বড়লেখা প্রতিনিধি

১৯ জানুয়ারি, ২০২০ ২৩:৪৮

সেই নৃশংসতা থেকে কোনোরকমে বেঁচে যায় চন্দনা

বড়লেখার পাল্লাতল চা বাগানে স্ত্রী-শ্বাশুড়িসহ ৪জনকে হত্যার পর যুবকের আত্মহত্যা

রোববার ভোররাত। হঠাৎ চিৎকার, আহাজারি আর বাঁচার আর্তনাদে ঘুম ভাঙে চন্দনা বুনার্জির (৯)। চোখ খুলে সে দেখল চারদিক রক্তাক্ত। চোখের সামনে তার সৎ বাবা এলোপাথাড়ি কোপাচ্ছেন তার মা, দিদিমা ও প্রতিবেশীদের। এক পর্যায়ে তাকেও ঝাপটে ধরে সৎ বাবা। কোনো মতে সে ঘর থেকে বের হয়। অন্ধকারের মধ্যে চিৎকার করতে থাকে।

তখনও নীরবতার চাদরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের লোকজন। তার চিৎকারে লোকজন জড়ো হন এই বাড়িতে। আশপাশের শ্রমিকরা ছুটে এসে বাড়ি ঘেরাও করেন। কিন্তু ততক্ষণে বাড়িতে আহত অবস্থায় চারজন মারা যান। এ অবস্থায় ঘাতক পালাতে না পের ঘরের দরজা লাগিয়ে রশিতে ঝুলে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

পারিবারিক কলহের জেরে গত রোববার (১৯ জানুয়ারি) ভোররাতে স্ত্রী, শাশুড়ি এবং দুই প্রতিবেশীকে কুপিয়ে হত্যা করে নির্মল নামের ওই ব্যক্তি নিজেই আত্মহত্যা করে। মৌলভীবাজারের বড়লেখার ভারত সীমান্তবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকার পাল্লাতল চা বাগানে এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটে।

হামলায় নিহতরা হচ্ছেন নির্মল কর্মকারের স্ত্রী জলি বুনার্জি (৩০), শাশুড়ি লক্ষ্মী বুনার্জি (৬০), প্রতিবেশী বসন্ত বক্তা (৬০) এবং বসন্ত বক্তার মেয়ে শিউলী বক্তা (১৪)। হামলায় বসন্ত বক্তার স্ত্রী কানন বক্তাও গুরুতর আহত হয়েছেন। তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনার সময় কোনোরকম পালিয়ে প্রাণে বেঁচে গেছে জলি বুনার্জির আগের স্বামীর পক্ষের মেয়ে চন্দনা বুনার্জি (৯)।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এই ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে বেঁচে যাওয়া জলি বুনার্জির আগের পক্ষের মেয়ে চন্দনা বুনার্জি। সে কারো সাথেই কোনো কথা বলছিল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কোনো এক অজানা শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরেছে। এত হইচই, এত কোলাহল কোনোকিছুই তাকে স্পর্শ করছিল না। রোববার (১৯ জানুয়ারি) রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময় মেয়টি তার এক স্বজনের কাছে রয়েছে বলে জানা গেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রোববার ভোররাতে পাল্লাতল চা বাগানে পারিবারিক কলহের জের ধরে নির্মল কর্মকার প্রথমে তাঁর স্ত্রীকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করেন। আক্রমণ ঠেকাতে আসলে শাশুড়িকে এবং পরে দুই প্রতিবেশীকে কুপিয়ে জখম করেন। ঘটনাস্থলেই এ চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় গুরুতর আহত হন কানন বক্তা। পাল্লাতল চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া চন্দনা পালিয়ে গিয়ে চিৎকার দিলে আশপাশের শ্রমিকরা ছুটে এসে বাড়ি ঘেরাও করেন। এ অবস্থায় নির্মল পালিয়ে যেতে পারেননি। ঘরের দরজা লাগিয়ে তীরের সাথে ঝুলে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ঘরের দরজা ভেঙে তাঁকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পায়। নির্মল এ বাগানের নিয়মিত শ্রমিক ছিলেন না। তিনি শ্বশুর বাড়িতেই থাকতেন।

বাগানের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দুই বছর আগে পাল্লাতল বাগানের বিষ্ণু বুনার্জির মেয়ে জলি বুনার্জিকে বিয়ে করেন নির্মল কর্মকার। জলিকে বিয়ে করে তিনি শ্বশুর বাড়িতে থাকতেন। চা-বাগানের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া হত।

বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘ঘাতক নির্মল কর্মকার প্রায় দেড় বছর আগে জলি বুনার্জিকে বিয়ে করে ঘরজামাই হিসেবে বসবাস করে আসছিল। সে আমার বাগানের নিয়মিত কোনো চা শ্রমিক নয়। এর আগে সে পার্শ্ববর্তী একটি চা বাগানে ছিল।’

এদিকে খবর পেয়েই সকালে ঘটনাস্থলে যান মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার ফারুক আহমদ, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া সুলতানা, মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পিবিআই) নজরুল ইসলাম ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (কুলাউড়া সার্কেল) কাওছার দস্তগীর, থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ইয়াছিনুল হক, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জসীম প্রমুখ।

অপরদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন বড়লেখা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সোয়েব আহমদ ও স্থানীয় উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আহমদ জুবায়ের লিটন প্রমুখ।

মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমদ বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে পারিবারিক কলহের জেরে ঘটনাটি ঘটেছে। রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অনেকক্ষণ ঝগড়া হয়েছিল। এটা শোনতেছি। এ থেকেই ঘটনার সূত্রপাত। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনায় গুরুতর আহত একজন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। বিস্তারিত তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’

আপনার মন্তব্য

আলোচিত