সিলেট টুডে ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক

২১ জুন, ২০১৬ ১৭:১০

খুলির বাইরে মস্তিষ্ক নিয়ে বেড়ে উঠছে এক অদম্য শিশু!

যুক্তরাষ্ট্রে বেড়ে উঠছে এক শিশু, যার মস্তিস্ক খুলির বাইরে!

মাতৃগর্ভে থাকতেই শিশুটির অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করে চিকিৎসকরা তার মাকে গর্ভপাতের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের জেদে পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখার সুযোগ পায় শিশুটি।

জন্মের আগেই যার দুর্ভাগ্যের কথা জেনে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা, সেই শিশুর জন্য পরবর্তী দিনগুলো সুখকর হয়নি। খুলির বাইরে মস্তিস্ক নিয়ে বেড়ে উঠার বিরল রোগে আক্রান্ত হয় সে।

তবে মা-বাবার দৃঢ়তা শিশু বেনটলির জীবন প্রদীপ এখনও জ্বালিয়ে রেখেছে।

শিশুটির বাবা-মায়ের নাম ডাস্টিন এবং সিয়েরা। পঁচিশ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। কলেজ জীবন থেকেই দু'জনের মায়ের বন্ধুত্ব ছিল। ২১ বছর বয়সে ডাস্টিন এবং সিয়েরার বিয়ে হয়। এর দু'মাস পর ঘর আলো করে আসে প্রথম সন্তান বিয়াউ।

সিয়েরা বলেন, প্রথম গর্ভধারনে তাঁর সন্তান জন্মদান ছিল স্বাভাবিক। তাদের সন্তানও ছিল স্বাস্থ্যবান। বিয়াউর জন্মের পর তারা আরেকটি সন্তান জন্ম দেয়ার পরিকল্পনা করেন।

সিয়েরা আরো বলেন, একটি ছোট্ট ছেলে বা মেয়ের জন্য আমরা মরিয়া চেষ্টা করছিলাম। আমরা শুধু এটাই নিশ্চিত করেত চাচ্ছিলাম যে, বিয়াউ'র পাশে একজন কেউ থাকুক।

তিনি বলেন, দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের পর সব কিছুই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। পেটের ভেতরে বাচ্চাটি একের পর এক লাথি দিচ্ছিল। মা-বাবা অনাগত সন্তানের একটি ভালো নামের জন্য তর্কও জুড়ছিলাম।

গর্ভধারণের সাড়ে পাঁচ মাসের মাথায় ডাক্তারের কাছে যান সিয়েরা দম্পতি। চিকিৎসক আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে গর্ভের শিশুটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর তিনি চোখমুখ কালো করে এমন ভয়ের কথা বলেন যে, সিয়েরা দম্পতি ভিত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন।

শিশুটির বাবা ডাস্টিন ইয়োডার বলেন, চিকিৎসকের কথায় মনে হয়েছিল বাচ্চাটির মাথার গঠনে কোনো ত্রুটি হয়েছে। সম্ভবত সে মাথার খুলির উপরের অংশ ছাড়া জন্ম নিতে চলেছে! হয়তো বা এর চেয়েও বড় কোনো ত্রুটি ছিল, যার কিছুই স্পষ্ট ছিল না।

চিকিৎসক সিয়েরা এবং তার স্বামীকে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালে পাঠাতে বলেন। কেন্টন হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানকার নিউরোসার্জন তাদের শিশুটির জন্মগত ত্রুটির কথা জানিয়ে বলেন, তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

চিকিৎসক বলেন, যদি সে বেঁচেও থাকে, তবুও জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে পারবে না।

সিয়েরা বলেন, চিকিৎসকের এমন কথা শুনে আমরা আর কোনো আশাই দেখছিলাম না। চিকিৎসক দম্পতিকে দ্রুত গর্ভপাতের পরামর্শ দেন। গভর্ধারণের পর অনেকটা সময় কেটে গেছে জানিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বলেন চিকিৎসক। গর্ভপাতের সিদ্ধান্তটি ছিল পুরো বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে অন্ধকার দিক। আমরা ওইদিনই সিদ্ধান্ত নিলাম গর্ভপাত করব। আমরা আসলে চাইনি যে, সে এ দুনিয়াতে আসুক এবং কষ্ট করুক।

চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তারা গর্ভপাতের জন্য ২০১৫ সালের ২৬ জুন দিন ধার্য করেন।

গর্ভপাতের সময় ঘনিয়ে আসতেই চিকিৎসক দম্পতিটিকে একটি নির্দেশিকা দেন, যাতে গর্ভপাতের পরে মৃত শিশুটিকে ওই এলাকার কোথায় লাশ দাফন বা দাহ করা হয় তার তথ্য ছিল।

মা সিয়েরার ইচ্ছা ছিল তারা সন্তানকে দাফন করার পরিবর্তে দাহ করবে। তবে সে জন্মের পর মারা গেলেই এমনটি করার কথা ভেবে ছিলেন তিনি।

এদিকে গর্ভপাত করবেন নাকি ত্রুটি নিয়ে জন্মের পর শিশুটি যতক্ষণ বেঁচে থাকবে, ততক্ষণ তাকে বুকে জড়িয়ে রাখবে্ন- এ নিয়ে দ্বিধায় ভুগছিলেন সিয়েরা এবং ডাস্টিন দম্পতি।

সিয়েরা বলেন, গর্ভপাতের আগের রাতে ডাস্টিনকে বললাম-আমি গর্ভপাত করব না। আমার এ কথা শোনার পর তার বুক থেকে লম্বা দীর্ঘশ্বাস নেমে যায়। সে খুবই খুশি হয়ে ওঠে।

তারা সিদ্ধান্ত নেন শিশুটিকে জন্ম দেবেন। তারা এর মধ্যে তার নামও ঠিক করে রাখেন। মা-বাবাই ঠিক করেন তাদের দ্বিতীয় সন্তানটির নাম হবে 'বেনটলি রস ইয়োডার'।

পরে ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর হ্যালোউইনের রাত ৮টায় সিয়েরাকে হাসপাতালের আঁতুড় ঘরে নেয়া হয়। সেখানে রাত সোয়া ৯টায় বেনটলির জন্ম হয়। বাবা ডাস্টিন ইয়োডার বেনটলির নাড়ি কাটেন। পরে নার্স তাকে কম্বলে মুড়িয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা তাকে দু'হাতে জড়িয়ে নেন।

এমনকি জন্মের পর বেনটলিকে কেউ পরিষ্কার করেনি, তার ওজন মাপেনি এবং তার গলা থেকে জন্মকালীন তরল পদার্থ মুছে দেয়নি! কারণ সব সময় একটি শংকা ছিল প্রতিটি মুহূর্তই বেনটলির জীবনের শেষ সময়। যে কোনো সময় সে মারা যেতে পারে। তাই যতক্ষণ সময় থাকে তার স্পর্শ পেতে চাইছিল তারা।

মা সিয়েরা বলেন, বেনটলি জন্মের পর পুরোপুরিই নিখুঁত ছিল। এটা মোটেই ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না,  কতটা সময় সে আমাদের মাঝে ছিল। আমরা শুধু কৃতজ্ঞ ছিলাম যে আমরা তাকে স্পর্শ করতে পেরেছি।

তিনি বলেন, কিন্তু বেনটিল কান্না করছিল, শ্বাস নিচ্ছিল এবং নড়ছিল। আমরা সবাই তার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে ছিলাম। প্রথম চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা আমরা শংকা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম যে কখন কী না জানি ঘটে যায়। কিন্তু কিছুই হয়নি।

পরিবারের সদস্যরা বেনটলির চারপাশে ঘিরে বসেছিল। তবে ৩৬ ঘণ্টা পরও আশংকাজনক কিছু হয়নি এবং সে বেঁচে ছিল।

সিয়েরা বলেন, এরপর করণীয় জানতে চাইলে চিকিৎসক আমাদের বেনটলিকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন এবং তার দেখভালের ব্যবস্থা করতে বলেন।

এরপর শুরু হয় স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে বেনটলির বেঁচে থাকার সংগ্রাম। প্রথমে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ফুসফুসে ইনফেকশন হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক পর্যায়ে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। চিকিৎসকরা শংকিত হয়ে পড়েন যে, যন্ত্রটি ছাড়া সে আর নিজ থেকে শ্বাস নিতে পারবে না। তবে সে এই লড়াইয়েও জিতে যায় বেনটলি।

এরপর এক মাস বয়সে বেনটলিকে কলম্বাসে জাতীয় শিশু হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়।

সিয়েরা জানান, এমআরআই পর্যালোচনা করে নিউরোসার্জন বলেন, বেনটলির মাথার খুলির ভেতর ও বাইরের অংশ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত যে, সে আর বাঁচবে না। ওই সময় আমাদের মধ্যে কোনো আত্মবিশ্বাসই ছিল না।

চার মাসের মাথায় বেনটলিকে ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকে নেয়া হয়। সেখানে একজন সার্জন তার মগজ নিয়ে কাজ করার কথা বলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে কীভাবে মগজকে করোটিতে প্রতিস্থাপিত করতে হয়।

পরে বেনটলিকে বোস্টন শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তার মা-বাবা এমন একটি শল্যচিকিৎসক টিমের সঙ্গে দেখা করেন, যারা প্রতি বছর মস্তিস্ক প্রদাহ সংক্রান্ত কয়েকটি কেস নিয়ে কাজ করেন। সেখানে বোস্টন শিশু হাসপাতালের প্রধান প্লাস্টিক শল্যবিদ জন মেয়ারার বেনটলির জন্য একটি অস্ত্রোপচার কৌশল গ্রহণ করেন।

ওই সময় বেনটরির বয়স ছিল পাঁচ মাস। তার মাথার খুলির বাইরে একটি থলি তৈরি হয়েছিল, যাতে তার মগজের একটি নির্দিষ্ট অংশ রাখা ছিল। মগজের এ অংশ দিয়ে বেনটলির পেশি সঞ্চালন ও তার সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। মগজের অন্য অংশ দিয়ে তার দৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

মস্তিস্ক প্রদাহের অন্যান্য সমস্যার চেয়ে বেনটলির পিণ্ডটি সম্পূর্ণই আলাদা, যা সোনালী রংয়ের চুলের একটি কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে এবং এটি খুলে ফেলা সম্ভব নয়। চিকিৎসক দল একটি থ্রিডি প্রিন্টেড মডেল তৈরি করে তার মাধ্যমে বেনটলির সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করছেন।

চিকিৎসক মেয়ারা বলেন, বেনটলির মগজের একশ' কিউবিক সেন্টিমিটারই খুলির বাইরে অবস্থিত। এ কারণে চিকিৎসকরা তার করোটিকে প্রসারিত করে এর উপযুক্ত করার চেষ্টা করেছেন।

তিনি বলেন, চিকিৎসকরা বেনটলির করোটিকে খাড়াখাড়িভাবে কয়েকটি ভাগ করার চেষ্টা করছেন, যাতে এর ভেতরে আরও জায়গা তৈরি করা যায়। এরপর বিশেষ দ্রবীভূত প্লেট স্থাপন করে তাতে যে খোলা জায়গার সৃষ্টি হবে তাতে বেনটলির মগজ রেখে তা তার করোটিতে প্রতিস্থাপিত করা হবে।

চিকিৎসক বলেন, গত ২৪ মে চিকিৎসক দল কাজ শুরু করেছেন। তারা তার চুল ছেঁটে ফেলেছেন। মাথার পেছনের চামড়া এবং মগজ ঢেকে রাখার পর্দা কেটে ফেলেছেন। তার খুলির ছোট অংশ হল সামনের ডান পাশের লোবটি এবং বড় অংশ হল দৃষ্টি ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রক লোবটি।

চিকিৎসকরা বেনটিলের মগজ থেকে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড বের করে ফেলেছেন। এরপর তারা খুলি কেটে তার মগজ মাথায় প্রতিস্থাপিত করেছে।

চিকিৎসক মেয়ারা বলেন, চিকিৎসক দল কর্তিত হাড়ের অবশিষ্ট দিয়ে মাথার উপরের অংশের ছিদ্র বন্ধ করেছেন। বেশ লম্বা সময় ধরে বেনটলির অস্ত্রোপচার হয়। পরে পাঁচ ঘণ্টার মাথায় সে ফের সুস্থ হয়ে ওঠে।

এই দীর্ঘ সময় ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলেন বেনটলির বাবা-মা, দাদা-দাদি ও বড় ভাই বিয়াউ। সময় বেশি লাগায় তারা আতংকিত ছিলেন।

অপারেশন শেষে কাছে গেলে তারা দেখতে পান, বেনটলিকে ব্যান্ডেজ করে হাসপাতালের একটি পাতলা পোশাকে ঢেকে রাখা হয়েছে।

সিয়েরা বলেন, কাছে গিয়ে দেখতে পাই বেনটলি জেগে আছে এবং আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে শুধু চুপচাপ শুয়ে ছিল।

বেনটলির অস্ত্রোপচারের পর প্রায় এক মাস হতে চলল। তার মা বলেছেন, সে এখন মাথা তুলতে পারে। সে খেতে পারে, হাসতে পারে এবং কথা বলার জন্য গড়গড় শব্দ করতে পারে।

মা আরও বলেন, তার মাথায় চুল গজাচ্ছে। তাকে এখন তার ভাই বিয়াউর মতোই দেখাচ্ছে।

কেউ জানে না বেনটলির ভবিষ্যত কী হবে। তবে তার মা-বাবা আবারও আশাবাদী। মা সিয়েরা বলেন, তার মস্তিস্কটি সত্যিই অন্যদের চেয়ে আলাদা, কাজেই কারও ভবিষ্যতের সঙ্গেই তাকে তুলনা করার কিছু নাই।

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসকরা মনে করছেন বেনটলি একটি জীবন পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে। আমরা একে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিতে চাই।

বেনটলির বয়স এখন সাত মাস এবং সে সুস্থ্যভাবে বেঁচে আছে। বোস্টন শিশু হাসপাতালের প্রধান শিশু নিউরোসার্জন মার্ক প্রোকটর বলেন, বেনটলির অস্ত্রোপচার একটি জীবন রক্ষা পদ্ধতি। তবে সে স্বাভাবিক জীবন পাবে না। তাকে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বেঁচে থাকতে হবে।

উল্লেখ্য, মস্তিস্ক প্রদাহ একটি জন্মগত রোগ, যার ফলে মাতৃগর্ভেই শিশুর খুলিতে মস্তিস্ক ত্রুটিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠে এবং মস্তিস্কের চারপাশে ঠিকমতো হাড় গঠিত হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিরল রোগ সংস্থার মতে, খুলির বাইরে মস্তিস্ক সাধারণত পাতলা চামড়া বা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটিতে প্রতি বছর ৩৭৫ জন বা প্রতি ১০ হাজারে একজন শিশু বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয়। এর মধ্যে রয়েছে দৃষ্টি সমস্যা, খিঁচুনি এবং হাত-পায়ের পেশী দুর্বলতা। তবে এর কারণ জানা যায়নি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত