আলমগীর শাহরিয়ার

২৭ অক্টোবর, ২০১৮ ২০:০৪

শিক্ষা: ভিত নাই, তৈরি হচ্ছে ইমারত

জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে লেখক আহমদ ছফার কথা হচ্ছে শিক্ষা, সাহিত্য ও রাজনীতির নানা প্রসঙ্গে। এসব ক্ষেত্রের নানা নন্দিতজন সম্পর্কে রাজ্জাক স্যারের বক্তব্য শুনছেন ছফা। লিখেছেন তাঁর আলোচিত সমাদৃত ‘যদ্যপি আমার গুরু’ গ্রন্থে। তাদের আলোচনায় একপর্যায়ে মওলানা ভাসানীর প্রসঙ্গ উঠলো। ছফা লিখছেন রাজ্জাক স্যারের বয়ানে, একসময় মওলানা ভাসানী মেডিক্যাল কলেজে ভরতি অইছিলেন। তার তো আবার দুই রকমের অসুখ আছিল। পলিটিক্যাল অসুখ আর আসল অসুখ। সেইবারের অসুখটা মনে অইল আসল অসুখ। আমি তাঁরে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। আমারে দেইখ্যা মওলানা সাহেব খুশি অইল। এই কথা সেই কথা নানান কথা কইবার লাগল। মওলানা কথা কইবার শুরু করলে অন্য মানুষের শুইন্যা যাওন ছাড়া গতি আছিল না। মওলানা এক পর্যায়ে কইলেন, আমি একটা কলেজ দিছি, একটা ব্যাটাছেলেদের একটা মেয়েদের। আমি কইলাম এই কামডা ভালা করছেন। মওলানা সায়েব শুইয়া শুইয়া কথা কইতে আছিলেন। আমার কথা শুইনা উইঠ্যা বইলেন। আমার চৌকের উপর চৌক রাইখ্যা কইলেন তুমি কী কইবার চাও। আমি জবাব দিলাম স্কুল দুইডা কইরা ভালা করছেন। মওলানা সাহেবের সেন্স আছিল খুবই কীন। আকারে ইঙ্গিতে কইলেও ঠিক বুইঝ্যা নিতে পারতেন।

তারপর স্যার বেঙ্গলের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আলোচনা করতে লেগে গেলেন। তিনি বললেন, বেঙ্গলের এন্টায়ার এডুকেশন সিসটেমটাই টপ হেভি। এখানে সাপোর্টিং কোন কলেজ তৈয়ার করনের আগে এইটিন ফিফটি এইটে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি তৈয়ার অইছে। অখন গ্রামে গঞ্জে যেখানে যাইবেন দেখবেন কলেজ অইতাছে। এইগুলা কোনো কামে আইব না। আমাগো দরকার শক্তিশালী মিডল স্কুল। শিক্ষার আসল জায়গাতেই নজর পড়ছে না কারও। বাঙালিদের যেরকম ডিগ্রির ক্রেজ, এইডা নতুন কিছু নয়। কলেজ তৈরি করার আগে ইউনিভার্সিটি তৈয়ার করার কারণে এই ক্রেজ জন্মাইছে। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বাইরে ইন্ডিয়ার অন্য কোনো অঞ্চলে এই ক্রেজ পাইবেন না।

কবেকার সেই কথাগুলো আজো প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। হারায়নি আবেদন।

দেশ এগোচ্ছে। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি অর্থনীতি বেশ বিস্ময়কর। চিরচেনা দারিদ্রের দুষ্টচক্র ভেঙে অর্থ বিত্তে নতুন শ্রেণির উদ্ভব হচ্ছে। তাদের মধ্যে এখন ডিগ্রির ক্রেজ। সবাই উচ্চশিক্ষা নিতে চাইছে। আর শুধু কলেজ নয়, অলিতে-গলিতে শপিং মলে গড়ে উঠা অসংখ্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে এখন জেলায় জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো গোল্ডেন এ প্লাস আর সর্বত্র প্রশ্ন ফাঁসের রমরমা যুগে মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী শিক্ষা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি কিনা। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মানসম্পন্ন সাপোর্টিং স্কুল, কলেজ কই। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার অবস্থা অনেক নাজুক।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনে বলা হয়েছিল, একটি সর্বজনীন শিক্ষাপদ্ধতি গড়ে তোলা-যার লক্ষ্য হলো জনগণকে জাতীয় কর্মে ও উন্নয়নে গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলা, শিক্ষাসূচিকে জনগণের জীবনধারণের সঙ্গে সঙ্গতিপুর্ণ ও জীবনমুখী করতে হবে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে সংস্কার করতে হবে। এসব লক্ষ্যের অনেক কিছুই আজো বাস্তবায়িত হয়নি। রয়েছে নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষা নীতিতেও বলা হয়েছে, “শিক্ষা নীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা।” সুচিন্তিত প্রতিটি শব্দ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের অসম্পূর্ণতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে।

আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ প্রবাসে অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কর্মরত আছেন। তাদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কারিগরি শিক্ষা দিয়ে দক্ষ জনসম্পদ হিসেবে আমরা দেশে বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতাম। লাখ লাখ তরুণ বেকার। বিক্ষুব্ধ। চলমান নানা ইস্যুতে তাদের হতাশা, ক্ষোভ টের পাওয়া যায়। ত্রুটিপূর্ণ মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আরও অনেক ভাববার, যুগোপযোগী ও আধুনিক করবার অবকাশ ছিল। দেশের এক বিশাল অংশ তরুণ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। তাদের জন্য এখনও আমরা আধুনিক, বৈশ্বিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারিনি। সবশেষ কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রির সমমান প্রদান বা স্বীকৃতি মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা ও ভাবনার বহিঃপ্রকাশ কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূলধারার শিক্ষার মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে যথেষ্ট সার্বিক প্রস্তুতি এখনও শিক্ষাপ্রশাসনের নেই। তাই এই স্বীকৃতির সংকটও আছে।

মাধ্যমিক লেভেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ‘পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি’ পরিদর্শনের অংশ হিসেবে চলতি বছরের মার্চ থেকে মধ্য সেপ্টেম্বর- এই সাড়ে ছয় মাসে নানা সময়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দুই শতাধিক(২১৬টি) মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল ও মাদ্রাসা) সরেজমিন পরিদর্শন করার সুযোগ হয়েছে। পরিদর্শনকালে প্রায় পঞ্চাশ হাজারের অধিক শিক্ষার্থী এবং দুই হাজারের অধিক শিক্ষকের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কথা হয়েছে সরকারের হয়ে যারা দেখভাল করেন সে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এই স্বল্প পরিসরে লিখে শেষ করবার নয়।

টপ হেভি শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক লেভেল এখনো অনেক অবহেলিত, নানাভাবে বঞ্চিত। বিগত দুই দশকে সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভূত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক অনেক সীমাবদ্ধতা উৎরানো এখনও সম্ভব হয়নি। চোখে পড়ে। জ্ঞানমুখী শিক্ষা না হয়ে পাশ আর ডিগ্রিমুখী হয়ে গেছে আমাদের শিক্ষা। "যার নাই কোনো গতি তিনি করেন ইমামতি"---প্রবাদের মতই অনিচ্ছুক অনন্যোপায় অনেক মানুষ এই পেশায় নিজেকে পুশ করেছেন। বলাবাহুল্য, যেমন মালী তেমন তার সৃজন, তেমন তার উদ্যান। এজন্য দেশে এত উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরও পশ্চিমের মত প্রত্যাশা মাফিক মৌলিক গবেষক, চিন্তক আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বের হচ্ছেন না। আমরা একটা আপার ক্লাস ক্লার্ক শ্রেণির যোগান দিয়েই যাচ্ছি। বৈশ্বিক মানের স্কলার তৈরি করতে পারছি না।

  • আলমগীর শাহরিয়ার: কবি ও প্রাবন্ধিক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত