আলমগীর শাহরিয়ার

১১ অক্টোবর, ২০২১ ২২:৪০

ঢাবির প্রথম ছাত্রী সিলেটের কিংবদন্তি বিপ্লবী লীলা নাগ

আজ থেকে শতবর্ষ পূর্বে ১৯২১ সালে সংগ্রামী, স্বাপ্নিক একটি মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী-শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয়ে শুধু ইতিহাসে চমক সৃষ্টি করেননি, পশ্চাৎপদ এ অঞ্চলে, অবরুদ্ধ সমাজে—নারীদের আলোর পথও দেখিয়েছিল। তার সংগ্রামী জীবনাদর্শ এদেশের নারী জাগরণে ভূমিকা রেখেছে। বিপুল প্রেরণা দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের বিস্মৃতির অতল তলে আজ তার হিরণ্ময় জীবন। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না গোটা ভারতবর্ষে কী জেদি, প্রত্যয়ী আর স্বাধীনচেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন এ নারী।

বৃহত্তর সিলেটের শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক একটি পরিবারে ১৯০০ সালের ২রা অক্টোবরে তার জন্ম। বিশ শতকের সূচনালগ্নে শুধু আসাম অঞ্চলে নয়, গোটা ভারতবর্ষে সিলেট জেলা ছিল শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর ও আলোকিত একটি জনপদ। পিতৃভূমি বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারের রাজনগর থানার পাঁচগাঁও গ্রামে। পিতা গিরিশচন্দ্র নাগ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ ডিগ্রি এবং অবসরপ্রাপ্ত একজন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন।

লীলা নাগের মাতা কুঞ্জলতা দেবী ছিলেন সিলেটের ঢাকাদক্ষিণ গ্রামের প্রকাশ চন্দ্র দেব চৌধুরীর কন্যা। পিতার কর্মসূত্রে লীলা নাগের শিক্ষাজীবন শুরু হয় বিহারের দেওঘরের একটি স্কুলে। শিক্ষাজীবনে তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। দেওঘর থেকে কলকাতার ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকার ইডেন হাই স্কুল থেকে ১৯১৭ সালে বৃত্তি পেয়ে প্রবেশিকা পাস করেন। পরে ভর্তি হন কলকাতার বেথুন কলেজে। সে বছর সপ্তদশ জন্মদিন উপলক্ষে পিতার কাছে এক পত্রে লিখেন, "আমার ক্ষুদ্র শক্তি যদি একটি লোকের উপকার করতে পারতো, তবে নিজেকে ধন্য মনে করতুম। সত্যি বলছি এ আমার বক্তৃতা নয়, প্রাণের কথা। এই আমার Ideal. আশীর্বাদ করো যদি এ জন্মে কিছু না করতে পারি আবার যেন এই ভারতবর্ষেই জন্মগ্রহণ করি, একে সেবা করে এ জন্মের আশা মেটাতে।"

লীলা নাগ কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম হয়ে বিএ পাস করেন। অর্জন করেন বৃত্তিসহ পদ্মাবতী স্বর্ণপদক। পরে একই বছরে জেদি এ নারী অর্থাৎ ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্সে ভর্তি হন। প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগ তার উদ্যম ও আগ্রহ দেখে তাকে এমএ শ্রেণিতে ভর্তি করান। লীলা নাগের সঙ্গে একই বছরে আরেকজন নারী শিক্ষার্থীর নামও জানা যায়। তিনি ছিলেন জগন্নাথ হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ ও আইন বিভাগের অধ্যাপক নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের কন্যা সুষমা সেনগুপ্ত। তিনি অর্থনীতি বিভাগে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯২৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাস করেন লীলা নাগ। করাচির বিখ্যাত ডন পত্রিকার সম্পাদক মৌলভীবাজারের আলতাফ হোসেন লীলা নাগের সহপাঠী ছিলেন বলে জানা যায়।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করে লীলা নাগ (বিবাহ-উত্তর জীবনে লীলা রায়) পিছিয়ে থাকা বাংলার নারী সমাজের উন্নয়নে কাজ করেন। তার বিপুল সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিষ্ঠা করেন 'দীপালী সংঘ', 'দীপালী স্কুল', 'নিউ হাই স্কুল', 'নারী শিক্ষা মন্দির' (বর্তমান শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়), শিক্ষাভবন, শিক্ষা নিকেতন। বিশেষ করে দীপালী সংঘ প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। বাংলার নারী সমাজের দুখ-দুর্দশা লাঘবে তাদের সচেতন ও স্বাবলম্বী করতে 'দীপালী সংঘ' প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আগমন উপলক্ষে 'দীপালী সংঘ' আন্তরিক অভিনন্দন জানায়। অভিনন্দন সভায় উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে কবিগুরু বলেন, 'এশিয়ায় এত বড় নারী সমাবেশ আর কখনো দেখি নাই।' ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে বিপ্লবী কার্যক্রম চলে লীলা রায় তার অগ্রভাগে ছিলেন। অসংখ্যবার কারাবরণ করেছেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত নানা সময় ঢাকা, রাজশাহী, সিউড়ি, মেদিনীপুর জেল ও হিজলী মহিলা বন্দিশালায় আটক ছিলেন। ১৯৩৭ সালে মুক্তির পর তাকে সিলেটের মহিলা সম্মেলনে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়। চট্টগ্রাম বিপ্লবের অগ্রনায়ক সূর্যসেনের সঙ্গী বিপ্লবী শহীদ প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার লীলা রায়ের কাছে দীপালী সংঘের সদস্যরূপে বিপ্লবের পাঠ গ্রহণ করেন।

লীলা রায় নিজেও পরবর্তী জীবনে ভারতবর্ষের কিংবদন্তি বিপ্লবী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তার অনুরোধে ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন ইংরেজি সাপ্তাহিক 'ফরোয়ার্ড ব্লক'। তারও এক দশক আগে লীলা রায়ের কর্মময় জীবনের উজ্জ্বল কীর্তি হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠিত 'জয়শ্রী' পত্রিকা। 'জয়শ্রী' বাংলাদেশের প্রথম মহিলা মাসিক পত্রিকা। পত্রিকাটির নামকরণ করেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিগুরুর নিম্নোক্ত আশীর্বাদ বাণী নিয়ে পত্রিকাটি আত্মপ্রকাশ করে- "বিজয়িনী নাই তব ভয়/ দুঃখে বাধায় তব জয়/ অন্যায়ের অপমান সম্মান করিবে দান/ জয়শ্রীর এই পরিচয়।"

চিন্তা ও কর্মে অসাম্প্রদায়িক লীলা রায় ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীর দাঙ্গায় আহতদের সেবাকার্যে নিয়োজিত থাকাকালে গান্ধীজীর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করেন। সাতচল্লিশের দেশভাগের সময়ও অবিভক্ত বাংলা টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বাংলা ভাগ ঠেকাতে না পারলেও পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘুদের স্বার্থে তিনি নিজ মাতৃভূমিতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাদের কল্যাণে নানা কাজে ব্যাপৃত হন। প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ সরকার এক বছরের মাথায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। ব্রিটিশ বিরোধী, স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী বিপ্লবী ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা ছাড়াও, সাংবাদিকতা, শিক্ষা ও সমাজকল্যাণমূলক অনেক কাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন লীলা রায়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তিন দশক তিনি ঢাকায় তার বহুমুখী সাংগঠনিক ও দেশহিতৈষী রাজনৈতিক কর্মতৎপরতায় কাটিয়েছেন। সে সময় প্রধানত নারী শিক্ষা প্রসারে ঢাকায় ১২টি অবৈতনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঢাকার বাইরে নিজ গ্রামে কুঞ্জলতা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিপ্লবী সাথী ও জীবনসঙ্গী অনীল রায়ের মাতুলালয় মানিকগঞ্জের বায়রা গ্রামেও ১৯৩৮ সালে কৃষকসন্তানদের জন্য একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। জীবনযুদ্ধে বিজয়িনী এ নারীর শেষ জীবন কলকাতায় কাটে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে নিজের চিন্তার স্বাক্ষর রেখে যান তার অল্প কিন্তু অর্থবহ কিছু কথায়, "জয় পরাজয়, সাংসারিক সার্থকতা ও ব্যর্থতায় এসবে কি মানুষের কিছু পরিচয় আছে? আছে তার চিন্তায়, ব্যবহারে, সংগ্রামে।"

রোকেয়া থেকে লীলা রায় এখনো পশ্চাৎপদ এ সমাজে প্রেরণার বাতিঘর। ঢাবির প্রথম নারী শিক্ষার্থী অগ্নিকন্যা, বিপ্লবী, সমাজ-সংস্কারক লীলা নাগের স্মৃতি রক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি কিছু করেছে? অন্তত মেয়েদের একটি হলের নামকরণ করেও ঢাকায়, তৎকালীন পূর্ববঙ্গে তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের স্মৃতি পরবর্তী প্রজন্মের অনুপ্রেরণার জন্য বাঁচিয়ে রাখা যেত।

"এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু। পিছন পানে তাকাই যদি কভু।"

আপনার মন্তব্য

আলোচিত