
০৮ ফেব্রুয়ারি , ২০১৫ ২১:৫৯
রাত প্রায় ৯ টা । শিবগঞ্জ এলাকার এক ফুটপাতে বসে অমিত সহ চা খাচ্ছিলাম । হঠাৎ বিনয় ভদ্রের ফোন । জোছনা বিহারের আয়োজন হয়েছে টিলাগড় ইকোপার্কের জঙ্গলে । জঙ্গল শব্দটা শুনলেই আমি যেন আবেশিত হয়ে যাই । জঙ্গলের গা ছম ছম করা পরিবেশের প্রতি আমার একটা আলাদা টান আছে । আজ পূর্ণিমা উপরে তাকিয়ে এতক্ষণে খেয়াল করলাম আনন্দে আটখানা অমিত ক্যামেরা নিয়ে এল । আমি বাসায় এসে জ্যাকেট গায়ে বেড়িয়ে পরলাম ।
টিলাগড় ইকোপার্কে যাওয়ার পথটা খুব সুন্দর । দুপাশেই উচু সবুজ টিলা মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাওয়া সরু পিচঢালা পথ । রাতের বেলায় এই সবুজ স্পষ্ট বোঝা না গেলেও চাঁদের আলোয় বেশ লাগছে । সাধারনত সন্ধ্যার পরপরই এদিকটা অনেক শান্ত হয়ে যায় । যানবাহন একেবারে নেই বললেই চলে । আমি আর অমিত হেটে চলেছি । শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে । শহর থেকে একটু দুরত্বেই শীতের এতটা তারতম্য হবে ভাবিনি ।
শুনশান স্তব্দতা । বা পাঁশে টিলার উপরে সাদামত কি যেন চোখে পড়ল । অমিত আমার গায়ে টোকা দেয় । ভুতে বিশ্বাস না থাকলেও রাতের নির্জন আবহে সাদা রঙের কিছুর প্রতি একটা চমকে উঠার ব্যপার থাকে । আসলে ওগুলো গণকবর । সাদা টাইলসে মোড়ানো । চাঁদের আলো ওখান থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে । পাশ থেকে শেয়াল ডেকে উঠল । একটা, আরেকটা, আরেকটা, এবারে একদল শেয়ালের ডাক নিরবতা ভেঙ্গে দিল । আমরা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক পেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে এসে গেছি । বিনয় দাকে
ফোন দিলাম । ওর আরও কয়েকজন ততক্ষণে ইকোপার্কের সামনে পৌঁছে গ্যাছে।
এসে দেখি হুলস্থূল ব্যাপার । দল অনেক ভারী । বাতিন ভাই, অসিম দা, রাজিব রাসেল,ফাহিম,পিয়েল,দলছুট শুভ, হিমেল সহ আরও সাত আট জন । স্থানীয় পথ প্রদর্শক রতন হাজির । বিনয় দা, ফাইম ট্রাইপড, ক্যামেরা আর বাতিন ভাই টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছে ।চাঁদের ফটোগ্রাফি আর সৌন্দর্য অবলোকনের পুরো ব্যবস্থা প্রস্তুত । আমরা ইকোপার্কের পাশ দিয়ে প্রবেশ করলাম । এটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পেছনে । কয়েকটি মাঝারি উচ্চতার টিলা পরস্পরের গা ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে । জঙ্গলের শুরু আরও খানিকটা পরে । চাঁদ যেন নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে এখানে । দিনের আলোর মত পরিষ্কার কিন্তু অনেক স্নিগ্ধ, মোলায়েম চারপাশ আলোয় ভেসে যাচ্ছে । আমরা দলবেধে অনেকক্ষণ হাঁটলাম । রতন জানালো এই অঞ্চলে একসময় অনেক ঘন বন ছিল । বাঘের আনাগোনা ছিল । এখন জঙ্গলে সাপ ছাড়া তেমন কিছু চোখে পরেনা । এখন তো শীতকাল সাপের দেখা পাওয়াও দুষ্কর ।
হঠাৎ একজন প্রস্তাব দিল গানের বন্দবস্ত করলে ক্যামন হয় । কেউ কেউ বলল বনে উচ্চস্বরে গান করা খুব একটা ভাল কাজ হবেনা । সিদ্ধান্ত হল বন থেকে বেরিয়ে গানের আসর বসবে । ইঞ্জিনিয়ারং কলেজের দুজন আমাদের সাথে ছিল । যোগাড় হয়ে গেল গীটার সহ আনুষঙ্গিক অনেক কিছু । ছবি তোলাও চলছে বিরামহীন । কে কত রকম করে রুপময় চাঁদের বিভিন্ন মুহূর্ত গুলো ধরে রাখতে পারে একরকম প্রতিযোগিতাই যেন শুরু হয়েছে । এরকম পূর্ণিমায় বনাঞ্চলে কখনও ঘুরাফেরা করা হয়নি । অত্যন্ত মনমুগ্ধকর এই চাঁদনী রাতের দৃশ্য ।
হাঁটাহাঁটি, ছবি তোলা শেষে শুরু হল গান বাজনা । লালন গীতিই সবার পছন্দ হিসেবে নির্বাচিত হল । তবে প্রথমে গাওয়া হবে রবি ঠাকুরের ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’ । ইয়াসির আর সেতার ভাই আজকের শিল্পী । তবলায় হাত রাখলেন অসিম দা । বনের ধারে এক পুরনো ভবনের সিঁড়িতে বসেই জমে গেল গানের আড্ডা ।
খাঁচার ভেতর অচিন পাখি, কানার হাট বাজার, মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, এরকম আরও অনেক গানের হৃদয় মাতাল করা সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে গেছি সবাই । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত এগারটা । রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে শীতও যেন বাড়ছে । ফেরা দরকার । আরও কিছুক্ষন আড্ডা দিয়ে আমরা ফেরার পথ ধরলাম । ইচ্ছে করলে সাধারন বিষয়গুলোকে অসাধারন করে উপভোগ করা যায় । আজকের আড্ডায় এটা যেন নূতন করে উপলব্ধি হল । শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি বদলেই ব্যস্তময় জীবনকে আনন্দময় করা অনেক সহজ ।
সিলেট শহরটা এমনি এক শহর যেখানে নাগরিক সুবিধা প্রায় সব থাকলেও নাগরিক যন্ত্রণা অনেক কম । ইচ্ছে করলেই যখন তখন চার দেয়ালের শহুরে বন্দী জীবন থেকে সরে এসে প্রকৃতির খুব কাছে এসে মিশে যাওয়া যায় ।
আপনার মন্তব্য