নিজস্ব প্রতিবেদক

২১ অক্টোবর, ২০১৬ ১০:১৫

আশরাফ, কাদের নাকি তৃতীয় কেউ

‘উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে চলেছি দুর্বার, এখন সময় বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার’- এই স্লোগানকে ধারণ করে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী ২০তম জাতীয় সম্মেলন শুরু হচ্ছে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে এ সম্মেলন। ব্যাপক প্রচারণা আর জমকালো আয়োজনের এই সম্মেলনে আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে সাধারণ সম্পাদক পদটি। কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক?- এটিই এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন।

সাধারণ সম্পাদককেন্দ্রীক এসব আলোচনা আবার বেশিরভাগক্ষেত্রেই ঘুরপাক খাচ্ছে দুটি নামে। সৈয়দ আশরাফুল হক আর ওবায়দুল কাদের।

ওবায়দুল কাদেরের অনুসারীরা তো রীতিমত তাঁকে নতুন সাধারণ সম্পাদক ধরে নিয়ে ফেসবুকে অভিনন্দন জানাতে শুরু করে দিয়েছেন। আর বরাবরের মতোই এসব ব্যাপারে নিশ্চুপ সৈয়দ আশরাফ।

আশরাফ, কাদের, নাকি তৃতীয় কেউ- এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন শেখ হাসিনাকেই। আর এজন্য নেতাকর্মীদের অপেক্ষা করতে হবে আরো কয়েকটা ঘন্টা।

সম্মেলনকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। মঞ্চ সাজ-সজ্জা থেকে শুরু করে গঠনতন্ত্র, ঘোষণাপত্র সংশোধন-সংযুক্ত, আপ্যায়নসহ সম্মেলনের সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।

সম্মেলনের স্থান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ রাজধানী জুড়ে সাজ-সজ্জার পাশাপাশি রাজধানীর অধিকাংশ রাস্তা সেজেছে বর্ণিল সাজে। রাস্তায়-রাস্তায় পোস্টার, বিলবোর্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রীর আইটি উপদেষ্টা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এবং কোথাও কোথাও বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানার ছবি শোভা পাচ্ছে।

উদ্যানকে ঘিরে ৭ টি প্রবেশপথ রাখা হয়েছে। এই প্রবেশ পথগুলোতে নির্মাণ করা হয়েছে সুসজ্জিত তোরণ। উদ্যানের ভেতরে তৈরি হচ্ছে বিশাল সম্মেলন মঞ্চ। এই মঞ্চটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার আদলে। মঞ্চটি লম্বা ১৫০ ফুট, চওড়ায় ৮৪ ফুট। মঞ্চের ছাদের উচ্চতা ৪২ ফুট। মঞ্চটি আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন করা হচ্ছে। মঞ্চে ৬০ জন নেতার বসার ব্যবস্থা থাকবে। মঞ্চের সামনে প্রস্তুত করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল।

আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে কেন্দ্রীয় নেতা, কাউন্সিলর, ডেলিগেট, দেশি-বিদেশি অতিথি ও দলের সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী সব মিলিয়ে ৬০-৭০ হাজার মানুষের সমাগম হবে বলে আশা করেছেন দলের নেতারা।

এদিকে, গঠনতন্ত্র সংশোধন করে দলের কার্যনির্বাহী সংসদে পরিসর ৭৩ থেকে বাড়িয়ে ৮১ সদস্যের প্রস্তাব করা হয়েছে। এরমধ্যে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সংখ্যা ১৫ জন থেকে বাড়িয়ে ১৯ জন, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক তিন থেকে বেড়ে চারজন, সাংগঠনিক সম্পাদক সাত থেকে আটজন এবং কার্যনির্বাহী সদস্য আরও দু’জন বাড়ানো হচ্ছে।

সভাপতি পদে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শেখ হাসিনা
আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও সম্প্রতি দু’টি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, দল তাকে অবসরের সুযোগ দিলে খুশি হবেন। তবে শেখ হাসিনার একথা মানতে পারেন নি কেউ, তাছাড়া দলের মধ্যেও বিকল্প কোনো নেতৃত্বও তৈরি না হওয়ায় তিনিই হচ্ছেন সভাপতি, এটা এক প্রকার নিশ্চিত!

আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনা যতদিন বেঁচে থাকবেন- তাকে এ পদে থাকতেই হবে। আওয়ামী লীগে এখনো শেখ হাসিনার বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। সুতরাং, তিনি চাইলেও তাঁকে ছাড়া হবে না।

জানা যায়, শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কেউ সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি, এবারও করবেন না। শেখ হাসিনাকেই সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হবে।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের দুর্দিনে দলের হাল ধরেছিলেন দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৭ মে দেশে ফিরে দলের দায়িত্ব নেন তিনি। এরপর ১৯৮৭, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০২, ২০০৯ এবং ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা।
সম্মেলনের আগ মুহূর্তে গত শনিবার (১৫ অক্টোবর) আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির বৈঠকের শুরুতে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘১৯৮১ থেকে ২০১৬- ৩৫ বছর, আর কতো?' গত ২ অক্টোবর গণভবনে সংবাদ সম্মেলনেও শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘দল যদি আমাকে অবসরের সুযোগ দেয়, তাহলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবো’।

কাউন্সিলর রেহানা, জয়
এতদিন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর হিসেবে শুধুমাত্র শেখ হাসিনা থাকলেও এবার বঙ্গবন্ধুর আরেক কন্যা শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও কাউন্সিলর হিসেবে থাকছেন। তবে তাদের বাইরে শেখ রেহানা পুত্র ববি ও শেখ হাসিনা কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে প্রথমে কাউন্সিলর করা হলেও তারা তাদের চাকুরিজনিত কারণে কাউন্সিলর হতে পারেন নি। ববি ও পুতুল জাতিসংঘের দুই সংস্থায় চাকুরি করেন।

কে হচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক
আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন ঘিরে কে হচ্ছেন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক? সেই প্রশ্নই এখন ঘুরে ফিরে সরব কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের মুখে। অনেকের নাম আসলেও ঘুরেফিরে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম হচ্ছে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে অনেকেই বলছেন এ পদে চমক আসতে পারে। তার আগে এই পদ পেতে দৌড়ঝাঁপের তালিকায় ছিলেন প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীসহ অন্তত ৮জন।

সাধারণ সম্পাদক পদে সৈয়দ আশরাফের বিকল্প হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে ঘিরেই গুঞ্জনের মাত্রাটা বেশি। তবে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘মিট দি প্রেস’ এ ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তিনি দলের জাতীয় সম্মেলনে ‘কোনো’ পদেই প্রার্থী নন।

কাদের বলেছিলেন ‘আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন নিয়ে আমাকে বিব্রতকর ও লজ্জায় পড়তে হয়। যখন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার নাম আলাপ আলোচনা আসে। পত্রিকায় ছবি বের হয়। আমি ওমুকের প্রতিদ্বন্দ্বী। এটা আমাকে বিব্রত করে। স্পষ্ট করেই বলছি, আমি আওয়ামী লীগের কোনো পদে প্রার্থী নই।”

এদিকে, আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ‘সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির’ সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে।‘

বিএনপিকে আমন্ত্রণ
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে চিঠি দিয়ে সম্মেলনের আমন্ত্রণ জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) বেলা সোয়া ১১টায় নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেন দলের উপ-দফতর সম্পাদক অ্যাড. মৃণাল কান্তি দাসের নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী ছাড়া দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে সম্মেলনের আমন্ত্রণ করা হয়েছে জানিয়েছেন এ আওয়ামী লীগ নেতা।

সম্মেলনে ১১ দেশের রাজনীতিক
আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনে ১১টি দেশের ৫৩টি রাজনৈতিক দলের ৫৫ জন বিদেশি উপস্থিত থাকবেন বলে জানিয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। বৃহস্পতিবার বিকেলে সম্মেলনস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পরিদর্শন শেষে মোহাম্মদ নাসিম এ তথ্য জানান।
আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, এবারের কাউন্সিলে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা (ডেলিগেট) উপস্থিত থাকবেন।

নিরাপত্তার চাদরে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান
আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও এর আশপাশের এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। উদ্যানে প্রবেশের ৭টি প্রবেশমুখে আর্চওয়ে গেট লাগানো থাকছে। পুলিশ সদস্যরা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে আগতদের দেহ তল্লাশি করে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।

নিরাপত্তার সার্বিক বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, শাহবাগ মোড়, মৎস্য ভবন মোড়, দোয়েল চত্বর, টিএসসিসহ পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্লোজ সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। পুরো এলাকাটি সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের জন্য তিনটি কন্ট্রোলরুম থাকবে। এসব ফুটেজ পর্যালোচনা করতে তিনজন আইটি এক্সপার্ট কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকবেন। এই এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। ব্যাগ, পোটলা, ধারালো অস্ত্র ও দাহ্য পদার্থ নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এমনকি লাইসেন্স করা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও ঢুকতে দেওয়া হবে না।

সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ আশপাশের এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ১০ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। তবে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিরাপত্তার নির্দেশনা দেবে। শাহবাগ থানায় পুলিশ ফোর্স মজুদ রাখা হবে। উদ্যানের ভেতরে প্যান্ডেল ও সম্মেলনের নিরাপত্তায় ডিএমপির পুলিশ ছাড়াও পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী স্পেশাল ওয়েপুন অ্যান্ড ট্যাক্টিক্স (সোয়াট) টিম, স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), পুলিশ ও র‍্যাবের ডগ স্কোয়াড।

উদ্যানে প্রবেশের ৭টি প্রবেশমুখের মধ্যে শিখা চিরন্তনের গেট দিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ ভিভিআইপি ও ভিআইপিরা গাড়িসহ প্রবেশ করবেন। ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের গেট দিতে বিভিন্ন জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক গাড়ি রেখে প্রবেশ করবেন। তাদের জন্য উদ্যানের ভেতরে স্যাটেল বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই বাসে করে তাদের গেট থেকে মঞ্চে নেওয়া হবে।

সম্মেলনের আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুক্রবার (২১ অক্টোবর) থেকে উদ্যানের দায়িত্ব নেবে ডিএমপি। ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের সোয়াট টিম, বোম ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড দিয়ে পুরো উদ্যান সুইপিং করা হবে। সেদিন থেকে কোনো অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না। পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছাড়াও সম্মেলনে নিরাপত্তায় যুবলীগ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের স্বেচ্ছাসেবকেরা একসঙ্গে কাজ করবে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত