আলিম আল রাজি

২৭ জুলাই, ২০১৭ ১৯:১৪

চিকুনগুনিয়ার আশায়, লোকটা বুঝি ঢাকা যায়!

রোগ-শোক অনেকের কাছে গর্বের বিষয়। হাসপাতালে নিয়মিত এরকম রোগী পাওয়া যায়।

- ডাক্তার সাহেব, আমার তো প্রেশার। খুব হাই।
- তাই?
- হু হু। আমরার বংশের সবার প্রেশার। বাপ-দাদা সব।
- ও!
- রেগুলার ওষুধ খাই। তাও কমে না। নিচেরটা, উপরেরটা সব বেশি। মাথা সব সময় থাকে গরম।
- দেখি, কী ওষুধ খান, দেখি।

ভদ্রলোক ওষুধ দেখান। এসব ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় ওষুধটা প্রেশারের না, ঘুমের। এটাকেই প্রেশারের ওষুধ ভেবে ভদ্রলোকের অনেক গর্ব।
প্রেশার মেপে দেখা যায় স্বাভাবিক। রোগীকে বলতে হয়, 'এটা তো প্রেশারের ওষুধ না, বাবা। আপনার এই রোগই মনে হয় নাই।'

৫০ ভাগ রোগী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকান। তাঁরা এই কঠিন সত্যটা মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের চোখে-মুখে হতাশার ছাপ লক্ষ্য করা যায়। 'এটা কী বললো ডাক্তার? তবে কি এতদিন মিছে জানতাম? পাশের বাসার বশির ভাই-এর তো প্রেশার আছে। উনার ভায়রারও প্রেশার আছে। তাহলে আমার নাই কেন? এবার আমি বাসায় গিয়ে মুখ দেখাবো কীভাবে?'

বাকি ৫০ ভাগ রোগী খুব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকান। তাঁদের চোখে মনের কথা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে - 'তুমি বালটা জানো। সেদিনের ডাক্তার। আসছে প্রেশার শিখাইতে। আমার অবশ্যই প্রেশার এবং এটা অবশ্যই প্রেশারের ওষুধ। পারলে ঠেকা।'

ডায়াবেটিস নিয়েও অনেকের আহ্লাদের সীমা নেই। রীতিমতো টেবিলে থাবা মেরে তারা বলেন:
- বুচ্ছেন নি ডাক্তার সাব। আইজ ৭ বচ্ছর থেকে ডায়াবেটিস। আল্লাহর রহমতে একদিনও ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগে নাই। সব সময় কন্ট্রোল। আমার ভায়রা তো কয়দিন আগে ডায়াবেটিসে 'নীল' হয়ে মারাই গেলেন। আমার এইসব নীল নুল হয় না। ডেইলি কমেট খাই। ৫০০। ৩ বেলা।
- ও!
- এইতো আজকেই মেপে আসলাম।
- কতো পাইলেন?
- খালি পেটে ১৫। ভরা পেটে ১৭.৫।

'রোগ বিলাস'এর তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে 'চিকুনগুনিয়া'।
এই রোগ নিয়ে মানুষের বিলাসিতা সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। এটা আর কোনো রোগ নয়, অনেকের কাছে 'স্ট্যাটাস' ইস্যু।
... অমুকের চিকুনগুনিয়া হয়েছে, আমার হয়নি - এ কেমন কথা?
... অমুক চিকুনগুনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ফেসবুকে সেলফি দিয়েছে, চেক ইন দিয়েছে। আমি দিতে পারলাম না, এ সমাজ কি আমাকে মেনে নেবে?

কিছুদিন আগে এক যুবক ভর্তি হলেন। বয়স ২৬। হিস্ট্রি নিলাম।
- কী কষ্ট?
রোগী এগাল-ওগাল হেসে উত্তর দিলেন, 'কষ্ট কিচ্ছু না। তবে আমার চিকনগুনিয়া হয়েছে।'
- না না। তা বলছি না। বলতে চাচ্ছি কী জন্য এসেছেন?
- ঐ যে বললাম, চিকনগুনিয়া।

আমি প্রশ্নের ধরণ চেঞ্জ করলাম।
- জ্বর আছে?
- হ্যাঁ। চিকুনগুনিয়া হয়েছে। জ্বর থাকবে না?
- শরীরে ব্যথা আছে?
- এখনও নাই। তবে যেহেতু চিকুনগুনিয়া সেহেতু ব্যথা হয়ে যাবে।
- কাশি টাশি আছে?
- কেন? কাশি থাকলে কি চিকুনগুনিয়া না?

কিছুটা বিরক্ত হলাম। আবার প্রশ্ন করলাম, 'এর মধ্যে সিলেটের বাইরে কোথাও ঘুরতে গিয়েছিলেন?'
রোগী মনে হলো আমার চেয়েও বিরক্ত হলেন।
চোখ কুচকে উত্তর দিলেন 'কেন? সিলেটের বাইরে না গেলে কি চিকুনগুনিয়া হতে পারে না? অবশ্যই পারে। আমার চাচাতো ভাইয়েরও তো হয়েছে।'

আরও কিছু প্রশ্ন-ট্রশ্ন, পরীক্ষা-টরীক্ষা করে মনে হলো, সিম্পল ইনফেশন। ফুসফুসে হওয়ার চান্সই বেশি। হালকা ওষুধেই জ্বর কমে শেষ।
তিন দিন ছিলেন হাসপাতালে। প্রথমদিন যতোবার দেখতে গিয়েছি খুব উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, 'বস, বুড়া আঙুলে খুব ব্যথা করছে। চিকনগুনিয়া তাহলে হয়েই গেলো। কী বলেন?'
আমি মাথা নেড়ে বলতাম, 'চিকুনগুনিয়ায় ব্যথা হয় সারা শরীরে।'

দ্বিতীয় দিন মনটা খুব খারাপ করে কণ্ঠে উদাস-উদাস ভাব টেনে বলেছিলেন, 'সারা শরীরে ব্যথা তো এখনও হইলো না? তাইলে কি আমার চিকুনগুনিয়া না?'
আমি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, 'নাহ।'
তৃতীয় দিন বললেন, 'ডাক্তার সাব, জ্বর তো ভালো হয়েই গেলো। ডিসচার্জ দিয়ে দেন। ঢাকায় যাবো। জরুরী কাজ।'

উনার হয়তো আসলেই জরুরী কাজ ঢাকায়। কিন্তু আমার 'ডার্টি মাইন্ড'। কেন জানি মনে হচ্ছিলো এই লোক ঢাকায় যাচ্ছে কেবল চিকুনগুনিয়ার আশায়। এ যে করেই হোক, চিকুনগুনিয়া বাধিয়েই ছাড়বে।

  • আলিম আল রাজি: চিকিৎসক, রম্যলেখক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত