উজ্জ্বল ধর, ওসমানীনগর

২০ মে, ২০১৬ ০০:২৭

গালিমপুর গণহত্যা দিবস : আজো বাবাকে ভুলতে পারেননি কানাই লাল

‘মাত্র একদিনের ব্যবধানে বাবা অনেক মোটা হয়ে গেছেন। কাঁধে করে নিয়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। আগের দিন এমন সময় আমরা ভাত খাওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। অথচ, এখন তিনি প্রাণহীন একটা দেহ ছাড়া কিছুই নয়। কুশিয়ারা নদীর তীরে কাঁধ থেকে তার লাশটা নামিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। বাবার শরীর ফুলে গেছে, এখানে সেখানে রক্তে দাগ! বাবা-আমার প্রিয় বাবা, কোথায় তুমি! আমার প্রশ্নের উত্তর গড়িয়ে পড়ে চোখের পানিতে। একটা শতচ্ছিন্ন কাপড়ে মুড়িয়ে বাবার লাশটা কুশিয়ারা নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে ভেঙ্গে পড়লাম প্রবল কান্নায়...।’

নিজের মুখটা দু-হাতে ঢেকে পিতৃশোকের কষ্টটা আড়াল করতে চাইলেন কানাই লাল চক্রবর্তী। রক্তঝরা-৭১’এর ২০ মে বালাগঞ্জের ভাটেরা-গালিমপুর গণহত্যায় অনেকের মতো তিনিও হারিয়েছেন তাঁর পিতা অশ্বিনী চক্রবর্তীকে। পিতা-পুত্রের চিরস্থায়ী বন্ধনের প্রতি এখনো তিনি টান অনুভব করেন। আর তাই জীবনের শেষ অধ্যায়ে এসেও শহীদ পিতার কথা বলতে গিয়ে চোখের পানি আড়াল করতে পারেন না কিছুতেই।

তিন বোন, দুই ভাই আর মা-বাবাকে নিয়ে ছিলো কানাই বাবুদের সংসার। পিতা অশ্বিনী চক্রবর্তী ছিলেন পুরোহিত। পৌরহিত্য করে যা আয় হতো তা দিয়েই চলতো পরিবারে ভরন-পোষন। অশ্বিনী বাবু পুত্র-জায়াকে ভালোবাসতেন খুব। মুক্তিযুক্ত যখন শুরু হয় কানাই বাবু তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। এপ্রিলে যখন পাকবাহিনী শেরপুরে বোমা হামলা চালায় তখন অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে চাইলে অশ্বিনী বাবু আপত্তি জানান। কুশিয়ারার এতো পানি ডিঙিয়ে ভাটেরা গালিমপুরে পাকবাহিনী আসতে পারে তা ছিলো তার ভাবনাতীত।

কানাই লাল চক্রবর্তী বলেন, ‘১৯৭১সালের ১৫ মে ধান কাটাকে কেন্দ্র করে ভাটেরা-গালিমপুর আর বল্লভপুর গ্রামবাসীর মধ্যে ঝগড়া হয়। ঝগড়াকে কেন্দ্র করে বল্লভপুরের কয়েকজনের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়। ওই ছেলেরা প্রতিশোধ নিতে চকেরবাজার শান্তি বাহিনীর ক্যাম্পে নালিশ জানায়। তারা অভিযোগ করে ভাটেরা-গালিমপুরে মুজিব বাহিনীর অনেক কর্মী লুকিয়ে আছে। ১৬ মে ভাটেরা গালিমপুরে খবর আসে ধান কাটা নিয়ে যে সালিশ হয়েছে এতে পাকবাহিনী নাখোশ। তারা গ্রামে আসতে চায়। এতে নিরূপায় হয়ে এলাকার লোকজন স্থানীয় দালাল মদরিছ আলীর শ্মরণাপন্ন হন। মদরিছ আলী জানান, ৫হাজার দিতে পারলে পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকবে না এবং গ্রামবাসীতে শান্তি (ড্যা-ি) কার্ড দেওয়া হবে।  ১৮ মে সকালে এলাকার লোকজন টাকার বিনিময়ে সাদিপুর শান্তি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে শান্তি কার্ড সংগ্রহ করে।  কার্ড পেয়ে গ্রামের লোকজনের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। কিন্তু সেটা তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কানাই বাবুর অনেকটা সময় থম ধরে বসে থাকেন। ‘২০মে সকাল তখন ঘড়িতে সোয়া এগারোটার কাছাকাছি। কানাই বাবুর মা রান্না ঘরে ভাত রাঁধতে ব্যস্ত। এমন সময় খবর এলো খোকা দাসের বাড়ির পাশে নৌকা লাগিয়ে পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকেছে। যে যেদিকে পারে পালাচ্ছে। আমাদের রান্না হয়ে আসা ভাত চুলোয় পড়ে থাকলো। পরিবারের সবাই লুকিয়ে পড়েন স্থানীয় সুধাংশু দাসের বাড়ি পেছনের জঙ্গলে। আমি কুশিয়ারা নদীর সামনে গিয়ে পাক সেনাদের দেখে গ্রামের পার্শ্ববর্তী ভৈরবতলীর পাশের একটি বড় গর্তে ঢুকে পড়ি। সে গর্তে আগ থেকেই নারী-পুরুষ-শিশুসহ অসংখ্য ভয়ার্ত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। এক সময় পাক সেনারা ভৈরব মূর্তিতে গুলি করলে প্রায় সাড়ে তিন ফুট উচু মূর্তি বিকট শব্দে ভেঙ্গে পড়ে। এতে ভয় পেয়ে গর্তে লুকিয়ে থাকা শিশুরা কান্না জুড়ে দেয়। এ সময় কান্না বন্ধ করতে অনেক মা তার সন্তানের মুখে কাপড় গুজে দেন। এরপর চারদিক থেকে শুধু গুলির শব্দ আর আগুনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিলো। প্রকৃতপক্ষে কি ঘটছে তা গর্তের ভেতর থেকে অনুমান করা কঠিন। বিকাল প্রায় ৫টার দিকে গুলির শব্দ কমে এলে আমি গর্ত থেকে হয়ে কুশিয়ারা নদী সাতরে ওপারে চলে যাই। সন্ধ্যা ৬টার দিকে পাকবাহিনী চলে গেলে আমি আবারো নদী পাড়ি দিয়ে ভাটেরা গালিমপুরে জানতে পারি বাবা মারা গেছেন। পাকবাহিনী স্থানীয় গুনমনি দাসকে ধাওয়া করে জঙ্গলে ঢুকে এলোমেলো গুলি ছুঁড়ে। ওই জঙ্গলে আমার বাবাসহ আরো অনেকেই ছিলেন।’

কিছুটা সময় নিয়ে আবারো থেমে থেমে কানাই লাল চক্রবর্তী বলেন, ‘সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আমি ওই দিন বাবার লাশ উন্মুক্ত ফেলে রেখে মা ও ভাই-বোনদের নৌকাযোগে কুশিয়ারা নদীর ওপারে এক আত্মীয় বাড়িতে এনে রাখি। পরের দিন সকালে আবার ঘটনাস্থলে এসে দাহ করা বিপজ্জনক ভেবে বাবুল নামের এক ব্যক্তির সহায়তায় বাবার লাশ কুশিয়ারা নদীতে ভাসিয়ে দেই। বাবার লাশ বাসী হবার কারণে ফুলে গিয়েছিলো। কুশিয়ারা নদীর স্রোতে লাশ ভেসে যাচ্ছে-এ দৃশ্যটা একবার দেখে আর পিছু ফিরে তাকাইনি!’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত