সিলেটটুডে ডেস্ক

২৩ জানুয়ারি, ২০২০ ০১:২১

সাত বছর যেতেই বিকল ৬৮৬ কোটি টাকার ডেমু ট্রেন

অনেক স্বপ্ন নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ ২০১৩ সালে রেলের বহরে যুক্ত করে ২০ সেট ডেমু ট্রেন। চীন থেকে আমদানি করা ট্রেনগুলোর আয়ুষ্কাল ২০ বছর ধরা হলেও মাত্র সাত বছরের মাথায় ট্রেনগুলো একে একে নষ্ট হতে চলেছে। এরই মধ্যে নষ্ট হয়েছে ১৩ সেট ডেমু ট্রেন; বাকি সাত সেট চলছে জোড়াতালি দিয়ে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি ২০২০ সালের মধ্যেই চলাচলের উপযোগিতা হারাবে সবগুলো ট্রেন। ফলে ৬৮৬ কোটি টাকার ডেমু ট্রেন প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হতে চলেছে।
 
রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে চীন থেকে ৬৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয়েছিল ২০ সেট মিটারগেজ ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট-ডিইএমইউ) ট্রেন। চীনের সিএনআর টানসান রেলওয়ে ভেহিকল কোম্পানি লিমিটেড থেকে এগুলো কেনা হয়।

আমদানির পর ১৮ সেট ট্রেন পূর্বাঞ্চলে এবং দুই সেট পশ্চিমাঞ্চলে বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত সাত বছরে পূর্বাঞ্চলে ১৮ সেটের মধ্যে ১২ সেট এবং পশ্চিমাঞ্চলে দুই সেটের মধ্যে এক সেট ডেমু ট্রেন নষ্ট হয়ে গেছে।
নিম্নমানের কোচ, মেরামত কারখানা না থাকা, দূরত্ব সীমার চেয়ে বেশি চালানো, ট্রেন পরিচালনায় অদুরদর্শিতা, দেশের বাজারে ডেমু ট্রেনের যন্ত্রপাতির অপর্যাপ্ততা, বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে ডেমু ট্রেনগুলো স্বাভাবিক আয়ুষ্কালের আগেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডেমু ট্রেন সাধারণত স্বল্প দূরত্বের রুটে চলাচলের উপযোগী। কিন্তু   রাজনৈতিক কারণে এসব সার্ভিসকে ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে করে ডেমু কোচের উপর চাপ পড়ে। বছরের অধিকাংশ সময়ই নষ্ট থাকায় চাহিদা থাকলেও ডেমু ট্রেনগুলো ঠিকমত চালাতে পারছে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

তবে যাত্রীদের অভিযোগ, ডেমু ট্রেনে পর্যাপ্ত বাতাস প্রবেশ করতে না পারায় খুব বেশি গরম লাগে।  পরে রেলের মেকানিক্যাল বিভাগ প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে ট্রেনগুলোতে বৈদ্যুতিক পাখা লাগায়। তারপরও ভ্রমণ তেমন স্বস্তিদায়ক না হওয়ায় ধীরে ধীরে ডেমু ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা কমতে থাকে।

নষ্ট হয়ে যাওয়া ডেমু ট্রেনের সংখ্যা নিয়ে রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছেন। তবে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়া ৫২ নম্বর ওয়ার্কিং টাইম টেবিল অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলে ডেমু ট্রেন ব্যবহারের সংখ্যা উল্লেখ আছে ৬ সেট। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪ সেট এবং ঢাকা বিভাগে ২ সেট। পূর্বাঞ্চলের পরিবহন দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেন, বরাদ্দ পাওয়া ১৮ সেটের মধ্যে ওয়ার্কিং টাইম টেবিল অনুযায়ী সচল আছে ৬ সেট। বাকি ১২ সেট নষ্ট হয়ে গেছে।

রেলওয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা ওমর ফারুক নিশ্চিত করেছেন, ‘‘পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলে ১৩ সেট ডেমু ট্রেন নষ্ট হয়ে গেছে।’’

রেলওয়ের পরিবহন দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০১৩ সালে ডেমু ট্রেন আমদানির পর পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম-লাকসাম রুটে দুই সেট, চাঁদপুর-লাকসাম রুটে এক সেট, চাঁদপুর-নোয়াখালী রুটে এক সেট, চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রুটে এক সেট, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটে এক সেট, আখাউড়া-সিলেট রুটে এক সেট, আখাউড়া-ঢাকা-কুমিল্লা রুটে দুই সেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে দুই সেট, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই সেট ট্রেন চলাচল করতো। পুর্বাঞ্চলে অতিরিক্ত বরাদ্দ হিসেবে থাকতো আরও পাঁচ সেট।

ডেমু ট্রেন স্বল্পতায় রেলওয়ের নতুন টাইম টেবিল অনুযায়ী চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম এবং ঢাকা- ময়মনসিংহ রুটে ডেমু ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

রেলওয়ের পরিবহন এবং বাণিজ্য বিভাগের একাধিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, নষ্ট হওয়া ডেমু ট্রেনগুলো লোকোমেটিভ কারখানায় মেরামত করা হয়। তবে পাহাড়তলী লোকোমেটিভ কারখানার ডিভিশনাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজ আহমদে বলেন, ‘‘লোকোমেটিভ কারখানায় ডেমু ট্রেন মেরামত করা যায় না।’’ গত ১৩ জানুয়ারি সকালে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীস্থ লোকোমেটিভ কারখানায় সরেজমিনে দেখা যায়, সেখানে ছিল চার সেট ডেমু ট্রেন। এর মধ্যে তিনসেট পুরোপুরি নষ্ট। এক সেট মেরামতের জন্য কারখানার শেডে রাখা হয়েছে। কারখানায় রাখা তিন সেট ডেমু ট্রেনের সামনের অংশে শ্যাওলা পড়ে গেছে। বিভিন্ন ভাঙা অংশে দেখা যায়, হার্ডবোর্ড দিয়ে বডি তৈরি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন না চলার কারণে ট্রেনের ভেতরে জমে আছে ময়লার স্তুপ। খুলে আছে বগির বিভিন্ন দরজাসহ বিভিন্ন অংশ।

কারখানায় কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক জানান, প্রতিদিন অন্তত এক সেট ডেমু ট্রেন মেরামতের জন্য কারখানায় আনা হয়। এছাড়া পুরোপুরি নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে তিন সেট ট্রেন।

মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে লোকোমেটিভ কারখানায় ডেমু ট্রেন মেরামত করা হয় না দাবি করলেও সরেজমিনে কারখানায় যাওয়ার পর ডিভিশনাল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ফয়েজ আহমদ বলেন, ‘‘কারখানায় ডেমু ট্রেনের লাইট (সামান্য) মেরামতের কাজ করা হয়।’’ পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা তিনসেট ডেমু ট্রেনকেও সচল বলে দাবি করেন তিনি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (সিএমই) মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগে ১১ সেটের মধ্যে পাঁচ সেট ও ঢাকা বিভাগের নয় সেটের মধ্যে ছয় সেট চালু আছে। দুই বিভাগে নয় সেট নষ্ট। এছাড়া আরো ৪ সেট রানিং ডেমেজ।’’

মিজানুর রহমান আরও বলেন, ডেমু ট্রেন মেরামতের জন্য প্রয়োজন আলাদা ওয়ার্কশপ। ট্রেন আমাদানি হলেও মেরামতের জন্য এখনো কারখানা স্থাপন হয়নি। বরাদ্দ দেওয়া হয়নি আলাদা বাজেটও। ফলে লোকোমেটিভ কারখানায় জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা হচ্ছে সচল ট্রেনগুলো।

রেলওয়ে পরিবহন দপ্তরের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যেসব ডেমু ট্রেন সচল আছে সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। চলতি বছরেই বাকি সাত সেট ডেমু ট্রেন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাবে।  

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২০১৩ সালে চীন থেকে ৬৮৬ কোটি টাকা ব্যায়ে কেনা হয়েছিলো ২০ সেট মিটারগেজ ডেমু (ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট - ডিইএমইউ) ট্রেন। চীনের সিএনআর টানসান রেলওয়ে ভিহকিল কোম্পানি থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হয়। প্রতি সেট ট্রেনে দুই মুখে দুটি ইঞ্জিনসহ তিনটি কোচ থাকে। ইঞ্জিন সম্বলিত কোচেও যাত্রী পরিবহন করা হয়।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ১০ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ায় ৫২ নম্বর ওয়ার্কিং টাইম টেবিল অনুযায়ী পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম এবং ঢাকা বিভাগে আন্তঃনগর, মেইল ও এক্সপ্রেস, ডেমু, লোকাল ও মিক্সড ট্রেন ব্যবহার হয় ৭৫টি।

এর মধ্যে আন্তঃনগর ট্রেন ঢাকা বিভাগে ১৯টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫টি সহ ২৪টি, মেইল ও এক্সপ্রেস ট্রেন ঢাকা বিভাগে ১৬টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১টি সহ মোট ২৭টি, ডেমু ট্রেন ঢাকা বিভাগে ২টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪টি সহ ৬টি, লোকাল ও মিক্সড ট্রেন ঢাকা বিভাগে ৮টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০টি সহ ১৮টি ব্যবহার হয়।
এ সব ট্রেনে লোকোমেটিভ (ইঞ্জিন) ব্যবহার হয় ৭২টি। তার মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৩টি এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৯টি। যাত্রীবাহী বগি ব্যবহার হয় ৮৯৭টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৫৫৪টি ও চট্টগ্রাম বিভাগে ৩৪৩টি বগি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত