ফরিদ আহমেদ

২৯ মার্চ, ২০১৬ ২৩:২২

ভিক্টর ট্রাম্পার : অনন্য এক ক্রিকেটার

জুন ২৮, ১৯১৫ সাল, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
বিষণ্ণ এক সকালে একটা শবযাত্রা যাচ্ছে। তার জন্য শহরের অনেক রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সারা শহরের মানুষ ছুটে এসেছে রাস্তায় শবযাত্রায় অংশ নিতে। সেই সময়কার অস্ট্রেলিয়ার যে ক্রিকেট দল, সেই দলের এগারোজন খেলোয়াড় বয়ে নিয়ে চলেছেন কফিন। কফিনের মাঝে শুয়ে আছেন ক্রিকেটের এক বরপুত্র, সর্বকালের অন্যতম সেরা এক ক্রিকেটার ভিক্টর ট্রাম্পার। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন তিনি। তাঁর এই অকাল মৃত্যু শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, আলোড়ন তুলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে থাকা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডকেও। যুদ্ধকে একপাশে সরিয়ে রেখে সেখানকার পত্রিকাগুলো প্রথম পাতায় তুলে এনেছে ভিক্টর ট্রাম্পারের মৃত্যুর খবর। এক পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে এরকম, ‘ডেথ অব এ গ্রেট ক্রিকেটার।’

তাঁকে গ্রেট ক্রিকেটার বলাটা মৃত্যুকালীন অতিরঞ্জিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন নয়। আসলেই গ্রেট ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। অসাধারণ প্রতিভাবান এবং দারুণ স্টাইলিশ এই ব্যাটসম্যানকে তাঁর সমসাময়িকরাও তো সেরা হিসাবেই বিবেচনা করেই, পরবর্তীকালের অনেকেও তাঁকে স্যার ডন ব্রাডম্যানের চেয়েও মেধাবী ক্রিকেটার হিসাবে গণ্য করে থাকেন। তাঁদের মতে, ভিক্টরের মতো ব্যাটসম্যান আর কখনো আসবে না।

প্রচলিত সব শটের পাশাপাশি বিচিত্র সব অপ্রচলিত শট ছিল তাঁর হাতে। এই সব শটগুলো তিনি ছাড়া আর কেউ খেলতে পারতেন না। এর বাইরে বাজে কন্ডিশন বা বাজে পিচে, যেখানে অন্যেরা খেলতে হিমশিম খেতো, সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে ভালো খেলার সক্ষমতা ছিল তাঁর।

২.
১৮৭৭ সালে সিডনিতে জন্ম তাঁর। টেস্ট ক্রিকেটে ডেব্যু হয় ১৮৯৯ সালে। এই বছরের অস্ট্রেলিয়ান টিমকে এখন পর্যন্ত সর্বকালের অন্যতম সেরা টিমের মর্যাদা দেওয়া হয়। সামারে এই দলের ইংল্যান্ডে যাবার কথা। প্রচণ্ড শক্তিশালী একটা অস্ট্রেলিয়ান টিম আসছে ইংল্যান্ডের মাটিতে, এই খবর পৌঁছে যায় সেখানে। ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত পাঁচ টেস্টের টেস্ট সিরিজ হবে। শক্তিশালী একটা টিম গঠন করার জন্য ইংল্যান্ডে তিন সদস্যের এক সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়। টিম গঠন করার জন্য সিলেকশন কমিটি তৈরির ঘটনা ক্রিকেট ইতিহাসে এটাই প্রথম।

সিলেকশন কমিটির তিন সদস্য হচ্ছেন লর্ড হক, ডাব্লিউ জি গ্রেস এবং এইচ ডাব্লিউ ব্রেইনব্রিজ। মজা হচ্ছে যে, এরা কেউ-ই সাবেক খেলোয়াড় নয়, যেটা এখনকার রেওয়াজ। সিলেকশন কমিটি মানেই সব সাবেক খেলোয়াড়রা সেখানে সদস্য হিসাবে থাকেন। এরা তিনজনই ইংল্যান্ডের সেই টিমের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন। এর মধ্যে ডাব্লিউ জি গ্রেস হচ্ছেন বয়োজ্যেষ্ঠ। তাঁর বয়স তখন একান্ন বছর। ওই বয়সেও খুব ভালো ব্যাট করেন তিনি। সমস্যা হতো শুধু ফিল্ডিং এর সময়। বড়সড় একটা ভুঁড়ি থাকায় কোমর বাঁকা করে ঝুঁকে বল তুলতে পারতেন না তিনি। বল প্রায়শই তাঁকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতো বাউন্ডারি সীমানা পেরিয়ে। দর্শকরা দুয়ো দিতো, হাসাহাসি করতো তাঁর এই হাস্যকর অঙ্গভঙ্গি দেখে।

ইংল্যান্ডের সেই গ্রীষ্মকাল ছিল বৃষ্টিময়। ভেজা কন্ডিশনে খেলতে গিয়ে দুই দলেরই প্রায় সবাই-ই স্ট্রাগল করেছে সেই টেস্টে। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছেন ভিক্টর ট্রাম্পার। অবশ্য প্রথম টেস্টে তিনি সফল ছিলেন না। প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে শূন্য করেন তিনি। দ্বিতীয় ইনিংসে করেন এগারো রান। দ্বিতীয় টেস্ট থেকে দুরন্ত ভাবে ঘুরে দাঁড়ান এই তরুণ। লর্ডসে ১৩৫ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি।

এর দিন কয়েক পরেই অস্ট্রেলিয়ান ড্রেসিং রুমে এসে হাজির ডাব্লিউ জি গ্রেস। বিশাল দাঁড়ির ফাঁক দিয়ে হুংকার ছেড়ে বললেন যে, ভিক্টর ট্রাম্পার যে ব্যাট দিয়ে সেঞ্চুরি করেছে, সেটা তাঁকে দিতে হবে। শুধু যে দিতে হবে তাই নয়, অটোগ্রাফ সহকারে দিতে হবে।

গ্রেস ছিলেন মহা উদ্ধত এবং আত্মকেন্দ্রিক একজন ক্রিকেটার। নিজের ছাড়া অন্যের খেলার প্রশংসা করার ধাত তাঁর ছিল না। তাঁর মতো বর্ণাঢ্য চরিত্র ক্রিকেটে নেই। তাঁর কারণে ক্রিকেটের আইন সবচেয়ে বেশিবার পরিবর্তিত হয়েছে। আম্পায়াররা আউট দিলেও মাঝে মাঝে তিনি আউট হতে অস্বীকার করতেন। আঙুল তুলে আম্পায়ারদেরকেই আউট ঘোষণা করে দিতেন তিনি। সেই সময়কার ক্রিকেট আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ তিনি নিতেন পূর্ণ মাত্রায়।

একবার ব্যাটিং করতে নেমে প্রথম বলেই আউট হয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু ক্রিজ ছেড়ে যাচ্ছেন না। আম্পায়ার শেষে কাছে এসে বলছে যে, ‘আপনি আউট হয়ে গেছেন মিস্টার গ্রেস। দয়া করে ক্রিজ ছেড়ে চলে যান।’

এ কথা শুনেই খেপে গেছেন তিনি। বলেন যে, 'প্রথম বলে আউট আবার আউট কীসের? এটা ট্রায়াল বল। দর্শকরা আমার খেলা দেখতে এসেছে এখানে, আপনার আঙুল উঁচানোর খেলা দেখতে না। আউট না হয়ে, ক্রিজে থেকে নির্বিকার ভাবে খেলা চালিয়ে গেলেন তিনি। এরকম ঘটনা একবার নয়, বেশ কয়েকবারই করেছেন তিনি। তাঁর এই কাণ্ডের কারণে ক্রিকেটে ট্রায়াল বল নামে একটা আইন চালু হয়েছিল। ব্যাটসম্যানের প্রথম বলকে কাউন্ট করা হতো না। অর্থাৎ প্রথম বলে আউট হলেও ব্যাটসম্যান খেলে যেতে পারবেন।

আরেকবার ঘটেছিল অন্য কাণ্ড। ঢিলে ঢালা পোশাক পরে ব্যাটিং করতে নামতেন তিনি। একবার সারের হয়ে খেলতে নেমেছেন তিনি। প্রতিপক্ষ গ্লস্টারশায়ার। ব্যাটের কানায় লেগে বল চলে গেছে তাঁর জামার ভিতরে। ওই অবস্থায় দৌড়ে রান নেওয়া শুরু করেছেন তিনি। গ্লস্টারশায়ারের ফিল্ডারদের বল কোথায় বুঝতে বুঝতেই তিনি সাত রান নিয়ে ফেলেছেন দৌড় দিয়ে। শেষে বিপক্ষ দলের ফিল্ডাররা তাঁকে জাপটে ধরে তাঁর জামার ভিতর থেকে জোর করে বল উদ্ধার করার পরই রান নেওয়া থামে তাঁর। এই ঘটনার পরে ডেড বল আইন আসে ক্রিকেটে। ব্যাটসম্যানের ব্যাটে লেগে তাঁর পোশাকের মধ্যে বল ঢুকে গেলে বল ডেড হয়ে যাবে, কোনো রান নেওয়া যাবে না তখন আর।

এখানেই শেষ নয়। অন্য কীর্তিও করেছেন তিনি। এর জন্যও ক্রিকেটের আইন পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ফিল্ডিং করছিল তাঁর দল। দিনের শেষ বল এসে লাগে ব্যাটসম্যানের পায়ে। পরিষ্কার এলবিডাব্লিউ আউট। কিন্তু তিনি বা তাঁর দলের কেউ-ই লেগ বিফোরের আবেদন জানান না। ফলে, আম্পায়ারও ব্যাটসম্যানকে আউট দেন না। খেলা চলে যায় পরের দিন সকালে।

সকালে খেলা মাত্র শুর হতে যাচ্ছে। বোলার রান আপে দাঁড়িয়ে দৌড় শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় গ্রেস সাহেব দুই হাত উঁচু করে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হাউ’জ দ্যাট?’

আম্পায়ার তাঁর কাণ্ড দেখে হেসে ফেলেছেন। মজা করার স্বরে বললেন , ‘আপনার বোলার বলই করলো না, আর আপনি আগেই আবেদন করে বসে আছেন। বিষয়টা কী মিস্টার গ্রেস? রাতে পানশালায় গিয়ে বেশি পান-টান করেন নাই তো?’

মধুর হাসি দিয়ে গ্রেস সাহেব বলেন, ‘আজকের জন্য আবেদন করি নাই তো। কাল শেষ বলে ব্যাটসম্যান আউট ছিল, সেটার জন্য এখন আবেদন করছি।’

বেচারা আম্পায়ার আর কী করবেন? আউট দিতে বাধ্য হলেন ব্যাটসম্যানকে। কারণ, সত্যি সত্যিই ব্যাটসম্যান আউট ছিল গতকালের ওই বলে।

তবে, এটাই শেষ। আবেদন হতে হবে তাৎক্ষণিক, বাসি হয়ে গেলে আম্পায়ার আর ব্যাটসম্যানকে আউট দেবেন না, এই আইন চালু হয়ে গেলো ক্রিকেটে এর পর থেকেই।

তো, এই গ্রেট গ্রেস সাহেবে নিজে যেচে এসে ভিক্টর ট্রাম্পারের কাছ থেকে তাঁর ব্যাট চেয়ে নিচ্ছেন, সেখানে অটোগ্রাফ নিচ্ছেন। সহজ বিষয় নয়। এখানেই শেষ নয়। ভিক্টরের কাছ থেকে ব্যাট পাবার পরই নিজের একটা ব্যাটও ভিক্টরকে দিলেন তিনি প্রীতি উপহার হিসাবে। সেখানে লিখে দিলেন, ‘ফ্রম টুডে’জ চ্যাম্পিয়ন টু দ্য টুমরো’জ চ্যাম্পিয়ন।’


৩.
সিডনিতে একদিন খেলা হচ্ছে। প্রতিপক্ষ ভিক্টোরিয়া। বৃষ্টির কারণে পিচ ভেজা। ফাস্ট বোলারের জন্য আদর্শ কন্ডিশন। এখনকার মতো সেই সময়ে ফাস্ট বোলারদের নানা বিধি-বিধানের মাধ্যমে খোঁজা করে দেওয়া হয়নি তখন। বল করার জন্য প্রস্তুত ভিক্টোরিয়ার ফাস্ট বোলার জ্যাক স্যান্ডারস।  ভেজা পিচে ব্যাটসম্যানের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন জ্যাক স্যান্ডারস। ব্যাটিং এ রয়েছেন ভিক্টর ট্রাম্পার। এতো গতিতে প্রথম বল গেলো যে ভিক্টর সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হলেন সেই বলে। চকচক করে উঠলো স্যান্ডারসের চোখ। ভিক্টোরিয়ার সব খেলোয়াড়ের মুখে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি। ভিক্টরের মুখেও হাসি দেখা দিলো। চেঁচিয়ে বললেন, ‘একজন পুরনো বন্ধুকে তুমি এমন করতে পারলে? ঠিক আছে, হয় তুমি থাকবে আজ, নয় আমি।’
দুর্দান্ত ফুটওয়ার্ক এবং দুর্ধর্ষ স্ট্রোক-প্লের প্রদর্শনী দেখিয়ে মাত্র এক ঘণ্টায় সেঞ্চুরি করে ফেললেন ভিক্টর ট্রাম্পার সেদিন।

শুধু যে স্থানীয় ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে এমন দুরন্ত ছিলেন তিনি, তা নয়। আন্তর্জাতিক ফাস্ট বোলারদেরও একইভাবে শাসন করতেন তিনি। ১৯০৪ সালের শুরুর দিকে মেলবোর্নের ভেজা পিচে উইলফ্রেড রোডস এবং জর্জ হার্স্টকে মোকাবেলা করেন ভিক্টর। এই দুই ইয়র্কশায়ার বোলার সর্বকালের সেরা বাঁ-হাতি বোলারদের মধ্যে অন্যতম। মেলবোর্নের ভেজা পিচ ব্যাটসম্যানদের জন্য সেরা মরণ ফাঁদ হিসাবে কুখ্যাত ছিল। গুড লেন্থে পিচ করা বল দ্রুতগতিতে লাফিয়ে উঠে ব্যাটসম্যানের চিবুক ছুঁয়ে যেতো।

অস্ট্রেলিয়া এই ভয়ংকর দুই গতি দানবের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে মাত্র ১২২ রান তোলে। এর মধ্যে ভিক্টর ট্রাম্পার একাই করেন ৭৪ রান। ওপেনিং এ নেমেছিলেন তিনি, অপরাজিত ব্যাটসম্যান হিসাবে ফিরে আসেন। ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেন হপকিন্স। সেই সংখ্যাটা হচ্ছে ১৮।

একদিন খেলার সময় ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন পেলহাম ওয়ার্নার জর্জ হার্স্টকে জিজ্ঞেস করলেন যে, ‘তোমার ফিল্ড প্লেসিং কেমন চাও? এর উত্তরে হার্স্ট বললেন, ‘সেভাবে খুশি দিতে পারেন স্যার। এটা কোনো ব্যাপার না। যেভাবেই ফিল্ড প্লেসিং করি না কেন আমরা, ভিক্টর তার ইচ্ছামতো ঠিকই রান নিয়ে যাবে।’

শুধু জর্জ হার্স্ট না, আরেকজন গ্রেট বোলারই একই ধরনের কথা বলেছিলেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘আমি মোটামুটি সব ব্যাটসম্যানকেই দ্রুত রান করা থেকে বিরত রাখতে পারি। কিন্তু ট্রাম্পারের বিপক্ষে আমি সবসময় অসহায় বোধ করি। কারণ, সে অসম্ভব দ্রুত এবং তাঁর হাতে খুব বেশি পরিমাণে স্ট্রোক খেলার ক্ষমতা রয়েছে।’

১৯১০-১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা আসে অস্ট্রেলিয়া সফরে। ভিক্টর তখন তাঁর ফর্মের শীর্ষে। তাঁর দক্ষতার কাছে প্রতি পদে পদে পর্যুদস্ত হয়ে যায় দক্ষিণ আফ্রিকানরা। দক্ষিণ আফ্রিকা দলে বুসি বোলার দিয়ে ভর্তি ছিল। এখন আমরা যেটাকে গুগলি বলি, তখন সেটাকে বুসি বলা হতো। ভিক্টর এদেরকে অনায়াস দক্ষতায় খেলে গেলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক পার্সি শেরওয়েলকেও টিজ করতে ছাড়লেন না তিনি। শেরওয়েল যখনই কোনো জায়গা থেকে কোনো ফিল্ডার সরিয়ে নিয়ে অন্য জায়গায় দিতেন, ভিক্টর ইচ্ছাকৃত ভাবে ঠিক সেই খালি জায়গাতেই বল পাঠাতেন।

আগেই উল্লেখ করেছি যে ভেজা পিচে অন্যেরা যেখানে সংগ্রাম করতো রান করার জন্য কিংবা টিকে থাকার জন্য, সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন ভিক্টর ট্রাম্পার। ১৯০২ সালে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। সেই সামারও ছিল বৃষ্টিময়। ভিক্টর সেই সিরিজে রান করেছিলেন আড়াই হাজারেরও বেশি। র্যালন্সফোর্ড বলেছেন যে, ‘ভিক্টর যদি আরেকটু আগ্রহী হতো তবে হাজার চারেক রান করা তার জন্য কোনো ব্যাপারই ছিল না। সে অতোগুলো শতক হাঁকানোর পরেও তার সর্বোচ্চ রান ছিল মাত্র ১২৮। এই সব শতকের কয়েকটাকেই দ্বিশতক বানানো সম্ভব ছিল তার পক্ষে। কিন্তু, দয়ার সাগর ছিল ভিক্টর। মাঠে তরুণ কোনো খেলোয়াড় কিংবা ভাগ্য বঞ্চিত কোনো খেলোয়াড়কে সে বেছে নিতো এবং তাকে খুশি করার জন্য নিজের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসতো।’

৪.
ভিক্টরের এই কোমল স্বভাবের কথা আরো অনেক ঘটনা থেকেই জানা যায়। মেলবোর্নের দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে খেলার আগে অস্ট্রেলিয়ান দলের ড্রেসিং রুমে কেউ একজন টোকা দিল। ভিক্টরকে কেউ খুঁজছে। তিনি দরজার কাছে গিয়ে দেখেন যে, একটা তরুণ ছেলে কদাকার চেহারার  একটা ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে ব্যাট বানানোর ব্যবসা  শুরু করেছে। এটা তার তৈরি ব্যাট। সে চায় ভিক্টর এই ব্যাটটা দিয়ে টেস্ট ম্যাচটা খেলুক।

ভিক্টর ট্রাম্পারের ব্যাগে সবসময়ই কয়েকটা ব্যাট থাকতো। তা সত্ত্বেওও তরুণ ছেলেটার ব্যাট নিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি তিনি। ব্যাটটা যে শুধু কদাকার দেখতে তাই নয়, এটা ওজনেও ছিল ভীষণ ভারি। তাঁর সহ-খেলোয়াড় বলে যে, তুমি নিশ্চয়ই এই ব্যাট নিয়ে খেলতে নামছো  না? উত্তরে ভিক্টর বলেন যে, ‘এটা দিয়েই খেলছি আমি। তরুণ একটা ছেলে ব্যবসা খুলেছে। এই ব্যাট দিয়ে আমি কিছু রান করলে ওর ব্যবসাতে সুবিধা হতে পারে।’

সেই ব্যাট দিয়ে ৮৭ রান করেছিলেন ভিক্টর। ব্যাটটা ফেরত দিতে তরুণ ব্যাট-ব্যবসায়ীর আনন্দ দেখে কে!

সেই যুগে ক্রিকেট খেলে কামাই রোজগার করা যেতো না তেমন। ক্রিকেটের পাশাপাশি অন্য কাজও করতে হতো প্রায় সব ক্রিকেটারকেই। যেমন, ডাব্লিউ জি গ্রেস পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। ভিক্টর ট্রাম্পারও আয় রোজগারের জন্য খেলাধুলার সরঞ্জাম বিক্রির একটা দোকান খুলে বসেন সিডনিতে। ব্যবসাতেই মন বেশি তাঁর তখন, খেলার দিকে কম।

এরকম একদিন দোকান খুলে বসে আছেন তিনি। হুট করেই মনে পড়লো যে, আজ না টেস্ট খেলা আছে। দোকান থেকে একটা ব্যাট হাতে নিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে গেলেন সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে। অপরাজিত একশো পঁচাশি রান করে ফিরে এলেন তিনি।

টেস্ট ম্যাচ শেষ হবার পর একদিন দোকানে বসে আছেন তিনি। এমন সময় তাঁর এক ভক্ত এসে হাজির দোকানে। তাঁর ব্যবহৃত একটা ব্যাট কেনার ইচ্ছা তার, এটাই জানালো সে।

‘যে ব্যাট দিয়ে সিডনি টেস্টে একশো পঁচাশি রান করলাম, সেটা নেবেন?ভিক্টর ট্রাম্পার জিজ্ঞেস করলেন।
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল ভক্তের। লোভ জাগছে, কিন্তু এর যে দাম হবে, তা নিজের সামর্থ্যে কুলাবে না বলে হতাশার এক বিশাল ছায়াও পড়লো তার চোখে।

‘কতো দাম পড়বে ওর?’আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো ভক্ত।

‘সেটার আসল দাম তো চার পাউন্ড পাঁচ শিলিং।’ভিক্টর ট্রাম্পার বললেন।

‘হ্যাঁ, এখন কতো নেবেন?’শুষ্ক গলায় ভক্ত বলে।

‘এর যেহেতু একবার ব্যবহার করা হয়ে গেছে। এবং আমি অনেকক্ষণই ব্যাট করেছি এটা দিয়ে। সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস। কতো আর দেবেন বলেন?দিন, এক পাউন্ডই দিন এর জন্য।’লাজুক গলায় ভিক্টর বলেন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত