সোশ্যাল মিডিয়া ডেস্ক

৩১ মে, ২০১৬ ২০:৪৮

মুস্তাফিজ এখনই ‘জাতীয় বীর’ হলে সামনে কি উপাধি দেব?

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে অভাবনীয় সাফল্য এবং দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে ভূমিকা রাখার কারণে বাংলাদেশের পেসার মুস্তাফিজুর রহমানকে দেশে ফেরার সময়ে সরকারের একজন উপমন্ত্রী ও বিসিবির কর্তাব্যক্তির সংবর্ধনা ও তাঁকে "জাতীয় বীর" আখ্যা দেওয়ার কারণে মুস্তাফিজকে এখনই জাতীয় বীর বলা হলে সামনে কি উপাধি দেওয়া হতে পারে বলে প্রশ্ন তুলেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রনী।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এ ক্রীড়া সাংবাদিক মুস্তাফিজের মাথায় গোলাপের তাজ দেখে তাঁর বিস্ময় জেগেছে উল্লেখ করে লিখেছেন, মুস্তাফিজের চমক জাগানিয়া বোলিংয়ে প্রবল পরাক্রমশালী ভারতকে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছিলাম আমরা। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পেশাদার দলের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়েও মুস্তাফিজের ছিল বড় অবদান। কিন্তু ওই সময় মুস্তাফিজের মাথায় ফুলের তাজ দেখিনি। আরিফ খান জয় বা কোনো মন্ত্রী ছুটে যাননি তার কাছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামনে মুস্তাফিজের ছবি বসেনি তখন। প্রধানমন্ত্রী বা অন্য অনেক মন্ত্রীরা মুস্তাফিজকে তখন ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা করেননি। অথচ ওই দুটি সিরিজ জয় ছিল ইতিহাস গড়া জয়। অভাবনীয় সাফল্য। আজ থেকে বহু বছর পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁক বদলের ইতিহাস ঘাটতে গেলে হয়ত এই সময়টাই উঠে আসবে। কিন্তু মুস্তাফিজ জাতীয় বীর হলেন আইপিএল সাফল্যে।

রনী এ প্রসঙ্গে সাকিব আল হাসানের সাফল্যে ভর করে কেকেআর-এর দুই-দুইবার আইপিএল জয়ের উদাহরণ টেনে প্রশ্ন রেখে আরও লিখেন, সাকিব আল হাসান তাহলে ‘ডাবল জাতীয় বীর!’

রনীর আশঙ্কা, মুস্তাফিজ এবং তার পরিবার এখন আইপিএলকেই ধ্যান জ্ঞান করতে পারেন। আর সমসাময়িক ও ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার যারা আছেন, তারাও এটার সাক্ষী হলেন। ভোরে ঘুম ঘুম চোখে বা বিকেলে অস্থির আগ্রহে কিটব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাবার বাইক বা মায়ের সঙ্গে রিকশায় ক্রিকেট একাডেমিতে যায় যে ছেলেটি, জাতীয় দলকে সিরিজ জেতানোর চেয়ে সে চোখে স্বপ্ন আঁকবে গুজরাট বা বেঙ্গালুরুকে আইপিএল জেতানোর।

সরকারের মন্ত্রীসভার একজন সদস্য ও বিসিবির এমন ভূমিকায় রনী লিখেছেন, আমাদের দেশের ও আমাদের ক্রিকেটের কর্তা ব্যক্তিরা সবাইকেই ভুল বার্তা দিচ্ছেন। শুধু ভুলও নয়, এটা ক্রাইম। অপরাধ। খুব অন্যায় বার্তা।

আরিফুল ইসলাম রনীর ফেসবুক পোস্টের বিস্তারিত-

মুস্তাফিজের মাথায় গোলাপের তাজ। মুখে সেই চেনা লাজুক নিষ্পাপ হাসি। অপূর্ব একটা ছবি। তবে এই দেখার সৌন্দর্যটাই যা একটু। ছবিটা আমার আবেগকে ঠিক স্পর্শ করতে পারছে না!

বিস্ময় জেগেছে। মনে প্রশ্ন জেগেছে। মুস্তাফিজের চমক জাগানিয়া বোলিংয়ে প্রবল পরাক্রমশালী ভারতকে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে সিরিজ হারিয়েছিলাম আমরা। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পেশাদার দলের বিপক্ষে প্রথম সিরিজ জয়েও মুস্তাফিজের ছিল বড় অবদান। কিন্তু ওই সময় মুস্তাফিজের মাথায় ফুলের তাজ দেখিনি। আরিফ খান জয় বা কোনো মন্ত্রী ছুটে যাননি তার কাছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সামনে মুস্তাফিজের ছবি বসেনি তখন। প্রধানমন্ত্রী বা অন্য অনেক মন্ত্রীরা মুস্তাফিজকে তখন ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণা করেননি। অথচ ওই দুটি সিরিজ জয় ছিল ইতিহাস গড়া জয়। অভাবনীয় সাফল্য। আজ থেকে বহু বছর পর বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁক বদলের ইতিহাস ঘাটতে গেলে হয়ত এই সময়টাই উঠে আসবে। কিন্তু মুস্তাফিজ জাতীয় বীর হলেন আইপিএল সাফল্যে। ঠিক আছে, সাকিব আল হাসান তাহলে ‘ডাবল জাতীয় বীর!’

কলকাতা নাইট রাইডার্সের দুবার শিরোপা জয়েই সাকিবের ছিল উল্লেখযোগ্য অবদান। ব্যাটে-বলে এবং দলের পারফরম্যান্সে সার্বিক প্রভাবে, দুবারই সাকিবের ছিল অনেক বড় অবদান। শুধু তই নয়, সাকিব যখন গিয়েছেন, আইপিএল তখনও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য একরকম অস্বস্তি ও অবহেলার মঞ্চ। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা মাশরাফিকে নিয়ে গিয়ে চরম হেনস্থা করা হয়েছে, তামিম-রাজ্জাক-আশরাফুলদের ম্যাচের পর ম্যাচ বসিয়ে রাখা হয়েছে। মুস্তাফিজের মত সাকিব দারুণ কোনো রেপুটেশন নিয়েও যাননি। লড়াই করে একাদশে জায়গা পেতে হয়েছে, লড়াই করেই জায়গা পাকা করতে হয়েছে। সাকিব আইপিএল জয় করেছেন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ব্যাপার যদি কিছু থাকে, দারুণ ভাবে উজ্জ্বল করেছেন। আজকের মুস্তাফিজদের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করেছেন।

কিন্তু সাকিব জাতীয় বীর উপাধি পাননি একবারও। জয়ের মত কোনো মন্ত্রী বা বিসিবির সিইও ছুটে যাননি এয়ারপোর্টে। আমরাও কোনো প্রশ্ন তুলিনি। কারণ সেটাই ঠিক। বিদেশের একটা স্রেফ টি-টোয়েন্টি লিগ খেলে এসেছেন, সেখানে অভাবনীয় সাফল্য পেলেও অতি উৎসাহের কিছু নেই। মিডিয়া কিছু যাবে তার প্রতিক্রিয়া জানতে, নিউজের কারণে। এই তো, সিম্পল। মন্ত্রীদের ছুটোছুটি বা জাতীয় বীর কেন? সাকিব অবশ্যই জাতীয় বীর। আমাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা নায়কদের একজন। সেটা বাংলাদেশের হয়ে তার দারুণ সাফল্যের কারণেই। নাইটদের জিতিয়ে নয়।

আমরা স্বপ্ন দেখি, মুস্তাফিজও একদিন জাতীয় বীর হবেন। ২ টেস্ট, ৯ ওয়ানডে ও ১৩ টি-টোয়েন্টির ছোট্ট ক্যারিয়ারে সেই স্বপ্ন মুস্তা আমাদের দেখিয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাবেই তার যে সাফল্যের সুর, তাতে বাড়তি একটু সঙ্গত ধরেছে আইপিএল। এই তো। আমরা বড়জোর বলতে পারি জাতির আশা। যদিও বলা উচিত, ক্রিকেটের আশা। ক্রিকেটের সাফল্যে জাতি হিসেবেই বা বড় কিছু কতটা আসে-যায়! তারপরও ক্রিকেট এখন আমাদের আশা-ভরসার একটা প্রতীক হয়ে গেছে বলে নাহয় একটু বাড়িয়ে ধরেই নিলাম, জাতীয় আশা। কিন্তু এখনই জাতীয় বীর হলে সামনে কি উপাধি দেব!

গত নভেম্বরে বিডিনিউজে মাশরাফির বড় একটা ইন্টারভিউ করেছিলাম। ৩ হাজারের বেশি শব্দের, ২ পর্বের। সেখানে মুস্তাফিজকে নিয়ে মাশরাফি বলেছিলেন, 'মুস্তাফিজ এখন বিশ্বের সেরা ওয়ানডে বোলার।” খেয়াল করুন, গত নভেম্বরেই। এই সব আইপিএল-বিপিএল খেলার বেশ আগেই। পরে এশিয়া কাপ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও দারুণ বোলিং করেছেন মুস্তাফিজ। আমরা গর্ব ভরে বলেছি, দেশের বাইরেও অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মুস্তাফিজ লিমিটেড ওভারে বিশ্ব সেরা বোলার। সেই বোলার একটা দেশের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটার হওয়ায় আমাদের সে কী উন্মাদনা! ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট হলেও তবু কথা ছিল। বিশ্বসেরা বোলার এইসব টুর্নামেন্টে সেরা উদীয়মান হলে সেটা আর এমন কী! কিন্তু আমাদের অতি উৎসাহিতার বিস্ফোরণে উড়ে যায় সামান্য বোধটুকুও।

কিছু যুক্তি ও অনেকগুলো কুযুক্তিকে বিবেচনা করে নাহয় আমজনতার বাড়াবাড়িটা মানা গেল। ‘পাবলিক খায়’ বলে আমরা মিডিয়াও তাল ধরলাম। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ড, মন্ত্রী বা এইরকম দায়িত্বশীলরাও যদি দায়িত্ব জ্ঞানহীনের স্রোতে সামিল হন, তাহলে প্রমাদ গুণতেই হয়। এসবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি এই ছেলেটির। তার পর দেশের ক্রিকেটের। মুস্তাফিজ দেখলেন, এই দেশে জাতীয় দলকে সিরিজ জেতালে মেলে শুকনো প্রশংসা। আর আইপিএলে সাফল্য পেয়ে ফিরলে সিক্ত হতে হয় সর্বোচ্চ প্রশংসার বৃষ্টিতে।

মুস্তাফিজ এবং তার পরিবার এখন আইপিএলকেই ধ্যান জ্ঞান করতে পারেন। আর সমসাময়িক ও ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার যারা আছেন, তারাও এটার সাক্ষী হলেন। ভোরে ঘুম ঘুম চোখে বা বিকেলে অস্থির আগ্রহে কিটব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাবার বাইক বা মায়ের সঙ্গে রিকশায় ক্রিকেট একাডেমিতে যায় যে ছেলেটি, জাতীয় দলকে সিরিজ জেতানোর চেয়ে সে চোখে স্বপ্ন আঁকবে গুজরাট বা বেঙ্গালুরুকে আইপিএল জেতানোর।

আমাদের দেশের ও আমাদের ক্রিকেটের কর্তা ব্যক্তিরা সবাইকেই ভুল বার্তা দিচ্ছেন। শুধু ভুলও নয়, এটা ক্রাইম। অপরাধ। খুব অন্যায় বার্তা।

কাউকে মাথায় তুলতেও আমাদের সময় লাগে না, ফেলেও দিতে পারি এক ঝটকায়। আমাদের জাতীয় চরিত্র এটি। মুস্তাফিজকে যে ভুল বার্তা আমরা দিচ্ছি, সেই ভুলের চক্করে পথ হারানো কেবলই সময়ের ব্যাপার। খুব বেশিদিন নয়, আজকের জাতীয় বীর হয়ে উঠতে পারেন জাতীয় হতাশা!

আপনার মন্তব্য

আলোচিত