
১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ ০৩:৩৩
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অসংখ্য মিডিয়া ও পুলিশের সামনে বুধবার (১৫ জানুয়ারি) আদিবাসী শিক্ষার্থীদের যেভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে বেধড়ক লাঠিপেটা করা হলো তা দেখে লজ্জায় মাথা হেট হয়ে গেছে।
জুলাই-অভ্যুত্থানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি গ্রাফিতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সেই গ্রাফিতিতে একটি গাছের পাতায় পাতায় লেখা ছিল হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী, বাঙালি। নিচে লেখা ছিল গাছের পাতা ছেঁড়া নিষেধ। অথচ আজ গাছের সেই পাতা ছেঁড়া হলো। পূর্বেও ছেড়া হয়েছে।
পাঠ্যপুস্তকে জুলাই-বিপ্লবে অঙ্কিত বিভিন্ন গ্রাফিতি বাছাই করে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেখানে আলোচ্য গ্রাফিতিটি মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু এখন তা বাতিলের দাবি তুলেছে একটি গোষ্ঠী। কারণ ‘আদিবাসী’ শব্দে তাদের আপত্তি আছে। এই শব্দে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারেরও আপত্তি ছিল। অন্যদের আপত্তিও থাকতে পারে। আপত্তি থাকাটাই স্বাভাবিক। সবাই সব কিছুতে একমত হবে- এমন কোন কথা নেই। সরকার সেই আপত্তি আমলে নিয়ে সেই গ্রাফিতি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করেছে। তাঁদের ক্ষুব্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। এই গ্রাফিতিটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবী আদিবাসীদের পক্ষ থেকে ছিল না। বাছাই কমিটি গ্রাফিতি যদি বাছাই করেই থাকে তাহলে 'আদিবাসী' শব্দ থাকায় কারো অন্যায় দাবির কাছে নতিস্বীকার কেন করবে?
এই গ্রাফিতি বাছাই করা ও পরে বাতিল করা আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন আদিবাসী শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ডভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, বিবেকবোধ সম্পন্ন যেকোনো নাগরিকের কাছেই পুরো বিষয়টি উস্কানিমূলক মনে হয়েছে। এই গ্রাফিতি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে পারে সেই চিন্তা পূর্বে কেন মাথায় এলো না? যে শক্তির ইশারায় এখন সরকার পরিচালিত হচ্ছে তাদের দিয়ে কেন পাঠ্যপুস্তক বাছাই কমিটি করা হলো না?
বিগত সরকারের আমলে আদিবাসী ইস্যুতে বহু বাদানুবাদ হয়েছে। Indigenous শব্দের বাংলা আদিবাসী করা নিয়ে চলা অহেতুক এ বিতর্ক নীতি নির্ধারকদের অজানা থাকার কথা নয়। গণমাধ্যমে এই বিষয়ে উভয় পক্ষের অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
এসব জানা সত্ত্বেও এই উদ্যোগ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের আজ পরিকল্পিতভাবে মার খাওয়ানো হলো।
জুলাই-বিপ্লবে দেয়ালে দেয়ালে আঁকা অসংখ্য গ্রাফিতির মধ্যে আলোচিত গ্রাফিতিটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। আন্দোলনকালে সেই গ্রাফিতি আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করেছিল। কারণ দেশের জেলায় জেলায় সেই গ্রাফিতি বিনা প্রতিবাদে অঙ্কিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার হয়েছে হাজারে হাজার।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর একটি বৈষম্যহীন সমাজ সত্যি সত্যি প্রতিষ্ঠিত হবে। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ফ্যাসিবাদী ধ্যানধারণার ভিন্ন শক্তির হাতে চলে যায় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ক্ষমতা। এদের ইচ্ছা শক্তির কাছে ক্রমাগত আত্মসমর্পণ করতেই দেখছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে।
সেই শক্তি কখনো মাজারে হামলা করে, কখনো বাউল গানের আসর ভেঙে দেয়, কখনো সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করার হুমকি দেয়, কখনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আবাসভূমি জ্বালিয়ে দিতে চায়। এরা নিজেদের ‘মহাফ্যাসিস্ট’ হিসেবে গড়ে তুলছে। এরা হিংস্র হায়েনার মতো ক্রমান্বয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। এদের রুখে দাঁড়াতে হবে। এদের বিরুদ্ধে আওয়াজ না তুললে বাংলাদেশে হানাহানি কোনভাবেই আর বন্ধ হবে না।
আদিবাসী শিক্ষার্থীদের উপর সংঘটিত আজকের হামলা বহির্বিশ্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করবে। করুক। এতো বুদ্ধিজীবী, নাগরিক নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে যুক্ত থাকার পর পরিণতি যদি এই হয় তাহলে আমাদের আর বলার কী থাকে?
আপনার মন্তব্য