নিজস্ব প্রতিবেদক

০৮ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:৪৭

টিলাগড় ছাত্রলীগকে সামলাবে কে?

টিলাগড়ে ৪ মাসে ৩ খুন

কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না সিলেটে ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপকে। বেপোরোয়া হয়ে ওঠা ছাত্রলীগের এই গ্রুপের আভ্যন্তরীন বিরোধে একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেই চলছে। সংঘাত-সহিংসতা তো লেগে আছে নিয়মিতই।

সিলেটে আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে ‘টিলাগড় ছাত্রলীগ’। ছাত্রলীগের এই বলয়ের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাস ও অপকর্মে বিতর্কে জড়াচ্ছে পুরো ছাত্রলীগ। টিলাগড়কেন্দ্রীক আওয়ামী লীগের দুই নেতার বিরোধের কারণে নিয়মিতই সংঘাতে জড়াচ্ছে তাদের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতারা। সংঘাত, প্রাণহানি, ছাত্রাবাস ভাংচুরসহ বিভিন্ন ধরণের অপকর্ম করেও শুধু নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। ফলে ধারাবাহিকভাবেই ঘটছে সংঘাত।

টিলাগড় গ্রুপের বিরোধের বলি হয়ে সর্বশেষ প্রাণ হারালেন সিলেট সরকারী কলেজ ছাত্রলীগের নেতা তানিম খান। রোববার রাত ৯ টায় নগরীর টিলাগড়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছুরিকাঘাতে খুন হন তানিম।

তানিম সিলেট সরকারি কলেজের বিএ পাস কোর্সের ছাত্র এবং সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার বুরুঙ্গা ইউনিয়নের নিজ বুরুঙ্গা গ্রামের ইসরাইল খানের ছেলে। তিনি শহরতলীর ইসলামপুর এলাকায় একটি মেসে থাতকতেন বলে তার সহপাঠিরা জানিয়েছেন। নিহত তানিম জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিরন মাহমুদ নিপু গ্রুপের কর্মী। অপরদিকে তার উপর হামালকারীরা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরী অনুসারী বলে জানা গেছে।

টিলাগড় এলাকায় ছাত্রলীগের আভ্যন্তরীন বিরোধ নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ ছাত্রলীগের দুটি অংশের মধ্যে। সিলেটের প্রধান দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমসি কলেজ ও সিলেট সরকারী কলেজের অবস্থান টিলাগড়ে। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অবস্থানও এই এলাকায়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার নিয়েই দ্বন্দ্বে জড়ায় ছাত্রলীগের দুটি অংশ। এই বিরোধ যেনো কিছুতেই থামছে না। থামছে না প্রাণহানিও।

এরআগে গত ১৬ অক্টোবর টিরাগড়েই রায়হান অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় খুন হন নিপু অনুসারী ছাত্রলীগ কর্মী ওমর ফারুক মিয়াদ। এই হত্যাকন্ডের পর জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীণ সাধারণ সম্পাদক এম. রায়হান চৌধুরীকে প্রধান আসামী করে মামলাও দায়ের হয়। মিয়াদ হত্যকান্ডের জেরে বাতিল করা হয় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের কমিটিও। এতো কিছুর পরও টিলাগড় এলাকায় ছাত্রলীগের সংঘাত থামছে না।

গত ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও টিলাগড়ে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। এদিন এমসি কলেজ এলাকায় প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়া দেয় দুই পক্ষ। একে অপরকে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ককটেল বিস্ফোরণ করে। এই ঘটনার জের ধরেই রোববারে হত্যাকান্ডের সূত্রপাত বলে জানা গেছে।

জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হিরন মাহমুদ নিপু বলেন, গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন এমসি কলেজের প্রবেশ করতে না পেরেই রায়হান অনুসারী বহিরাগতরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে তানিমকে হত্যা করেছে।

অভিযোগের ব্যাপারে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম রায়হান চৌধুরীর সাথে যোগােযাগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

সিলেট মহানগর পুলিশের শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন  জানান, রাত ৯টার দিকে একদল দুবৃত্ত টিলাগড় এলাকার রাজমহল মিষ্টিঘরের সামনে তানিমকে ছুরিকাঘাত করে। গুরুতর আহতাবস্থায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেলে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, মরদেহ ময়না তদন্তের জন্য ওসমানী হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়েছে।
 
জানা যায়, টিলাগড় ছাত্রলীগের একটি অংশকে নেতৃত্ব দেন হিরন মাহমুদ নিপু। যিনি সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক এডভোকেট রনজিত সরকার অনুসারী বলে পরিচিত। আর অপর অংশের নেতৃত্ব রয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম. রায়হান আহমদ চৌধুরী। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও সিটি কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই ২০১০ সালে টিলাগড়ে ছাত্রলীগের কোন্দলে খুন হন এমসি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। এরপর থেকেই বেপরোয়া টিলাগড়ের ছাত্রলীগ। এমসি কলেজের হল পোড়ানো, হল ভাংচুর, অস্ত্রবাজি, খুন- সকল অপকর্মেই এগিয়ে টিলাগড় ছাত্রলীগ।

টিলাগড় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অতিষ্ঠ টিলাগড় এলাকার ব্যবসায়ীরা। প্রায়ই নিজেদের মধ্যে মারামারি থেকে টিলাগড় এলাকায় দোকান ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে।

গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জ এলাকায় প্রতিপক্ষ গ্রুপের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ছাত্রলীগের কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। মাসুম হত্যার এক মাস পূর্ণ হতে না হতেই ১৬ অক্টোবর কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ এর অফিসের সামনে প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন হিরণ মাহমুদ নিপু গ্রুপের ছাত্রলীগ কর্মী ওমর আহমদ মিয়াদ।

এরআগে ২০১২ সালের ৮ জুলাই রাতে শিবির তাড়ানোর নামে মুরারি চাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসের ৩টি ব্লকের ৪২টি কক্ষ পুড়িয়ে দেয় ছাত্রলীগ।

ভস্মীভূত ছাত্রাবাস পুনর্নির্মাণ করা হলে গত ১৩ জুলাই ছাত্রাবাসের দরজা জানালা ভাংচুর করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। বন্ধ হয়ে যায় ছাত্রাবাস।

এভাবে একের পর অপকর্মে জড়াচ্ছে বেপরোয়া হয়ে উঠা ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপ। নানা অপকর্ম চালিয়ে গেলেও তাদের বিরুদ্ধে নেই কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা। খুন করেও ধরা পড়ে না আসামীরা।

এব্যাপারে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের সাথে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত