নিজস্ব প্রতিবেদক

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ ১৩:৪২

সাতকরার স্বাদকাহন

সাতকরা আর নালি পাতা, কি বলিব লজ্জার কথা/স্যুটকেস ভরিয়া লও শুটকিরও বস্তা


প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটে সাতকরা নিয়ে এটি একটি প্রচলিত শ্লোক। কাস্টমসের বেড়াজাল পেরিয়ে আঞ্চলিক এসব খাবার কোনভাবে প্রবাসী স্বজনদের কাছে পাঠাতে পারলেই যেন মহাভারত জয় করার মত আনন্দ পান এই অঞ্চলের মানুষ। প্রবাসীরাও নানান ঝক্কি পেরিয়ে দেশ থেকে নিয়ে যান এসব খাবার। সতকরা তাঁর মধ্যে অন্যতম।

বিশেষ করে কোরবানি ঈদের সময় প্রবাসীদের কাছে সাতকরার কদর বেড়ে যায় কয়েকগুন। এই সময়টায় বাণিজ্যিকভাবেও যুক্তরাজ্য ,যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে সাতকরা রপ্তানি হয় থাকে। সিলেট নগরীর মুজমদারিতে বসবাসরা সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আমার ভাই ও বোন লন্ডনে থাকেন, ঈদ উপলক্ষ্যে তাদেরকে সাতকরা কুরিয়ার করে পাঠিয়েছি'।

 
কোরবানি ঈদ উপলক্ষ্যে সাতকরা প্রক্রিয়াজাত করছেন সিলেটের গৃহিনীরা

সিলেটের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সাতকরার কদর কেবল প্রবাসীদের মধ্যেই নয় স্থানীয়দের মধ্যও বিপুল। সারা বছরই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রসনা বিলাসের উপকরন হয়ে থাকলেও কোরবানির ঈদের সময় সাতকরা খাওয়া নিয়ে শুরু হয় আলাদা আয়োজন। সাতকরা ছাড়া গরুর গোশত ভূনার কথা ভাবতেই পারেননা সিলেটিরা।

কোরবানি ঈদের মৌসুম আসলে গৃহিনীরা সাতকরা বিভিন্ন উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কখনো তরকারিতে কাঁচা সাতকরা দিয়ে রান্না করা হয় আবার কখনও দেয়া হয় শুকনো সাতকরা। বিভিন্ন তরকারির সাথে খাওয়ার জন্য বানানো হয় সাতকরার মুখরোচক আচার। মাছের তরকারিতেও সাতকরার ব্যবহার হয়। এ ছাড়া রয়েছে সাতকরার খাট্টা বা টক। সাতকরার স্বাদের চেয়েও এর বিশেষ ঘ্রান পছন্দ সিলেটিদের। এই অঞ্চলের অনেকে তাই বলে থাকেন সাতকরার ঘ্রান না থাকলে মাংশ খাওয়ার মানেই হয় না। 

সাতকরা মূলত ভারতবর্ষের আসামের পাহাড়ি এলাকার আদি ফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম সাইট্রাস ম্যাক্রোপেটেরা। সিলেটের লোকজন ডাকে 'হাতকরা' নামে। সিলেট অঞ্চল একসময় বৃহত্তর আসামের অংশ থাকায় শুরু থেকেই সিলেটের টিলা ও পাহাড়ের এর ব্যপক আবাদ হয়ে আসছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের সিলেটের  জৈন্তাপুর, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ছাতক, বড়লেখা, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, কমলগঞ্জ এর  বিভিন্ন পাহাড়-টিলায় সাতকরা চাষ হয়। লেবুগাছের মতো সাতকরার কাঁটাভরা গাছ ২০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা হয়। ফাল্গুন মাসে ফুল আসে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে ফল হয়।  কমলা চাষের মতো নিরবচ্ছিন্ন কোনো চাষপদ্ধতি না থাকায় সাতকরার উৎপাদনসংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে নেই।


জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাস হচ্ছে সাতকরার মৌসুম। এসময় জৈন্তার হরিপুর, গোয়াইনঘাটের জাফলং অঞ্চল থেকে দেশি সাতকরা বাজারে আসে। ভারতের আসাম ও মেঘালয় থেকেও আমদানি হয় প্রচুর পরিমান সাতকরা। চাহিদার তুলনায় ৩০% সাতকরা সিলেটের স্থানীয় এলাকাগুলো যোগান দিতে পারে বাকি ৭০%ই আসে ভারত থেকে। সবচেয়ে বেশি আসে আসামের কাছাড় জেলা থেকে। যদিও ভারত থেকে আসলেও ওই সাতকরাকে বিদেশি বলা হয় না কারন যখন এই ফল মানুষের খাবার উপকরণ হয়ে উঠে তখন অভিবক্ত ভারতের আসাম রাজ্যেরই একটি অঞ্চল ছিল সিলেট।

সম্প্রতি সিলেটের বাইরের জেলাগুলোতেও সাতকরার চাহিদা দেখা যাচ্ছে। মৌসুম শেষ হওয়ায় এখন মূলত বাজারে এখন বেশিরভাগই ভারত থেকে আমদানিকৃত সাতকরা পাওয়া যাচ্ছে, ছোট সাইজের হালির দাম ৮০-১০০ টাকা। মাঝারিগুলোর দাম হালি প্রতি ১৫০-২০০ টাকা। আর বড় সাইজের হালি ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত