শামসুল ইসলাম শামীম

১৯ মার্চ, ২০১৮ ১৭:০২

নৃত্যশৈলী’র ‘মহাজনের নাও’ এবং প্রাসঙ্গিককথা

‘বসন্ত বাতাসে সই গো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে...’
অথবা
‘গাড়ি চলে না চলে না
চলে না রে গাড়ি চলে না...’
সুরবদ্ধ এই বাণীগুলো কানে এলে প্রাণে যার অবয়ব মূর্তিমান হয়ে উঠে তিনি শাহ্‌ আবদুল করিম, জগতজোড়া খ্যাতি যার ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবে। কারো কাছে সাধক পুরুষ, কারো কাছে বা ভাটির পুরুষ, তিনি আমার ‘পীরসাব’।

সেই কতো বছর আগে তার তাঁর পায়ে হাত রেখে বলেছিলাম, ‘পীরসাব’ আমাকে আপনার শীষ্য হিসেবে দু’য়া করে দেন। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, দু’য়া করে দিলাম! এই আমার পীরসাব! তারপর কতো রাত-কতো দিন তাঁর আঙ্গিনায় কাটিয়ে দিয়েছি, সে অঙ্কের যোগফল মিলাইনি কখনো।

সেই শাহ্‌ আবদুল করিমকে নিয়ে কোথাও কিছু হচ্ছে জানলে ছুটে যাই পাগলাটে অশ্বের মতো! আমার পীরসাব আমাকে টানেন, কেমন জানি অদৃশ্য এক সুতায় টান পড়ে আমার! সে টান আমি অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করতে পারি না কিছুতেই। শুধু মনে হয়, হৃদয় পানে হৃদয় টানে! টানবেই তো! এই টান কি অস্বীকার করা যায়!

শাহ্‌ আবদুল করিমকে নিয়ে নৃত্যশৈলী’র গীতিনৃত্য নাট্য ‘মহাজনের নাও’। শাকুর মজিদের অসাধারণ সৃষ্টি। শাকুর মজিদকে আমার কাছে মনে হয় যেনো সোনা ফলানো চাষী! কাগুজেক্ষেতে যেখানেই তার লেখনির তীক্ষ্ণ ফলা চাষবাস করেছে সেখানেই সোনা ফলেছে। হোক সেটা নাটক, গল্প বা টেলিফিল্ম। ‘মহাজনের নাও’ তার এমনই এক সোনা ফলানো চাষের গল্প। অনেকের কাছে বিষয়টি ‘গপ্পো’ মনে হতে পারে, কিন্তু যারা শাকুর মজিদের সৃষ্টিতে ডুব-সাঁতার খেলেছেন কেবল তারাই জানেন, ‘শাকুর দীঘি’তে নাইতে গেলে জলের টান কেমন টানে!

সম্প্রতি সিলেটে কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে মঞ্চস্থ হলো ‘মহাজনের নাও’। এটি নৃত্যশৈলী’র ২৩তম মঞ্চায়ন। এই ২৩-এর ভেতরে আমি যে কতোবারের দর্শক তা নিজেও জানিনা! আমার জানা মতে, নৃত্যশৈলী একটি নাচের সংগঠন। সেই সংগঠন যখন ‘মহাজনের নাও’ বাইতে মঞ্চে উঠে, তখন আমার বুক কেমন ঢিপঢিপ করে! কেবলই মনে হয় দূরবীনে দেখিয়া পথ মাঝিমাল্লা বাইতে পারবে তো? কিন্তু আমি বরাবর প্রদর্শনী শেষে বুক ভরা মুগ্ধতা নিয়ে অডিটোরিয়ামের বাইরে এসে গলা ছেড়ে হাঁক দিয়েছি ‘আলী, এককাপ দুধ চা লাগাও’!

‘মহাজনের নাও’-এর প্রথম প্রদর্শনী হয় সিলেটের বিয়ানীবাজারে ২০১৪ সালে। নৃত্যশৈলী’ ‘মহাজনের নাও’ নিয়ে তিন তিনবার ভারত গেছে, ঢাকায় প্রদর্শনী করেছে একাধিকবার। আমার ভাবতেও অবাক লাগে এই বোধ বোধনের কালে, এই সুনেতৃত্বের বিরাণবেলায়, এই অনৈক্যের দহণকালে নৃত্যশৈলী কি করে এতোটা পথ পাড়ি দিতে পারে? কে সেই মন্ত্রশক্তি? যার শক্তিতে দিপ্তমান নৃত্যশৈলী’র মাঝিমাল্লারা!

নৃত্যশৈলী’র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ২০০৬-এ হলেও প্রস্তুতিটা শুরু হয় কিন্তু ২০০০-এ। চল্লিশের মতো সদস্য নিয়ে আনুষ্টানিক যাত্রা শুরু করা নৃত্যশৈলী’র বর্তমান সদস্য সংখ্যা দু’শয়ের কাছাকাছি। এই বিশাল মাঝিমাল্লা দলের মূল কাণ্ডারি নীলাঞ্জনা যুঁই, অনেক নাট্যমোদীর মতো আমি নিজেও তাঁর ভক্ত। নৃত্যশৈলী’র কর্ণধার নীলাঞ্জনা যুঁই যে কি অনন্য আর কতো অসাধারণ নির্দেশক তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় ‘মহাজনের নাও’-এ। ‘রতনে রতন চিনে’-শাকুর মজিদও তাই! তিনি তাঁর সৃষ্টিকে ‘সুপাত্রেই সম্প্রদান’ করেছেন, এ কথা অবলীলায় বলা চলে।

শুধু কি নির্দেশনা? মঞ্চে তার তুখোড় আর সাবলীল কলাকৌশল যে কতোটা প্রাঞ্জল আর মনোমুগ্ধকর তা দর্শক মাত্রই জানেন।
‘মহাজনের নাও’-এর প্রদর্শনীগুলোতে জনে জনে প্রতিজন কুশীলব নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। সবার নাম না জানা বা ব্যাক্তিগত পরিচয় না থাকার কারনে তাদের সম্পর্কে বিশদ কিছু বলতে পারছি না। তবে তাদের ভেতরে শিল্পী সত্ত্বার জন্ম দেয়া আবার তা প্রয়োজন বোধে দর্শকের মনে মুগ্ধতা রূপে ছড়িয়ে দিতে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন যুঁই। এ ক্ষত্রে নীলাঞ্জনা যুঁই একজন সফল এবং স্বার্থক নির্দেশক। গীতি নাট্যটিতে শাহ্‌ আবদুল করিম চরিত্রে শাহজাদা নাহিয়ান চৌধুরীর সাবলীল আর পোক্ত অভিনয় শৈলী কিছু সময়ের জন্য হলেও দর্শকদের সেই উজান ধলে নিয়ে গিয়েছিলো! মঞ্চে আয়ুষ্কাল কম হলেও সরলা রূপী শতাব্দি চৌধুরী শ্রাবণী’র অভিনয়ে মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকপ্রাণ কিছু সময়ের জন্যে হলেও শুনেছে কালনীর কলধ্বনি, পেয়েছে ধলের মাটির সোঁদা গন্ধ!

‘মহাজনের নাও’-এর ২৩তম প্রদর্শনীতে নেপথ্য কন্ঠে বর্ণনা করেছেন নাট্যজন আমিনুল ইসলাম চৌধুরী লিটন। শাহ্‌ আবদুল করিমের গানের নেপথ্য কন্ঠ ছিলো জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী জামাল উদ্দিন হাসান বান্নার, সাথে ছিলেন বাউল সূর্যলাল দাস। এখানে যে বিষয়টি না বললে নিজের সাথে শঠতা করা হবে তা হলো গান। বাউলাঙ্গের গান ছিলো ‘মহাজনের নাও’এর প্রাণ। শাহ্‌ আবদুল করিমের সামনে বসে তাঁর কন্ঠে গান শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। তার কন্ঠে এবং পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য শীষ্য ও অনুসারীরা যে কথা ও সুরে গানগুলো গেয়েছিলেন সেই ধারায়ই এই গীতি নাট্যে গানগুলো গাওয়া হয়েছে। এক কথায় বলা চলে প্রতিটি গান দর্শকদের প্রাণে-মনে গেছে অবিকৃত ও মৌলিক ভাবে। এই চিন্তা চেতনা যার মেধা ও মনন থেকে এসেছে নিঃসন্দেহে তিনি প্রশংসার দাবীদার।

‘মহাজনের নাও’-এর ২৩তম প্রদর্শনীর আরেকটি আকর্ষণীয় দিক ছিলো আলোক সম্পাত বা আলোক প্রক্ষেপণ। বিষয়টি খুব সহজেই সবাই না-ও বুঝতে পারেন, কিন্তু যাঁরা মঞ্চ সংশ্লিষ্ট বা কোন এক সময় মঞ্চের আশেপাশে ঘুরপাক করেছেন তারা সহজেই বুঝতে পারবেন, এই প্রদর্শনীর আলোক প্রক্ষেপণে কতোটা মুন্সিয়ানা ছিলো। নেপথ্যে থেকে কঠিনতম এই কাজটি সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় সম্পাদনা করেছেন থিয়েটার পাড়ার প্রিয়মুখ চম্পক সরকার।

‘মহাজনের নাও’-এর প্রায় প্রতিটি প্রদর্শনীতে মঞ্চে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। কেনো এমনটি হয়? ‘মঞ্চায়নে বৈচিত্র্য আনা আর কিছুটা হয় ইমপ্রুভমেন্টের জন্য’- এই হলো নৃত্যশৈলী’র কর্ণধার নীলাঞ্জনা যুঁই’র সোজাসাপ্টা জবাব! তবে যুঁই’র আক্ষেপ, থিয়েটার অঙ্গনে এখনও পেশাদারিত্ব আসেনি বলে। নৃত্যশৈলী সেই পেশাদারিত্বের যায়গাটুকু তৈরি করতে কাজ কছে বলেও জানান যুঁই।

আমরাও চাই, থিয়েটার অঙ্গণে পেশাদারিত্ব আসুক, ‘মহাজনের নাও’ নিয়ে নৃত্যশৈলী আন্তর্জাতিক অঙ্গণে যাক, যাতে করে আমাদের শিকড় আরো বিকশিত, আরো প্রকাশিত হয়।

লেখক: সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত