আরিফ জেবতিক

২৮ জুন, ২০২১ ২৩:১৯

ব্যাটারিচালিত রিক্সা-ভ্যান বন্ধ করা অমানবিক

ব্যাটারি চালিত রিক্সা-ভ্যান বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্তটি একটি অমানবিক, অসংবেদনশীল সিদ্ধান্ত। প্রখর রোদে পুড়ে কিংবা অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে একজন মানুষ এই একবিংশ শতাব্দীতে শারিরীক শ্রমে প্যাডেল মেরে মেরে পেটের ভাত যোগায়, তাঁর কষ্ট যদি খানিকটা লাঘব হয়, সেটাতে বাধা দেয়া অন্যায়।

ব্যাটারি চালিত রিক্সা ও ভ্যান বন্ধ করার পেছনে বড় যুক্তি  হচ্ছে এগুলো দ্রুত গতিতে চলে, নিয়ন্ত্রনহীন এবং ব্রেক করলে উল্টে যায়। এটি সত্যি কথা, কিন্তু এর সমাধান কিন্তু এগুলো বন্ধ করে দেয়া নয়। মাথাব্যাথা হলে মাথা কেটে না ফেলে অষুধ খাওয়াই বাস্তব সম্মত কাজ।

রিক্সাগুলো কেন উল্টে যায়, এটি প্রথমে বুঝতে হবে। আশির দশক পর্যন্ত রিক্সায় সামনে পেছনে দুটো ব্রেক ছিল। পেছনের ব্রেকটি পা দিয়ে চেপে কন্ট্রোল করা হতো। তারপর ব্যয় কমানোর ছুঁতোয় রিক্সাগুলোর পেছনের ব্রেক এখন আর নেই, শুধু সামনের ব্রেক আছে।

ব্যাটারি চালিত রিক্সাগুলো প্রথমে যে মোটরে চলত, সেই মোটরের পাওয়ার গত ৩ বছরে বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হয়েছে। ব্যাটারিতে প্রথমে ৬০০ পাওয়ারের মোটর লাগানো হতো, তারপর সেটি ৮০০ পাওয়ার হলো। ৬০০ পাওয়ারের মোটরের রিক্সাগুলো ধীরগতির ছিল, সহজে নিয়ন্ত্রন করা যেত।

এখন রিক্সায় ব্যবহৃত হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১২০০ পাওয়ারের মোটর। ( এই পাওয়ার সম্ভবত ওয়াট, আমি সঠিক জানি না, আমি মাঠের যে মানুষদের সাথে কথা বলেছি, সবাই খালি বলে 'পাওয়ার'।)

সরকারের উচিত হবে, রিক্সাগুলোর একটি স্ট্যান্ডার্ড ডিজাইন বেঁধে দেয়া। এই রিক্সা ভ্যানগুলো স্থানীয়ভাবে বানানো হয়, তাই এগুলোর ডিজাইন সংশোধন করা সহজ। বুয়েট বা অন্য কোনো টেকনিক্যাল জায়গায় দিয়ে দিলেই কত বেগে চললে, কোন ডিজাইনে চললে সেটি উল্টে যাবে না, রিক্সার উচ্চতা-দৈর্ঘ-প্রস্থ হলে কত ওজন বহন করে সহজে উল্টে যাবে না- এসব বের করে ফেলা যায়। এই বিষয়গুলো যে খুব কঠিন তা কিন্তু না, এসবই বিজ্ঞান। একটি রিক্সা সর্বোচ্চ কত শক্তির মোটর ব্যবহার করবে, কোন মানের ব্যাটারিতে চলবে-সবই একটা স্ট্যান্ডার্ড রেঞ্জ তৈরি করে দেয়া যায়।

কিন্তু গরীব মানুষের জন্য এইটুকু করার সময় নেই কারো। সহজ হিসেব হচ্ছে 'বন্ধ করে দাও, ভেঙ্গে দাও, পুড়িয়ে দাও।'

২.
এসব রিক্সা ভ্যান নিয়ে আরেকটা অনুযোগ হচ্ছে এরা ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ অপচয় করছে!  

আপনি সাহেব কুতুব সকাল থেকে একটা ২টনের এসি ছেড়ে অফিস করছেন তাতে বিদ্যুৎ নিয়ে কথা উঠে না, কিন্তু এই জুন মাসের রোদে একজন রিক্সাওয়ালা যদি দুটো প্যাডেল না মেরে ব্যাটারির সাহায্যে গাড়ি চালায়, তাহলে বিদ্যুৎ এর 'অপচয়' নিয়ে কথা উঠে ! কী পরিমান ভন্ডামিপূর্ণ এই যুক্তিবিদ্যা, চিন্তা করলে মুখে থুথু জমে যায়।

দেশে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়ে এই সরকারের আমলে ২৫ হাজার মেগাওয়াট হয়েছে। এই ৫ গুন বিদ্যুৎ বাংলাদেশ ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করার জিনিস নয়, এই বিদ্যুৎ শিল্পায়নে লাগবে আর লাগবে মানুষের জীবনকে আরামদায়ক করতে। সেই আরাম শুধু এসি, ওয়াশিং মেশিন, ডিশওয়াশার, লিফট এর আরাম নয়, এই আরাম যেতে হবে খেতে খামারের কৃষকের সেচযন্ত্রে, যেতে হবে কুমোরের চাকা ঘুরানোর মোটরে, যেতে হবে কামারের ফার্নেসে, রিক্সা-ভ্যানওয়ালার প্যাডেল বিহীন যানবাহনে। এই বিদ্যুতে দেশের সব মানুষের অধিকার।

সুতরাং রিক্সা, ভ্যান অটোমেশনকে যারা বিদ্যুতের অপচয় বলে রায় দেয়, এরা অসংবেদনশীল। এরা প্রথম জেনারেশনের তথাকথিত শিক্ষিত যারা শুধু পাস করে চাকরি, ক্ষমতা পেয়েছে, কিন্তু অক্ষরজ্ঞানের সাথে সাথে অন্যের প্রতি যে মমতা, এমপ্যাথি দেখানোর শিক্ষা-সেটা এরা পায় নি।  

এরা এই জ্ঞানটুকু পায় নি বলেই আমাদেরকে লিখতে হয়, বলতে হয়, চিৎকার চেচামেচি করতে হয়।
এতে লাভ হয় কতটুকু জানি না, কিন্তু এই প্রতিবাদ লিখে না রাখলে নিজের বিবেক আমাদের ক্ষমা করবে না।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহিত)
আরিফ জেবতিক: লেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত