সিলেটটুডে ডেস্ক

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১৫:৫৭

যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদ-সাকার ফাঁসির আদেশের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ১৯৭ পৃষ্ঠা ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ২১৭ পৃষ্ঠার আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।

বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রায় প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এর আগে রায়ে স্বাক্ষর করেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ আপিল মামলার রায় প্রদানকারী চার বিচারপতি।

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিরুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন।

গত ১৬ জুন একাত্তরের বদর প্রধান মুজাহিদ এবং ২৯ জুলাই চট্টগ্রাম অঞ্চলের নৃশংসতম মানবতাবিরোধী অপরাধের হোতা সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ।

আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার ফলে কার্যত আজ থেকে দন্ড কার্যকরের দিন গণণা শুরু হলো। আসামী পক্ষ রিভিউর সুযোগ পাবেন, রিভিউ খারিজ হলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সুযোগ পাবেন।

যে অভিযোগে আপিল বিভাগ মুজাহিদের ফাঁসি :
অভিযোগ- ৬: একাত্তরে ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প তৈরি করে। পরবর্তীকালে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠনের পর সদস্যরা সেখানে প্রশিক্ষণ নিতেন। পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি হওয়ার সুবাদে ওই আর্মি ক্যাম্পে নিয়মিত যাতায়াত ছিল মুজাহিদের। সেখানে নিয়মিত ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী নানা অপরাধের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্র করতেন। এ ধরনের পরামর্শ ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী নিধনসহ গণহত্যার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়।

ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির দণ্ড থেকে আপিল বিভাগ আমৃত্যু কারাদণ্ড যে অভিযোগে:
অভিযোগ- ৭: একাত্তরের ১৩ মে মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকার বাহিনী ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানার বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালিয়ে বীরেন্দ্র সাহা, নৃপেন সাহা, শানু সাহা, জগবন্ধু মিত্র, জলাধর মিত্র, সত্যরঞ্জন দাশ, নরদবন্ধু মিত্র, প্রফুল্ল মিত্র, উপেন সাহাকে আটক করে। পরে উপেন সাহার স্ত্রী রাজাকারদের স্বর্ণ ও টাকার বিনিময়ে স্বামীর মুক্তি চাইলেও মুজাহিদের নির্দেশে রাজাকাররা সবাইকেই হত্যা করে। একই সময়ে রাজাকাররা সুনীলকুমার সাহার কন্যা ঝর্ণা রানীকে ধর্ষণ করে। হিন্দুদের বসতঘরে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া অনিল সাহা নামে একজনকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।

ট্রাইব্যুনালের আমৃত্যু কারাদণ্ড আপিল বিভাগে বহাল যে অভিযোগে:
অভিযোগ- ৫: যুদ্ধ চলাকালে সুরকার আলতাফ মাহমুদ, জহিরউদ্দিন জালাল, বদি, রুমি, জুয়েল ও আজাদকে আটক করে ঢাকার নাখালপাড়ায় পুরোনো এমপি হোস্টেলে রাখা হয়। ৩০ অগাস্ট রাত ৮টার দিকে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামি ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি মুজাহিদ ও সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী সেখানে গিয়ে এক সেনা কর্মকর্তাকে পরামর্শ দেন, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগেই তাদের হত্যা করতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সহযোগীদের নিয়ে মুজাহিদ আর্মি ক্যাম্পে আটকদের অমানসিক নির্যাতনের পর জালাল ছাড়া বাকিদের হত্যা করেন।

সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগ:

অভিযোগ ২: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল ভোরে রাউজানের মধ্যগহিরা হিন্দুপাড়ায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামটি ঘিরে ফেলে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের নির্বিচারে গুলি করে। ডা. মাখনলাল শর্মার বাড়ির আঙিনায় এ ঘটনায় পঞ্চবালা শর্মা, সুনীল শর্মা, জ্যেতিলাল শর্মা ও দুলাল শর্মা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বাড়ির মালিক তিন-চারদিন পর মারা যায় এবং জয়ন্ত কুমার শর্মা গুরুতর আহত হন এবং পরবর্তীকালে প্রতিবন্ধী হয়ে যান। এ অভিযোগে তাকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ-৩: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাউজানের গহিরা এলাকায় কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়। প্রার্থনারত অবস্থা থেকে নূতন চন্দ্রকে সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে টেনে বাইরে নিয়ে আসা হয়। এরপর তার নির্দেশে পাকিস্তানী সেনারা নূতন চন্দ্রের ওপর গুলি চালানোর পর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাকে গুলি করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। এ অভিযোগে তাকে ফাঁসি দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ৪: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় সালাউদ্দিন কাদের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ রাউজানের জগৎমল্লপাড়ায় আসেন। ওই সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সালাউদ্দিনের দুই সহযোগী মিটিংয়ের কথা বলে কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায় একত্রিত করে। এরপর গ্রামটি ঘিরে ফেলে তাদের ওপর নির্বচারে গুলি চালানো হয়। এতে তেজেন্দ্র লাল নন্দী, সমীর কান্তি চৌধুরী, অশোক চৌধুরীসহ ৩২ জন নিহত হন। এ অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ৫: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল দুপুর ১টার দিকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তার সহযোগীরা পথ দেখিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের হিন্দুবসতিপূর্ণ বণিকপাড়ায় নিয়ে যান। সেখানে হিন্দুদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হলে নেপাল চন্দ্র ধর, মণীন্দ্র লাল ধর, উপেন্দ্র লাল ধর ও অনীল বরণ ধর নিহত হয়। এ অভিযোগে ফাঁসি দেয় ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বিকাল ৪টা থেকে ৫ টার মধ্যে রাউজানের হিন্দু বসতি ঊনসত্তরপাড়া গ্রামে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় সালাউদ্দিন কাদের ও তার কয়েকজন সহযোগী। মিটিংয়ে যোগ দেয়ার কথা বলে গ্রামের ক্ষিতিশ মহাজনের পুকুরপাড়ে নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ওপর ব্রাশফায়ার করে ৭০ জনকে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে চন্দ্র কুমার পাল, গোপাল মালী, সন্তোষ মালী, বলরাম মালীসহ ৫০ জনের পরিচয় জানা গেলেও বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। এ অভিযোগে তাকে ফাঁসি দেয় ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ৭: ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল দুপুর ১২টার সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে রাউজান পৌরসভা এলাকায় সতীশ চন্দ্র পালিতের বাড়িতে যান সালাউদ্দিন কাদের। এরপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে সতীশের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সালাউদ্দিন কাদের পাকিস্তানী সেনাদেকে বলেন, ‘এ ভয়ঙ্কর লোক এবং একে মেরে ফেলা উচিত’। এসময় পাক সেনারা সতীশ চন্দ্রকে গুলি করে হত্যা করে। পরে লাশ ঘরের ভেতরে রেখেই আগুন লাগিয়ে দেয়। এ অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল, কিন্তু আপিল বিভাগ এ অভিযোগ থেকে সাকা চৌধুরীকে খালাস দেন।

অভিযোগ ৮: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বেলা ১১টায় চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজাফফর তার পরিবারসহ রাউজার থেকে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে হাটহাজারীর তিন রাস্তার মোড় এলাকায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে ও সহযোগিতায় শেখ মুজাফফর ও তার ছেলে শেখ আলমগীরকে তাদের প্রাইভেট কার থেকে নামিয়ে হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপরে বিভিন্ন সময়ে তাদের মুক্তির জন্য সালাউদ্দিন কাদেরের বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কারা দু’জন কখনো ফিরে আসেনি। পরে তাদের দুজনকে হত্যা করা হয়। এ অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ১৭: ১৯৭১ সালের ৫ জুলাই সন্ধ্যা ৭টার দিকে সাহাউদ্দিন কাদের কয়েকজন সহযোগী ও পাকিস্তানী সেনাকে নিয়ে কোতোয়ালি থানার হাজারী লেনে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বাড়ি থেকে অপহরণ করে নাজিমুদ্দিন আহমেদ, সিরাজ, ওয়াহিদ ওরফে জানু পাগলাকে। পরে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ‘গুডস হিল’ এ নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে ওয়াহিদ ওরফে জানুকে ছেড়ে দেয়া হলেও নাজিমুদ্দিন ও সিরাজকে স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। এ অভিযোগে তাকে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

অভিযোগ ১৮: ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন ভোর সাড়ে ৫টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতে চাঁদগাঁও থানাধীন মোহরা গ্রামের মো. সালাহউদ্দিনকে তার বাড়ি থেকে অপহরণ করে ‘গুডস হিল’ এ নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে পাকিস্তানী সেনারা সালাউদ্দিন কাদেরের উপস্থিতিতে তাকে নির্যাতন করে। এরপর হত্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হলে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। এ অভিযোগে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত