প্রকৌশলী জ্যোতির্ময় ধর

১২ জানুয়ারি, ২০২০ ১৫:২৭

থানচিতে মিলল নতুন পর্বতশৃঙ্গের খোঁজ

মানুষ চিরকাল বৈচিত্র্যের প্রত্যাশী। প্রকৃতি এবং এর বৈচিত্র্যের একটা অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে। বৈচিত্র্যের এই হাতছানিকে অবলোকন করতে যুগ যুগ ধরে মানুষ চালিয়েছে অভিযান – পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।

এ বছরের শুরুতে বন্ধু, প্রকৃতি বিশারদ ডা. অরুণাভ চৌধুরীর উৎসাহে জয় করলাম বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বীকৃত সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কেওক্রাডং। ফিরে আসার পর বন্ধু দিল এক অদ্ভুত তথ্য। কেওক্রাডং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ নয়। এর চেয়েও উঁচু  বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে আরও চারটি শৃঙ্গ। তারা যথাক্রমে সাকা হাফং (৩৪৭১ ফুট), জো-ত্লং (৩৩৪৫ ফুট), দুম্লং (৩,৩১০ ফুট) এবং যোগী হাফং (৩২২২ ফুট)। ভ্রমণ এবং অভিযান রক্তে মিশে আছে আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। তাই আমার সুদীর্ঘ ১৮ বছরের প্রবাস জীবন সত্ত্বেও ভ্রমণ করেছি ৩৯ দেশ। চলতে থাকল বাংলাদেশে আমার একের পর এক অভিযান - সাকা হাফং থেকে শুরু করে একে একে সবগুলো।

বাংলাদেশের ৩০০০ ফুটের এই শৃঙ্গগুলোর বেশিরভাগেরই অবস্থান বান্দরবন জেলার থানচি এবং রুমা এলাকায়। গত বছরের ২৬ অক্টোবর, যখন আমি  বাংলাদেশের ৪র্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ যোগী হাফংয়ের ৪র্থ চূড়ায় আরোহণ করি, প্রায় ৪ ঘণ্টার মতো আমি সেখানে অবস্থান করেছি। ঠিক ওই সময় আমার পথপ্রদর্শকরা আমাকে একটার পর একটা পাহাড় আমাকে দেখাচ্ছিল। ওই দূরে সাকাহাফং (যেটা আমি ৬ মাস আগে জয় করেছি), ওইটা জো-ত্লং (২য় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ)  এবং জো-ত্লং ও যোগী হাফংয়ের ২য় চূড়ার মাঝে অস্পষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা চূড়া। আমি আমার পথপ্রদর্শকদের ওই চূড়া সম্পর্কে প্রশ্ন করলে, ওরা আমায় বলল “আমরা ওই চূড়া কিংবা পাহাড়টা সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না, পথ দুর্গম হওয়ার কারণে ওই চূড়ায় কেউই ওঠে না। শুধুমাত্র আমাদের পাড়া (দালিয়ান পাড়া এবং মুরং পাড়া) থেকে শিকারিরা আসে ওই পাহাড়ের অর্ধেক পথটায়, বাঁদর, সজারু আর ধনেশ পাখি শিকার করার জন্য।

প্রচণ্ড সন্দেহ হচ্ছিল এবং যোগী হাফংয়ের ৪র্থ শৃঙ্গ থেকে আমাকে ওই অজানা পাহারটিকে দেখে আমার কেন যেন উঁচু মনে হচ্ছিল। সামিট শেষ করে দালিয়ান পাড়ায় ফিরে এসে পাড়ার হেডম্যান (চেয়ারম্যান) “লাল রাম বম দাদা”-কে জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন “দেখুন ওদিকটায় শুধু শিকারিরা যায়, পথ খুবই দুর্গম, বম ভাষায় ওই পাহাড়ের নাম “আইয়াং ত্লং“, আমরা কেউ ওই রাস্তা পুরোটা চিনি না, আমার জানামতে আমাদের পাড়ার কেউই ওই পাহাড়ের চূড়ায় কেউ কোনদিন যায় নি, আর বাঙালিতো প্রশ্নই আসে না। “একজন ৭২ বছরের বৃদ্ধ আছেন, যিনি প্রায় ৩০ বছর আগে “আইয়াং ত্লং“ এর চূড়ায় উঠেছিলেন, তিনি অস্পষ্ট ভাবে রাস্তা চেনেন। তিনি যারা শিকার করতে যায়, যারা অন্তত অর্ধেক রাস্তা চেনে, উনি তাদের পুরো রাস্তাটা চিনিয়ে দিতে পারেন। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার পরের অভিযান আমি পরিচালনা করব এই অচেনা চূড়ায়।

সেই উদ্দেশ্যে গত ১১ নভেম্বর, থানচির রেমাক্রি খাল পার হয়ে পৌঁছলাম দালিয়ান পাড়ায়। ভোরের আলো ফুটেনি তখনো। ভোর চারটা। আমার দুই শিকারি পথপ্রদর্শক  লাল্লিয়ান বম,  লাল ঠাকুম বম এবং আমাদের সাথে শিকারি কুকুর হেরমিন, যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে প্রস্তুত। দালিয়ান পাড়া থেকে প্রায় ১২ কি.মি. সহজেই অতিক্রম করে ১ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম Y জংশনে।

এখানে Y জংশন সম্পর্কে একটু বলে রাখা ভাল। এই জায়গাটার মাঝে একটা বিশাল Y আকৃতির গাছ দাঁড়িয়ে। এই গাছের বাম দিকের রাস্তাটা চলে গেছে পূর্বের ৪র্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ  যোগী হাফংয়ের দিকে আর ডান দিকেরটা বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জো-ত্লং এর দিকে। অভিযাত্রীরা এই গাছটিকে অনুসরক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করে। আমরা কোন দিকেই না গিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। প্রায় ১২০০ ফুটের মত একটা পাহাড় অতিক্রম করে শুরু ঝিরিপথ। আগেরদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে ঝিরির পাথরগুলো অসম্ভব পিচ্ছিল। প্রায় পার করে দিলাম ৬৭ কি.মি. ঝিরিপথ। এই পথে দেখলাম প্রায় ১২টার মত সব নাম না জানা ঝরনা। এই ঝিরিপথ পাড়ি দিতে গিয়ে আমাকে পার হতে হয়েছে ৮০০-৯০০ ফুট উঁচু প্রায় ৭টা পিচ্ছিল খাঁড়াই - মানে এই পিচ্ছিল জায়গাগুলো দিয়ে অনেক উঁচু থেকে ঝরনার জল, ঝিরিতে এসে পড়ে,  যেখানে শুধু বাঁশ এবং দড়ির উপর ভর দিয়ে উপরে উঠতে হয়। খাড়া হইতে পা রাখলেই, স্লিপ কেটে নিচে পরে হাত, পা ভাঙার আশঙ্কা কিংবা জায়গামত পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। ঝিরিপথ যখন শেষ তখন সূর্য প্রায় ডুবো ডুবো। সূর্য অস্ত গেলে, পথপ্রদর্শকরা জানিয়ে দিল তারা এই পর্যন্তই রাস্তা চেনে এবং পাড়ার মুরুব্বির কথা অনুযায়ী, ঝিরিপথ যেখানে শেষ হবে, তার কিছুদূর হাতের বামে গেলেই “আইয়াং ত্লং” পাহাড় শুরু। ওটা প্রচণ্ড দুর্গম, তাই সকাল ছাড়া হবে না, রাতটা এই ঝিরির শেষে এই বড় পাথরটার উপরে কাটাতে হবে। কাটা হল কলাপাতা, জ্বালানো হল আগুন। হল সঙ্গে নিয়ে আসা বিনি চালের ভাত আর আলু ভর্তা, এটা আমাদের দুপুরের খাবার হল সন্ধ্যায়। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তার খেয়াল নেই।

সকালে শিকারিদের চিৎকারে ঘুম ভাঙল। দাদা, ওঠেন। এগতে হবে। পাড়ার মুরুব্বির নির্দেশনা অনুযায়ী এগোতে থাকলাম। পাহাড়ের গায়ে প্রচণ্ড জংলী সব গাছ গাছালি, আমাদের দুই শিকারির হাত যেন থামছেই না। দা দিয়ে জঙ্গল পরিস্কার করতে করতে, প্রায় অর্ধেক ওঠার পর, শুরু বাঁশবাগান। আর এগোনও সম্ভব না। আমাদের দুই শিকারি পথপ্রদর্শক তখন ক্লান্ত, বলল চলেন ফিরে যাই, আমরা আর পারছি না। পারব না শব্দটা আমার অভিধানে কক্ষনোই ছিল না। আমি বললাম তোমরা ফিরে যাও। আমি একাই উঠবো। যাই হোক বাঁশ বন পরিস্কার করতে করতে উঠতে থাকলাম। এক পর্যায়ে আমার পথপ্রদর্শক লাল ঠাকুম বম এর চিৎকার “দাদা, আমরা পৌঁছে গেছি চূড়ায়”– মানে, এটা যে “আইয়াং ত্লং” এর চূড়া বুঝবো কীভাবে?

পাড়ার সেই মুরুব্বির কথা অনুযায়ী এর পশ্চিমে দেখা যাবে যোগী হাফং এর ২য় চূড়া এবং পূর্বে দেখা যাবে জো-ত্লং এর চূড়া। আমি নির্দেশ দেওয়ার আগেই, আমার শিকারিরা জঙ্গল সাফ করে দেখাল,  পূর্ব আর পশ্চিমে আমার চোখে তখন গড়িয়ে পড়ছে আনন্দের অশ্রু। এবার তাকিয়ে দেখেন। আরে সবই মিলে যাচ্ছে। এবার কাজের পালা। G.P.S দিয়ে দুবার করে উচ্চতা পরিমাপ করলাম – ৩২৯৮ ফুট। Coordinates: 21°40′23.78″N and latitude is 92°36′16.01″E, Data recorded by Garmin eTrex 30X GPS। উড়িয়ে দিলাম লাল সবুজের পতাকা। ১৩ নভেম্বর ২০১৯ বেলা ১ টা ৪১ মিনিটে, আমি প্রথম বাঙালি, পা রাখলাম বাংলাদেশের একটি সম্পূর্ণ অনাবিষ্কৃত, অপরিচিত একটি চূড়ায়। লিখলাম সামিট নোট।

এবার ফেরার পালা। পরদিন হেডম্যান দাদা আমার নামে প্রত্যয়ন পত্র দিলেন যে “প্রথম বাঙালি হিসেবে আমিই “আইয়াং ত্লং“ জয় করেছি এবং এটার নাম রিনির চূড়া। নিকটস্থ বিজিবি ক্যাম্পে রিপোর্ট করা হল। তারাও আমার এই সামিট রেকর্ড বুকে লিখে রাখল।

এই অভিযান সফল করতে যার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, দালিয়ান পাড়ার সেই বৃদ্ধ বম,  যিনি প্রথম বম হিশেবে “আইয়াং ত্লং” এর সন্ধান পান, তার নাম: ভান রউসাং বম। আর আমি এই অভিযান উৎসর্গ করেছি আমার একজন প্রিয় মানুষ ডা. রিনি ধরকে এবং তাঁর নাম অনুসারে বাংলায় এই শৃঙ্গের নাম দিয়েছি “রিনির চূড়া”।

সিলেট থেকে “আইয়াং ত্লং বা রিনির চূড়া“ তে যাওয়ার রাস্তা:  সিলেট -চট্টগ্রাম- বান্দরবান – থানচি – রেমাক্রি – দালিয়ান পাড়া বেস ক্যাম্প - Y জংশন - “আইয়াং ত্লং”।
 
পরামর্শ: অভিযানে গিয়ে যত্র তত্র ময়লা, বিস্কুট, চিপস, চকলেটের খালি প্যাকেট, খালি পানির বোতল ফেলবেন না। পরিবেশ নষ্ট করবেন না। পাহাড়িদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত