ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ

২২ জুলাই, ২০২০ ২৩:১৭

পদত্যাগী মহাপরিচালককে সমর্থনের আগে যা ভুলে যাওয়া অনুচিত

অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ

গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেছেন। তিনি ব্যর্থতার আত্মোপলব্ধি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন নাকি আদিষ্ট হয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন যদিও সে ব্যাপারটি এখনও স্পষ্ট নয় তবুও তার পদত্যাগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে চলমান শক্তিশালী সিণ্ডিকেটের একটা অংশ (হোক সেটা অতিশয় ক্ষুদ্র) যে খসে পড়েছে তাতেই অনেকে খুশি হয়েছেন বা আপাত: সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেছেন।

চিকিৎসকদের মাঝে অবশ্য মহাপরিচালকের পদত্যাগ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তার পদত্যাগে অধিকাংশ চিকিৎসক খুশি হলেও কেউ কেউ হতাশাও ব্যক্ত করেছেন। যারা হতাশা ব্যক্ত করেছেন তারা বলতে চাচ্ছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আমলাতন্ত্রের দখলি থাবা বসাতেই মহাপরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি বলির পাঠা হয়েছেন!

এখানে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে বলতে চাই- মহাপরিচালক নিজেই তার চাকরির মেয়াদ অতিক্রম করে অতিরিক্ত মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে কাজ করে যাচ্ছিলেন। আজ হোক কিংবা কাল হোক তার চুক্তি শেষ হলে তাকে অবসর নিতেই হতো। তখন কি মহাপরিচালকের পদটি আমলাতন্ত্রের কালো থাবার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো না? এখন যে আশঙ্কা আপনারা করছেন তখনও সেই একই আশঙ্কা তৈরি হবে বৈকি! এই মহাপরিচালক তো আজীবন এই পদটি আঁকড়ে রেখে আপনাদেরকে আজীবন আশঙ্কামুক্ত রাখতে পারবেন না!

সুতরাং মহাপরিচালক পদে আমলারা থাবা বসাতে পারে সেই অজুহাতে তার মতো করোনা মোকাবেলায় শতভাগ ব্যর্থ ও চরম স্বেচ্ছাচারী একজন ব্যক্তিকে শুধুমাত্র চিকিৎসক সহকর্মী হওয়ার সুবাদে এই করোনা মহামারির সময়েও সমর্থন দেওয়ার কোন সুযোগ আছে বলে মনে করি না। তাছাড়া তাকে সমর্থন দেওয়ার মাঝে কোন নৈতিকতাও খুঁজে পাই না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আমলাতন্ত্রের আসন্ন আগ্রাসী থাবার প্রতিবাদ করতে হলে যৌক্তিক উপায়ে, প্রয়োজনে আইনি পন্থায় এমনকি প্রয়োজন হলে রাজপথে নেমে তার প্রতিবাদ করতে হবে। কোন অন্যায়কে সমর্থন দিয়ে বা দুরাচার কোন সহকর্মীকে সমর্থন দিয়ে এই প্রতিবাদ করতে গেলে সেই প্রতিবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই সর্বমহলে অবধারিত প্রশ্নের অবতারণা হবে। এই সত্যটিও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

যেসব চিকিৎসক ভাইয়েরা এই মহাপরিচালককে বলির পাঠা বলতে চাচ্ছেন তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে চাই- এই করোনাকালের শুরুতে বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও 'আমরা শতভাগ প্রস্তুত আছি' বলে বলে তিনি ও তার মন্ত্রী সরকারকে যে ভুল মেসেজ দিয়েছিলেন এবং দেশবাসীর সাথে যে প্রতারণা করেছিলেন মূলত তারই ফলশ্রুতিতে করোনা মোকাবেলায় এতদিন পরেও আজও এক মহাবিপর্যয়কারী হ-য-ব-র-ল অবস্থার মাঝে আছি আমরা!

শুরুতে কর্মস্থলে পরিধানের জন্য কোনরকম স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী না পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চিকিৎসকরা যখন আওয়াজ তুলছিল তখন এই মহাপরিচালক বলেছিলেন চিকিৎসকরা করোনা হাসপাতালে না যাওয়ার জন্য বা পালানোর জন্য বাহানা খুঁজছে!
তাকে সমর্থন করা আমার চিকিৎসক সহকর্মীরা মনে হয় সেসব কথা ভুলে গেছেন! এরপর পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রী বা পিপিই পাওয়া গেলেও তার মান এবং সরবরাহকৃত নকল মাস্কের কার্যকারিতা ও কেনাকাটায় অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকরা যখন প্রশ্ন তুললেন তখন আমরা দেখলাম এই মহাপরিচালক ও তার মন্ত্রণালয়ের সাথীরা মিলে যোগসাজশে প্রশ্ন তোলা সেইসব পরিচালকদের গণহারে বদলি বা ওএসডি করা শুরু করলেন! তাকে সমর্থন করা আমার চিকিৎসক সহকর্মীরা মনে হয় সেসব কথাও ভুলে গেছেন!

কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতালের বিভিন্ন অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে যখন সেখানে কর্মরত সাধারণ চিকিৎসকরা আওয়াজ তুললেন তখন আমরা দেখলাম এই মহাপরিচালকের ইশারায় কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চিকিৎসকদের প্রতিবাদী আওয়াজ বন্ধ করতে আমাদের ৬ জন চিকিৎসক সহকর্মীর বিরুদ্ধে 'ডিউটি না করতে চাওয়া'র মিথ্যা অভিযোগ এনে তাদেরকে বরখাস্ত করলেন। তাকে সমর্থন করা আমার চিকিৎসক সহকর্মীরা মনে হয় সেসব কথাও ভুলে গেছেন!

চিকিৎসকরা যখন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালেই পিপিই'র জন্য হাহাকার করছিলো তখন এই মহাপরিচালক হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য সংখ্যক পিপিই সরবরাহ করে জালিয়াত জেকেজি গ্রুপকে হাজার হাজার পিপিই সরবরাহ করেছিলো! তাকে সমর্থন করা আমার চিকিৎসক সহকর্মীরা মনে হয় সেসব কথাও ভুলে গেছেন!

করোনাকালে চিকিৎসকরা কিভাবে রোগীসেবা দিচ্ছেন, রোগীরা কতটুকু সেবা পাচ্ছেন, রোগীসেবা দিতে গিয়ে চিকিৎসকরা কী কী সঙ্কটের মুখে পড়ছেন, তারা কোথায় থাকছেন, কী খাচ্ছেন তা দেখতে একজন অফিসিয়াল চিকিৎসক অভিভাবক হিসেবে কোন হাসপাতালে এই মহাপরিচালক একদিনের জন্য ভিজিটে না গেলেও জালিয়াত জেকেজি'র ফিল্ড ভিজিটে তিনি ঠিকই গিয়েছিলেন, তাদের সাথে হাসিমুখে সময়ও ব্যয় করেছিলেন। তাকে সমর্থন করা আমার চিকিৎসক সহকর্মীরা মনে হয় সেসব কথাও ভুলে গেছেন!

এই মহাপরিচালক যখন নিজে করোনাক্রান্ত হয়েছিলেন তখন তার অধীনে পরিচালিত কোন সরকারি হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অকালে প্রাণ হারানো আমাদের কোন সহকর্মী চিকিৎসক ও প্রথিতযশা কোন অধ্যাপকও সেই সুযোগটি পাননি! তাকে সমর্থন করা আমার চিকিৎসক সহকর্মীরা মনে হয় সেসব কথাও ভুলে গেছেন!

চিকিৎসক সহকর্মী মৃত্যুর মিছিলের শুরুতে করোনাক্রান্ত ডা. মঈন উদ্দিন ভাইয়ের অবস্থা অতিশয় সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠলে তাকে সিলেট থেকে ঢাকা স্থানান্তরের জন্য যখন এই মহাপরিচালকের কাছে সাহায্য চাওয়া হয়েছিলো তখন তিনি চরম নির্দয়ভাবে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। তাকে সমর্থন করা আমার চিকিৎসক সহকর্মীরা মনে হয় সেসব কথাও ভুলে গেছেন! শুধু ডা. মঈন উদ্দিন নয় এ পর্যন্ত প্রায় ৯০'র কাছাকাছি সহকর্মী চিকিৎসক ও প্রথিতযশা অধ্যাপককে হারিয়েছি আমরা, অনেকেই হারিয়েছেন তাদের প্রাণপ্রিয় আপনজন মা কিংবা বাবা, ভাই কিংবা বোন, স্বামী কিংবা স্ত্রী! শুধুমাত্র এই মহাপরিচালক ও তার মন্ত্রী ও অন্যান্য সভাসদদের চরমতম গোঁয়ার্তুমি ও স্বেচ্ছাচারিতা এবং সীমাহীন সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে এতগুলো প্রাণ অকাতরে অসময়ে ঝরে গেলো! এই ব্যর্থতার দায় কি তারা কেউ অস্বীকার করতে পারে?

এই মহাপরিচালকের পৃষ্ঠপোষকতায় সুযোগ পাওয়া জেকেজি ও রিজেন্ট সাহেদের চরমতম জালিয়াতির কারণে সারাবিশ্বের নামকরা সব পত্রিকায় আমার দেশ আজ চরমতম নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হচ্ছে। মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে আনা মাস্ক কেলেঙ্কারি, জেকেজি সংশ্লিষ্টতা ও রিজেন্ট সাহেদসহ হাজারো অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ যদি তদন্ত হওয়ার আগে বা তর্কের খাতিরে অস্বীকারও করি তবুও করোনা মোকাবেলায় তার বা তাদের ব্যর্থতার দায় তো কোনমতেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

নিরপরাধ সহজ সরল কেউ যখন অন্যায় দণ্ডে ফেঁসে যান সাধারণত তখন আমরা তাকে 'বলির পাঠা' বলি। আমাদের মহাপরিচালক তো ধোয়া তুলসীপাতা ছিলেন না। সুতরাং তিনি কীভাবে বলির পাঠা হন সেটাই বোধগম্য নয়!

এটা ঠিক যে করোনা মোকাবেলায় এই সামগ্রিক বিপর্যয়, ব্যর্থতা, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির দায় শুধু মহাপরিচালকের একার নয় বরং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য পদ-পদবিধারীদের উপরেও একইভাবে এই দায় বর্তায়।

আমরা চাই, অপরাধী যতবড় পদেই আসীন হোক না কেন একে একে তাদের সকলের দায়ই উন্মোচিত হোক এবং সে যতবড় রুই-কাতলাই হোক না কেন তার যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত হোক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত