কাসমির রেজা

২৭ জুলাই, ২০২০ ১৫:২২

উপাচার্য হাবিবুর রহমান আমাদের বাতিঘর

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে যে ক'জন উপাচার্যকে সিলেটবাসী শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে অধ্যাপক মোঃ হাবিবুর রহমান তাদের অন্যতম। সিলেটের সকল প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাকে সামনের সারিতে দেখা যেত। ছিলেন একজন জনপ্রিয় শিক্ষক ও দক্ষ প্রশাসক। তিনি সিলেটের প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীদের কাছে ছিলেন অভিভাবক তুল্য। হৃদয় লালন করতেন বাঙালিত্বকে। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন 'বিশ্ব মানব হবি যদি শাশ্বত বাঙালি হ'। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করতেন মানুষে-মানুষে কোন বিভেদ করতেন না। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প থেকে দেশকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। স্বপ্ন দেখতেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়া গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের। স্বাভাবিকভাবেই যারা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক, সামাজিক আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ছিল স্যার তাদের কাছে অপ্রিয় ছিলেন। তার আদর্শিক দৃঢ়তা  ও মনোবলই এর কারণ। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তা অকপটে বলতেন। আজ ২৭ জুলাই।‌ ২০০৬ সালের এই দিনে তিনি পরলোকগমন করেন।

অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান ১৯৪২ সালে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার দীর্ঘ ৩৬ বছরের কর্মজীবনের বড় সময়টি কাটিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। সেখানে তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সকল প্রগতিশীল সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯২ সালে নবগঠিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, উপ-উপাচার্য এবং উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একজন সমাজ বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি মৌলিক গবেষণায়ও রত ছিলেন। আত্মহত্যাপ্রবণ ঝিনাইদহ এলাকাকে নিয়ে তিনি একটি পদ্ধতিগত সাইন্টিফিক গবেষণা করেছিলেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তার লেখা দশটি বই রয়েছে। এছাড়াও যৌথভাবে ছয় টি বই রচনা করেছেন। এসব বই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম ও সমাজবিজ্ঞানের রেফারেন্স বুক হিসেবে পঠিত হচ্ছে।

অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই পুরো সময়টিতেই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। তাই স্যার কে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকা অবস্থায়ও তিনি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিতেন। তার সময়টা ছিল শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক বিকাশের সোনালী সময়। ঐ সময় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠে। সারাদিন ক্লাস শেষে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুরের মূর্ছনায় মুখরিত থাকত ক্যাম্পাস। ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীলতা বিকাশে স্যার সব সময় সচেষ্ট ছিলেন।  তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বা উপাচার্য হিসাবে তাকে দেখে আমি যতটা মুগ্ধ হয়েছি তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি সিলেটের প্রগতিশীল আন্দোলনে তার ভূমিকা দেখে। তখন আমি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সিলেট জেলা সংসদে সক্রিয় ছিলাম। জাতীয় কবিতা পরিষদের সিলেট জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এই সুবাদে তখন সিলেটের প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একজন ক্ষুদে কর্মী হয়ে স্যার কে পেয়েছিলাম একজন অভিভাবক হিসেবে। একজন উপাচার্য হিসেবে পদের ভারে নিজেকে সামাজিকতা থেকে গুটিয়ে নেওয়ার যে মানসিকতা অনেক উপাচার্যগণের মধ্যে দেখা যায় স্যারের মধ্যে সেটি ছিল না। ছিলেন সহজ মানুষ। উদীচীর ছোট্ট রিহার্সেল রুমে বসেও স্যারের বক্তব্য শুনেছি। শুনেছি সিলেটের বড় বড় হল গুলোতে। স্যার বলতেন প্রত্যেক মানুষেরই আলাদা ধর্মীয় পরিচয় আছে; কিন্তু এই ভূখণ্ডের নাগরিক হিসেবে আমাদের আসল পরিচয় আমরা বাঙালি। আমাদের অনেক গর্ব করার মতো বিষয় রয়েছে। তিনি আরো বলতেন, দেশকে ভালবাসতে হবে মায়ের মত। তিনি শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে স্যারের ক্লাস করার সৌভাগ্য আমার হয়নি; কিন্তু শহরে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, অডিটোরিয়ামে স্যারের বক্তব্য তন্ময় হয়ে শুনতাম। ভালোলাগা আচ্ছন্ন করত।

স্যার সিলেটের প্রগতিশীল আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৯৫ সালে সিলেটে কবি শামসুর রাহমান কে সংবর্ধনা প্রদানের লক্ষ্যে সিলেটের প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সময়টা অনেক প্রতিকূল ছিল।  শেষ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের বাধার কারণে অনুষ্ঠানটি হয়নি।  সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েই তিনি তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

২০০৫ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর ছিল আমার জীবনে একটি স্মরণীয় দিন । সেদিন আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসে ছিলাম।  সকালে আমি যখন বরের বেশে সাজছিলাম হঠাৎ আমার বাসায় স্যার এসে হাজির হলেন। আমি খুব আনন্দিত হয়েছি তবে কিছুটা বিস্মিত হয়েছি। স্যার অনেক ব্যস্ত মানুষ তার উপর এই সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। আমি যখন দাওয়াত দিতে বাসায় গিয়েছিলাম স্যার বলেছিলেন শরীর টা ভাল না। তবু এসেছেন। সকালের এই সময়টাতে সাধারণত বাড়ির বাবা-মা সহ অভিবাবকরা আশীর্বাদ করেন। তখন আমার বাবা জীবিত ছিলেন না। মা ছিলেন। আরো কয়েকজন অভিভাবক ছিলেন। স্যার এসে সেই অভিভাবকদের দলে মিশে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করলেন। এটি শুধু আমার ক্ষেত্রে ঘটেনি, অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। এটি ছাত্রছাত্রী কিংবা প্রগতিশীল আন্দোলনের ক্ষুদে কর্মীদের প্রতি তার ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।

২০০১ সালে দেশব্যাপী চলমান সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে যখন আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছিলাম বিভিন্ন দিক থেকে নানা হুমকি এসেছে। স্যার সাহস যুগিয়েছেন।

২০০৫ সালের শুরুতে সাবেক অর্থমন্ত্রী সিলেটের কৃতি সন্তান শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকান্ডের পর সিলেটে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। আন্দোলন গড়ে ওঠে। কিবরিয়া সাহেবের পরিবারের পক্ষ থেকে 'রক্তের অক্ষরে শপথের স্বাক্ষর' নামে একটি আন্দোলন হয়। সেই আন্দোলনে সিলেটে একটি কমিটি হয়। এর আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান স্যার। সিলেটের সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের বাসায় এ নিয়ে সভা হয়েছিল এবং সেদিনই কমিটি গঠন হয়। আমি ছিলাম এই কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। তখন স্যারের দেয়া প্রেরণাদায়ক বক্তব্য আমার এখনো মনে পড়ে।

২০০০ সালে একুশের বই মেলায় আমার প্রথম কবিতার বই ' মেঘ ছুঁয়েছে চাঁদের কপোল' প্রকাশিত হয়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি অডিটোরিয়ামে এর একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে ১৫ আগস্ট নিয়ে লেখা আমার একটি কবিতার কয়েকটি লাইনও তিনি পড়ে শোনান। সবই আজ স্মৃতি।

স্যার শুধু একজন উপাচার্য ছিলেন না, একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে সমাজের প্রতি তার যে দায়বদ্ধতা তা তিনি সবসময় মনে রেখেছেন। নিজে সমাজ সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এবং সমাজকে সঠিক নির্দেশনা দিয়ে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অন্ধকারময় সমাজে আলো ছড়িয়েছেন। তিনি আমাদের বাতিঘর। স্যারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত