নিজস্ব প্রতিবেদক

১৪ এপ্রিল, ২০২১ ১৪:৫০

উৎসবহীন বর্ষবরণ

কোনো আয়োজন নেই। তবু নতুন বছরে নিজেকে রাঙাতে ফুলের দোকানে দুই তরুণী। ছবিটি মঙ্গলবার চৌহাট্টা থেকে তোলা

সড়ক সুনশান। কোথাও মঙ্গল শোভাযাত্রা নেই, ঢাক-ঢোলের আওয়াজ নেই। মাঝেমাঝে পুলিশের বাঁশির শব্দ ভেসে আসছে কেবল।

ক্যাম্পাসগুলোও ফাঁকা। মেলা নেই, সাউন্ড সিস্টেম থেকে ভেসে আসা বাউল সুর নেই, শাড়ি আর পাঞ্জাবি পড়া তরুণ-তরুণীদের ভিড়ও নেই- এ যেনো এক অন্য পহেলা বৈশাখ। অন্য নববর্ষ।

অনলাইনে কেউ গাইছে হয়তো, কিন্তু জনারণ্য থেকে ভেসে আসছে না বৈশাখের সেই আগমনী গান- ‘এসো হে বৈশাখ’, কোথাও বাজছে না- ‘মেলাই যাইরে’। সুর নেই, রং নেই, প্রাণের উচ্ছ্বাস নেই- তবু আজ নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়। আজ পূর্বদিগন্তে যে সূর্য উদিত হয়েছে, তা প্রতিদিনকার মতো হলেও, সে নিয়ে এসেছে এক নতুন বার্তা। নতুন দিনের বার্তা। এ নতুন বছরের প্রথম সূর্যোদয়।

এক আজব অসুখ এসেছে পৃথিবীতে। যা কেড়ে নিয়েছে মানুষের সব উদযাপন আর উৎসব। রুদ্ধ করে দিয়েছে মানুষে মানুষে মিলনের পথ। করোনাভাইরাস নামক সেই অনুজীবের কারণে এবারও পহেলা বৈশাখ, যা কি না বাঙালির সার্বজনীন উৎসব- তা পালিত হচ্ছে উৎসবহীনভাবে। গৃহবন্দি থেকে। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই যে দেশে শুরু হলো ‘কঠোর লকডাউন’। ফলে এবার ভিড়ে নয়, নীড়েই পালিত হচ্ছে বর্ষবরণ উৎসব।

বাঙালির আত্মোপোলব্দি আর আত্মজাগরণের কবি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী-কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ!’

কিন্তু এবার প্রতিদিনকার ক্ষুদ্র মানুষের মহৎ হয়ে ওঠার আর সুযোগ কই! সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হওয়ার সুযোগই যে বন্ধ! মিলনের এই উৎসবের দিনেও শহরে মাইক লাগিয়ে প্রচারণা চলছে- ‘দুরত্ব বজায় রাখুন’, ‘জনসমাগম এড়িয়ে চলুন’।

গতবছরও এমন হয়েছিলো। করোনার কারণে গত নববর্ষও কেটেছে ঘরে বসে। উৎসবহীনভাবে। গতবছর মনে হয়েছিলো- এইবছরটা অন্তত বেঁচে থাকা যাক। আগামীবার উৎসব হবে। কিন্তু করোনা এমন ঘাঁটি গেড়েছে যে, তা আর সহজে যেতে চাচ্ছে না। এবার বরং আরও ঝেকে বসেছে। ফলে আজ থেকে ঘর হতে বের হওয়া বারণ।

সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু মনে করেন, আগে জীবন। পরে উৎসব। বেঁচে থাকলে অনেক উৎসব করা যাবে। আর বেঁচে থাকার জন্য এখন ঘরে থাকা প্রয়োজন।

তিনি বলেন, প্রতিবছর আমরা বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের আয়োজন করি। এবারা সব প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও করোনার কারণে উৎসব আয়োজন বন্ধ রেখেছি। আশাকরছি আগামী বছর করোনা চলে যাবে। আগামী বছর আরও বড় করে উৎসব হবে।

ঢাকায় যেমন ছায়ানট, তেমনি সিলেটে বর্ষবরণ উৎসবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে ‘আনন্দলোক’। রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চাকারী এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতিবছর ‘শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজ মাঠে’ আয়োজন করে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। গতবছর থেকে যা বন্ধ রয়েছে।

করোনার কারণে টানা দুই বছর ধরে উৎসব বন্ধ। এই আয়োজন নিয়ে রয়েছে মৌলবাদী গোষ্টির অপপ্রচারও। তবে এগুলো বর্ষবরণ উৎসবে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন আনন্দলোকের প্রতিষ্ঠাতা রানা কুমার সিনহা। করোনা চলে গেলেই আরও উৎসবের আমেজে বর্ষবরণ করা হবে বলে মত তার।

রানা কুমার সিনহা বলেন বলেন, এই যে দুবছর ধরে উৎসব হচ্ছে না এজন্য সবার মনের ভেতরেই একটা খারাপ লাগা আছে। করোনা চলে গেলে মুক্ত হাওয়ায় উদযাপনের তাড়না আছে। এটা সব সম্প্রদায়ের সকল বাঙালির উৎসব। এটা সবসময়ই থাকবে।

তিনি বলেন, কুপমুন্ডকরা একটু বিরক্তির তৈরি করতে পারে হয়তো তবে বর্ষবরণ উৎসব কখনো বন্ধ হবে না। কারণ বেশিরভাগ বাঙালিই উৎসবপ্রিয়।

একই মত সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশুরও। তিনি বলেন, মৌলবাদের কারণে কখনোই বর্ষবরণ উৎসব বাধাগ্রস্থ হবে না। বর্ষবরণ নিয়ে বাঙালির উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা রয়েছে। তরুণরা এই উৎসবের শক্তি। তারাই এটি টিকিয়ে রাখবে। এক্ষেত্রে সংস্কৃতিকর্মীদেরও অগ্রণী ভ’মিকা পালন করতে হবে।

প্রতিবছর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিন ব্রিজের কাছে সুরমা নদীর পাড়ে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়।
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ ও সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ণাঢ্য আয়োজনে নতুন বছরকে বরণ করা হয়। এই দুই ক্যাম্পাসে তারুণ্যের ভিড় থাকে সর্বাধিক।

এ ছাড়া বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনও আলাদা আলাদাভাবে বর্ষবরণের আয়োজন করে। তবে দুবছর ধরে এসব আয়োজন বন্ধ।

নতুন বছরের প্রথম দিনে দোকানে দোকানে হালখাতাও বাঙালির ঐতিহ্য। দোকানে আসা ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করানো হয়, মিস্টি খেয়ে পুরনো ক্রেতারা পরিশোধ করে যান বকেয়া টাকা। করোনার কারণে দুই বছর ধরে এই আয়োজনও বন্ধ রয়েছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত