আবু মকসুদ

১১ ফেব্রুয়ারি , ২০২০ ০২:৩৭

ইতিহাস সাক্ষী একজন ইসহাক কাজলেরও মৃত্যু হবে না

ইসহাক কাজল। ছবি: সংগৃহীত

ইসহাক কাজল চলে গেলেন, যাবেন জানতাম। আকাশের (ছেলে) সাথে কথা হয়েছে, ডাক্তার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে, ডাক্তারদের নির্ধারিত সময়ের চেয়েও কয়েক ঘণ্টা বেশি আয়ু পেলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত, বেদনাহত।

তিনি আমাদের অন্তর খালি করে গেলেন। ডাক্তারের দেয়া সময় পেরিয়ে তিনি যখন যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আমরা আশাবাদী ছিলাম হয়তো আবারও বাধাবিপত্তি অগ্রাহ্য করে জেগে ওঠবেন। এর আগেও কয়েকবার তাঁকে যুদ্ধে জয়ী হতে দেখেছি, ডাক্তারদের অসহায় মুখের রেখা পড়ে তাদের হতাশ করতে দেখেছি। কিন্তু এবার ডাক্তারদের ভবিষ্যৎবাণী ফলে গেল, তবু আরও কয়েক ঘণ্টা তাদের মিথ্যা প্রমাণিত করতে চেষ্টা করলেন।

ইসহাক কাজল আজন্ম বিপ্লবী, সহজে পরাজয় মানবার নন। তাঁর দিকে তাকালে মনে যে বিশ্বাস প্রজ্বলিত হয়, সেই বিশ্বাসে তিনি হেঁটেছেন। সারাজীবন সে বিশ্বাস সমুন্নত রেখেছেন। শৈশব, কৈশোরে যে আদর্শ তাঁকে নাড়া দিয়েছিল, মেহনতি মানুষের মুক্তির যে সংগ্রাম মনে দানা বেধেছিল যৌবনের উত্তাল দিনে যৌবন উজাড় করে তিনি সে সংগ্রামে শরিক হয়েছেন। সে আদর্শকে লালন করে প্রৌঢ়ত্বে, বার্ধক্যে তিনি বিপ্লবের মশাল জ্বালিয়েছেন। বিপ্লব তাঁর কাছে শেষ না হওয়া সংগ্রাম, বিপ্লবে তাঁর কোন ক্লান্তি নেই, মেহনতি মানুষের জন্য লড়ে যেতে তিনি এক মুহূর্তের জন্য অবসর নেননি।

প্রকৃত বিপ্লবীর প্রতিকৃতি যদি পাথরে খোদাইয়ের প্রয়োজন হয়, আমি নিশ্চিত তিনি অগ্রে থাকবেন। বিপ্লবীদের ইতিহাসে তাঁর জন্য বরাদ্দ থাকবে কয়েক পৃষ্ঠা। প্রকৃত বিপ্লবীর মৃত্যু হয় না, ইতিহাস সাক্ষী একজন ইসহাক কাজলেরও মৃত্যু হবে না। দেহাবসান অর্থ শেষ হওয়া নয়, পুনরুত্থানও এক ধরণের অর্থ হতে পারে। হয়তো একদিন বিপ্লবীদের প্রয়াণ দিবস পুনরুত্থান দিবস হিসাবে পালিত হবে।

ইসহাক কাজলের সাথে আমার পুরো এক অধ্যায় আছে। তিনি বয়সে অগ্রজ হলেও স্নেহের পাশাপাশি আমার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধও ছিল। আর ছিল প্রশ্রয়, আমি যতরকম জ্বালাতন করি না কেন তিনি বিরক্ত হতেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করেছি, সব তর্ক বুদ্ধিবৃত্তিক ছিল তা নয়। অনেক কুতর্ক কিংবা না তর্কও হয়েছে। অল্প জ্ঞান নিয়ে তাঁর মতো বটবৃক্ষের গায়ে হেলান দিয়েছি। আমার স্পর্ধায় কোনদিন রাগ করেননি।

বিলেতের সাহিত্য, সংস্কৃতি পাড়ার অভিভাবক ছিলেন ইসহাক কাজল। আমার অভিভাবক ছিলেন, কিন্তু অভিভাবক জনিত কোন অহমিকা তাঁর ছিল না। বিপদে তাঁর পরামর্শ মহৌষধ ছিল, তাঁকে রেখে কোনকিছু করা অসম্ভব ছিল। ডাক্তারের পরামর্শে মোতাবেক তাঁকে যখন বিশ্রাম করার কথা বলা হয়, আমরা তাঁকে এড়িয়ে চলতে চাইতাম কিন্তু তিনি এড়াতে দিতেন না। একদিন খোঁজ না নিলে রাগ করতেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও মিটিং মিছিল সেমিনারে হাজির হতেন। তাঁর এমন উৎসাহ দেখে নিজেরা লজ্জায় পড়ে যেতাম। এই বয়সেও শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপারে তিনি যতটুকু নিবেদিত তার ছিটেফোঁটাও আমরা হতাম শিল্প-সাহিত্যের এমন করুণ দশা হতো না।

তাঁর দেহাবসান আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতি, অভিভাবকবিহীন পরিবারের কী গতি হবে জানি না। নৌকার দক্ষ মাঝির অভাব এখন অনুভূত হবে, আশা তাঁর কাছ থেকে শিখে নেয়া শিক্ষা কাজে লাগিয়ে অন্য সদস্যরা তরী পারে ভেড়াবেন।

ইসহাক কাজল চলে গেছেন, কাজল ভাই কিংবা ইসহাক ভাই বললে আর কেউ এখন সাড়া দেবে না কিন্তু আমরা নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবো। পরিবারপ্রধানের যে গুরুদায়িত্ব তিনি পালন করেছেন যে জন্য পরিবার তাঁকে মনে রাখবে। ইসহাক কাজল বেঁচে থাকবেন।

  • আবু মকসুদ: কবি।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত