নিজস্ব প্রতিবেদক

১৯ নভেম্বর, ২০১৭ ২৩:১৩

এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগকারীদের ১৯ জনই শিবির নেতা!

ছাত্রলীগের আর ছাত্রশিবির নেতাকর্মীরা মিলেই অগ্নিসংযোগ করে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের ছাত্রাবাস। ২০১২ সালের ৮ জুলাই ন্যাক্কারজনক এই ঘটনার পাঁচ বছর পর বিচার বিভাগীয় তদন্তে অগ্নিসংযোগের সাথে ছাত্রলীগ ও শিবিরের সম্পৃক্ততা মিলেছে।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ছাত্রাবাসে আগুন লাগানোর জন্য যে ২৯ জনকে চিহ্নিত করেছে তাদের মধ্যে ১৯ জনই শিবিরের নেতাকর্মী বলে জানা গেছে। বাকী ১০ জন ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী।

গত ১৫ নভেম্বর আগুন লাগানোর জন্য ২৯ জনকে চিহ্নিত করে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিলের পর বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক উম্মে সরাবন তহুরা।

এছাড়া অগ্নিসংযোগের পূর্বে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আরও ৩ শিবির নেতাকে চিহ্নিত করে তদন্ত কমিটি। তারা হলেন- এমসি কলেজ ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি এসএম মনোয়ার হোসেন, শিবিরের সাথী রাসেল মিয়া ও জাহাঙ্গির। এই তিনজনের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তদন্ত কমিটি যে ২৯ জনকে অগ্নিসংযোগকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মধ্যে সরকারী কলেজের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলামসহ শিবিরের ১৯ নেতাকর্মী রয়েছেন। তারা হলেন- লায়েক আহম্মেদ, জহিরুল ইসলাম, আক্তারুল ইসলাম, অলিউল্লাহ ওরফে ওলিউর রহমান, খুরশেদ আলম, আবদুল্লাহ ফারুক, মোহাম্মদ বিন মামুন বুলবুল, ইমতিয়াজ রফিক চৌধুরী ও কয়েছ ওরফে কয়েছুজ্জামান তালুকদার।

অগ্নিসংযোগের পরদিন (২০১২ সালের ৯ জুলাই) এমসি কলেজের অর্থনীতি ২য় বর্ষের ছাত্র ছাত্রলীগ কর্মী শওকত হোসেন মানিক বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় এদের প্রায় সকলকে আসামী করা হয়েছিলো। পুলিশ এরমধ্যে ১৪ জনকে গ্রেপ্তারও করেছিলো। পরে ওই বছরের ৩০ আগস্ট উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান তারা।

বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি অগ্নিসংযোগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা বাকী ১০জনই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তাঁরা হলেন- সিলেট সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমানে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠু, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক (বরখাস্ত) সভাপতি পংকজ পুরকায়স্থ, আবু সরকার ( শ্রমিক লীগের সাবেক সভাপতি), জাহাঙ্গীর আলম (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক), ছাত্রলীগ নেতা মৃদুল কান্তি সরকার, কামরুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, বাবলা, মো. আতিকুর রহমান ও জ্যোতির্ময় দাস সৌরভ।

এই তালিকার প্রথমেই রয়েছে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠুর নাম। এ ব্যাপারে রোববার তিনি সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শিবিরই ছাত্রাবাস পুড়িয়েছে। তাদের সব ডকুমেন্ট ধ্বংস করতেই আগুন লাগায় শিবির।

তিনি বলেন, পুলিশ সিআইডি পিআইবি বারবার তদন্ত করেও অগ্নিসংযোগের সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা পায় নি। অথচ বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি কিভাবে আমাদের চিহ্নিত করলো তা বোধগম্য নয়।

এ ব্যাপারে জেলা মহানগর শিবির নেতাদের কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

বৃহস্পতিবার এই ৩২ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হলেও রোববার পর্যন্ত থানায় গিয়ে পরোয়ানা পৌঁছে নি বলে জানিয়েছেন শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আখতার হোসেন।

বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের বিরোধের কারণে এই নাশকতা চালানো হয়।

তদন্তের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ছাত্রাবাস পোড়ানোর মামলার বাদীসহ সাক্ষীদের জবানবন্দি ফের গ্রহণ করা হয়। ফলে সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র, জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছাত্রলীগ ও ছাত্র শিবিরের বিরোধের কারণেই সংঘটিত হয়েছে।

প্রথমত ছাত্রলীগের কর্মী উজ্জ্বল আহমদকে ছাত্র শিবিরের কর্মীরা গুরুতর জখম করায় তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য বিচার বিশ্লেষণে এটা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত বলে পর্যালোচনায় বলা হয়।
তদন্ত  প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ছাত্রাবাসে আগুন দিতে গ্যালনে করে পেট্রোল ব্যবহার করা হয়। পরে ছাত্রাবাস কক্ষ লুটপাটও হয়।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিলেট পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। এরপর সিআইডি ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর আদালতে প্রথমবার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তবে আদালত এ প্রতিবেদন গ্রহণ না করে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেন।

এরপর আবার তদন্ত করে সিআইডি ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট ফের আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনও আদালত গ্রহণ না করে পুলিশের একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের মাধ্যমে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দুই বার ও বিশেষায়িত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্তে অপরাধী শনাক্ত না হওয়ায় আলোচিত এ মামলার ভবিষৎ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়।

সর্বশেষ এ মামলার জট খুলতে গত ৩১ মে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ দেন সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে সারাবন তহুরা।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ৮ জুলাই শিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জের ধরে ছাত্রবাসে দেওয়া আগুনে ৪২টি কক্ষ পুড়ে যায়।

এ ঘটনায় হল সুপার বশির আহমদ বাদী হয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় ২০১২ সালের ১৩ জুলাই মামলা দায়ের করেন। পরবর্তীতে এ ঘটনায় আরও দুটি মামলা করা হয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত