিতে আমরা যা দেখছি, শুনছি, জানছি তা অতি সামান্য অংশ। দেশের অবস্থা কতটা ভয়াবহ তার সামান্যই আমাদের দেখানো ও জানানো হচ্ছে যা Tip of the iceberg, কিন্তু পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ এটা অস্বীকার করা মানে স্রেফ পাগলামি করা।

প্রথমে বলি টেস্ট নিয়ে। পর্যাপ্ত টেস্ট হচ্ছে না। শুরুতে ল্যাব ও কিট সংকট ছিলো। এখন অনেকগুলো ল্যাব সারাদেশে হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে স্যাম্পল জট সব জায়গায়। আমার মেডিকেল কলেজ সিওমেক-এর ১৬ জন ইন্টার্ন চিকিৎসক ২৫ এপ্রিল স্যাম্পল দিলেন টেস্টের জন্য। তাদের রিপোর্ট আসলো ১০ দিন পর গতকাল ১৬ জন পজিটিভ।

বিজ্ঞাপন

অনেক অভিযোগ রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছেনা ৪/৫/৬/৭ দিনেও। সিওমেক থেকে জানলাম এখানে প্রতিদিন স্যাম্পল আসে ১০০০ এর বেশি, টেস্ট করা যায় ১৮০ জনের। তাহলে স্যাম্পল জট হওয়ারই কথা।

কিন্তু আতংকটা হলো এরমধ্যে যারা স্যাম্পল দিচ্ছেন তারা অনেকে উপসর্গবিহীন বা Mild symptoms এর। তারা তো কোয়ারেন্টিনে থাকছেন না। ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভাইরাসটি। যারা উপসর্গ নিয়ে স্যাম্পল দিচ্ছেন,তাদের রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়ায় চিকিৎসা পাওয়া ব্যাহত হচ্ছে। করোনার উপসর্গ নিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাচ্ছেন কিন্তু ভর্তি নিচ্ছেনা রিপোর্ট ছাড়া।

বাংলাদেশ প্রতিদিন এর প্রতিবেদন থেকে জানা গেলো গত শনিবার থেকে সোমবার বিকেল অবধি ডিএমসি'তে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ২৬ জন যাদের মধ্যে চারজনের কোভিড-১৯ পজিটিভ।
অনেকের রিপোর্ট পেন্ডিং। টেস্টের স্যাম্পল দিতেই তো দেখা যাচ্ছে রোগীদের জীবন অর্ধেক শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমার চিকিৎসক বন্ধুরা আক্ষেপ করে বলছেন, এই কষ্ট চোখে না দেখলে বুঝা যাবেনা। রিপোর্ট পেতে পেতেই যদি রোগীর জীবন শেষ হয়ে যায় তবে আর টেস্টের দরকার কী?

তারপরের কথা আমরা চিকিৎসকরা জানি rt PCR এ False negative রিপোর্ট আসতে পারে ৩৩% স্যাম্পলের। তার কারণ আছে। সেজন্য সাস্পেক্টেড করোনা রোগীদের negative রিপোর্ট আসলে বারবার টেস্ট করতে হবে। কিন্তু rt PCR এ False positive রিপোর্ট খুবই রেয়ার যদি না স্যাম্পল এর cross contamination হয়।

তবে কুষ্টিয়ার যেই ৬৭ জন এর স্যাম্পল প্রথমে পজিটিভ আসলো তারপর IEDCR এর রি-টেস্টে ৬৫ জনের নেগেটিভ রিপোর্ট আসলো তার ব্যাখ্যা কী? এই ব্যাখ্যা কে দেবেন? জানি কেউ জবাব দেবে না।

টেস্ট নিয়ে সারাদেশে যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না। এরমধ্যে IEDCR টেস্ট করা ও স্যাম্পল কালেকশন থেকে দূরে সরে গেছে। যদিও প্রথমে তারা বারবার বলেছে কোভিড প্যান্ডেমিক মোকাবিলায় তারাই একমাত্র দক্ষ প্রতিষ্ঠান। সব দায় তাদের নয় জানি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাদের সামনে রেখে নিজেদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি লুকাতে চেয়েছে। চিকিৎসকদের ভিলেন করে তাদের অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, চরম নৈরাজ্য ও লুটপাটের চেহারা আড়াল করতে চেয়েছে। মানুষ ইতোমধ্যে সব জেনেছে।

এবার চিকিৎসা নিয়ে কথা। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীরা নানা অভিযোগ তুলছেন। সব অভিযোগ অতিরঞ্জন নয়, ভিত্তিহীন নয়। রোগীরা অক্সিজেন পাচ্ছেন না। ফ্লো মিটার এর সংকট এমন জেনেছি পত্রিকায়। সেন্ট্রাল অক্সিজেন নেই অনেক জায়গায়। আইসিইউ ভেন্টিলেটরের সেবা তো অনেক পরের কথা, সামান্য অক্সিজেন যদি এই রাষ্ট্র তার অসুস্থ নাগরিকদের দিতে না পারে, তবে রাষ্ট্রের কি লজ্জা পাওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র তো একটা কাঠামো, সে কিভাবে লজ্জা পাবে। তবে লজ্জাটা কার হওয়া উচিত? পাঠকের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম।

অনেক জায়গায় কোভিড ছাড়াও শ্বাসকষ্ট জনিত রোগ নিয়ে চিকিৎসা না পাওয়ার হাজারো অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন অনেকেই। এই মৃত্যুর দায় কার? কে নেবে দায়? এখন যারা মারা যাচ্ছেন তাদের ক্ষতটা কে সারিয়ে তুলবেন। চোখের সামনে প্রিয়জন তড়পাতে-তড়পাতে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন, আপনজন অসহায়ের মত চেয়ে চেয়ে দেখছেন, কিছুই করতে পারছেন না। এই মানুষগুলোর অভিশাপ ও দীর্ঘশ্বাস এই রাষ্ট্র বইতে পারতে তো? যারা রাষ্ট্রের চালকের আসনে, তারা ভেবে দেখবেন। আপনার আপনজন এর সাথে এমন হলে কেমন লাগতো??

বিজ্ঞাপন

এবার চিকিৎসকদের প্রতি কিছু কথা। আপনারা পিপিই পাননি আগে। আমরা কথা বলছি, লিখেছি, চিৎকার করেছি। আপনাদের সুরক্ষার জন্য আওয়াজ তুলেছি। আপনারা অনেকে কোভিড ও নন কোভিড হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। আমাদের দোয়া ও সমবেদনা জানবেন। কিন্তু আপনারা কি এরআগে Acute breathlessness এর রোগীর চিকিৎসা দেননি। কোভিড নিউমোনিয়া, ARDS, pulmonary embolism এর জন্য শ্বাসকষ্টের রোগী তো দুইমাস হলো দেশে। তার আগে এই দেশে যারা শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন, নানা রোগের জন্য শ্বাসকষ্টে ভুগেছেন, তারা কি সব মরে গেছেন?

Acute severe asthma, Acute exacerbation of COPD, Acute LVF, Cor pulmonale, Metabolic acidosis, Diabetic keto acidosis, MI, CCF,DCM, Tension pneumothorax, Pleural effusion, Psychogenic, hyperventilation আপনারা ইমারজেন্সিতে ম্যানেজ করেছেন তারা আজ কোভিড-১৯ এর ভয়ে চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছেন। রিপোর্ট ছাড়া ভর্তি হতে পারছেন না। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছেন। এক হাসপাতাল আরেক হাসপাতাল দেখিয়ে দিচ্ছে।

একজন চিকিৎসক হিসেবে আপনি একজন ফাইটার। যোদ্ধার সবসময় সব ইতিহাসে নিজের জীবনবাজি রেখেই লড়ে যান দেশ ও মানুষের জন্য। যোদ্ধারা পাওয়ার হিসেব করেন না। স্বীকৃতির জন্যও লড়েন না। আপনারা সেই রোগীকে দেখতে ভয় পান, ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে ভয় পান আবার পিপিই এর জন্য মাতম করেন কেমন শোনায় তখন? আপনি চিকিৎসক হয়েই যদি এত ভয় পান, তবে রোগী ও তাদের স্বজনদের মানসিক অবস্থা একবার চিন্তা করেন।

আপনি পিপিই পরে রোগী দেখতে পারেন, তাকে ইমারজেন্সি চিকিৎসা দিয়ে আরাম দিতে পারেন। সাস্পেক্টেড কোভিডকে আইসোলেশন ward এ রাখতে পারেন। টেস্ট নেগেটিভ আসলে ইনডোরে বা কেবিনে শিফট করতে পারেন।

আপনার স্বজন যদি এমন ভাবে অবহেলা পেয়ে বিনা চিকিৎসায় তড়পাতে তড়পাতে মারা যায়,নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন? আর এতই যদি জীবনের মায়া হয়, তবে আপনি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে বাসায় রেস্ট করা কি বাঞ্ছনীয় নয়?

একজন চিকিৎসক সব সীমাবদ্ধতার মাঝেও রোগীকে প্রায়োরিটি দেবেন, একজন চিকিৎসক চেয়ে চেয়ে রোগীর কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারেন না। যদি তাই করতে পারেন, তবে আপনি সহীহ চিকিৎসক হতে পারেননি।

আমি আজ সকাল থেকে দুইজন তীব্র শ্বাসকষ্টের রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছি। একজন একিউট সিভিয়ার এ্যাজমা,অন্যজন করপালমোনালি। আমরা যদি এদের দায়িত্ব না নিই, তাড়িয়ে দিই সেল্ফিসের মত তবে আমি চিকিৎসক কেন? নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করুন- আপনি তবে চিকিৎসক কেন?

সবার জন্য কথা: দেশে কোভিড ১৯ ব্যাপক আকারে ছড়াচ্ছে। এই অণুজীব দানব আপনার জীবন ছিনিয়ে নিতে পারে যেকোনো সময়ে। ঘরে থাকাই নিরাপদ। কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে আপনি ঘরে থাকলে আপনার জীবন সুরক্ষা পাবে। ঈদ শপিংকে না বলুন। হয়তো এটাই হয়ে যেতে পারে জীবনের শেষ ঈদ। এই শপিং গায়ে জড়াতে নাও পারেন। তাই ভাবুন এই ঈদ শপিং করতে গিয়ে কাফনের কাপড়ই কিনছেন না তো?

স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন। হাত ধুতে থাকুন বারবার। মাস্ক পরুন। ফিজিক্যাল ডিস্টেন্স ৬ ফুট বজায় রাখুন। হাঁচি কাশিতে টিস্যু বা রুমাল ব্যবহার করুন। জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাবেন না ভেবেই প্রতিরোধে মনোযোগী হউন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত