ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ

১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৯:১২

বাবাকে মনে পড়ে

স্মরণ : শহীদ ডা শামসুদ্দীন আহমদ

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অথবা ৯ এপ্রিলে এখনো সিলেট শহরের মানুষ এবং তরুণেরা মুক্তিযুদ্ধের এক মহান সৈনিক আমার বাবা শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের কবরে এবং স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে যান। আমার বাবা সম্মন্ধে প্রাণখুলে আলোচনা করতে পারি না। ক্ষতটা এখনো গভীর। এত দিন পরেও কষ্ট হয়, তাই আমরা  অনেক সময় চুপিচাপ বসে থাকি, অনুভব করার চেষ্টা করি।

মুক্তিযুদ্ধে লক্ষলক্ষ শহীদের পরিবার এবং তাদের ইতিহাস যদি উপেক্ষিত থাকে তবে শুধু নিজের বাবার কথা বলতেও বাধে। বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক গর্বের ইতিহাস এবং অনেক দুঃখের ইতিহাস। বাবার  কথা মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছা করে যখন দেখি আমাদের প্রজন্মরা খুঁজে বেড়ায় নিজেদের অস্তিত্বকে, মূল্যবোধকে, নিজেদের মহান এবং অনুকরণ করার মত গর্বিত হবার ইতিহাসকে। বলতে ইচ্ছে করে তার আত্মত্যাগ অকস্মাৎ কোনও ঘটনা ছিলো না। তার সমস্ত জীবন, প্রতিটি পদে পদে তিনি অবলীলায় মানুষের সেবার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি কোনোদিন কোনো প্রতিদান বা স্বীকৃতি নিতে চাননি। তিনি বলতেন মানুষের জন্য কাজ করতে পারাটা সৃষ্টিকর্তার একটি আশীর্বাদ।

দুয়েকবার তার জন্য রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বাধীনতা পদক দেবার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। যে কোনো কারণে তা হয় নি এই জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তার দেশপ্রেম এবং আত্মাহুতি একটি পদকের সীমাবদ্ধতায় রইলো না।   

সিলেটের মানুষের স্মৃতিসৌধে সম্মান, মেডিকেল ছাত্রবাস এবং হাসপাতালের নামকরণ এইসব স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি অনেক গভীর ভাবে প্রতিফলিত হয় তাদের ভালবাসার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
 
সারা জীবন আমার বাবা ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ কর্মী। ব্রিটিশ ভারতে স্কুলজীবন থেকে বয় স্কাউট থেকে সমাজ সেবা শুরু করে, ব্রিটিশ আমলে আসামের প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেয়া, বন্যা, বার্মা থেকে আসা উদ্বাস্তু শিবির, হজ ক্যাম্প, কোলকাতায় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা ঠেকাতে আত্মনিয়োগ করেন।  কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে এবং দ্বিখণ্ডিত ভারতে নুতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান গড়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ হয়ে সিলেটের ভারতের অংশের করিমগঞ্জ থেকে পাকিস্তানে চলে আসেন।  ঢাকাতে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মরত থাকেন। ঢাকাতে থাকার সময় তিনিই প্রথম  পূর্বপাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সচিব হয়ে মেডিকেল এসোসিয়াশনের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যান। পূর্বপাকিস্তানের প্রথম মেডিকেল সাহায্য সংস্থা "পাকিস্তান অ্যাম্বুলেন্স কোরের" তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং ১৯৫৪ সালে দেশব্যাপী বন্যায় সরকার তার উপর পুরো দায়িত্ব প্রদান করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে বন্ধ করে ছাত্র এবং ডাক্তাররা তার নেতৃত্বে দেশব্যাপি এক অভাবনীয় মেডিকেল রিলিফ কার্য পরিচলনা করেন। তার অসীম দেশপ্রেম ও কর্মদক্ষতা পাকিস্তান সরকার তাকে সুনজরে দেখেনি। তাই এ ঘটনার পর থেকে তাকে ঢাকার বাইরে বদলি করা হত এবং ১৯৫৮ এ লন্ডনে গিয়ে সার্জেরীতে এফআরসিএস ডিগ্রি নিতে অনেক বাধার সৃষ্টি করেছিল। সেই সময় থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের কোনোদিন ভালো চোখে দেখবে না। ১৯৬২ সালে লন্ডন থেকে ফিরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদেন করেন। চাকুরী জীবনে কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, চিটাগং যখন যেখানে গিয়েছেন সেখানে নিজের করে গড়ে তুলেছেন তার কর্মপরিধি যা শুধু হাসপাতাল নয়, মেডিক্যাল এসোসিয়েশনসহ মানুষের সেবার জন্য গড়ে তুলতেন সব ধরণের সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তার সাহস ছিল অপরিসীম।  ১৯৬৯ এ গণ অভ্যুতানের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা গুলি এবং বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। তখন মার্শাল ল' এবং পাকিস্তানি কর্নেলের চোখ রাঙানো এবং প্রতিবাদ সত্ত্বেও ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ পোস্ট মর্টেমের পূর্ণ রিপোর্ট পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করেন এবং তারই সভাপতিত্বে এই হত্যার প্রতিবাদের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। তার এই প্রেস রিপোর্টে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে আয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনে প্রচন্ড শক্তি সঞ্চার হয় এবং কিছু দিন পরে আয়ুব খান সরকারের পতন হয়। এরপর থেকে পাঞ্জাবিদের বাঙালি ঘৃণার মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। অনেকের ধারণা সেই সময় থেকেই তিনি পাকিস্তানি মিলিটারির মৃত্যু তালিকাতে অন্তর্ভুক্ত হন।

সেই সময় সিলেটে সেই উত্তাল আন্দোলনে আমি এমসি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রও  ঝাঁপিয়ে পড়ি।  কেন্দ্রিয় মন্ত্রীর বাড়িতে একপর্যায়ে কালো পতাকা তুলে ধরি এবং আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। আমাকে বলা হয় তোমার বাবার সরকারি চাকরি চলে যাবে। সেই ভয়ে বন্ধুর পরামর্শে আমি স্থানীয় গোয়েন্দা বিভাগের কথায় আন্দোলনে আর যাবোনা বলে সাদা কাগজে সই করার জন্য প্রস্তুত হই। সেইদিন রাতে বাবা আমাকে ডাকলেন। বাবা ছিলেন খুব গুরুগম্ভীর এবং কম কথা বলতেন। তার ধীর কণ্ঠে বললেন তুমি যদি এটাকে সঠিক আন্দোলন মনে কর তবে তোমার বাবার চাকরির জন্য তোমার ভয় নেই। ডাক্তাররা প্রাইভেট প্রাকটিস করেও খেতে পারে। তবে তুমি যদি তোমার আন্দোলনের পরিণতির জন্য ভয় পাও তবে আণ্দোলনে যাবার দরকার নেই। শুধু এডভেঞ্চার করার জন্য যাবে না। তুমি ভয়ে পালিয়ে আসলে আরেকটি সত্যিকারের উদ্বুদ্ধ ছেলে তোমার প্ররোচনায় গুলি খাবে। কিছুক্ষনের জন্য বুঝতে চেষ্টা করলাম। তারপর আমি হুলিয়া মাথায় নিয়ে মহা উৎসাহে আবার আন্দোলনে ফিরে গেলাম। তার কথার ইঙ্গিত আমাকে সারা জীবন অনুপ্রাণিত করেছে।

বাবাকে খুব কাছে বেশিদিন পাইনি। আমার উঠতি বয়সে বাবার সরকারি চাকরির জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে থাকা এবং আমার মা সিলেট মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ থাকার জন্য আমাদের বেশির ভাগ সময়ে সিলেটে থাকতে হয়েছে। তবে তার সমাজসেবা এবং প্রতিটি কাজ খুবই গভীর ভাবে পরিলক্ষিত করতাম।

১৯৭০ এ তিনি সিলেট মেডিকেল কলেজে  সার্জারির প্রধান হয়ে বদলি হয়ে আসেন। ১৯৭১ এ মার্চ মাসের প্রথম থেকেই তিনি আসন্ন পাকিস্তানিদের হত্যাযজ্ঞের আশংকায় ইমার্জেন্সি  টীম এবং রক্তের ব্যাংক তৈরী করেছিলেন। অনেকেই তখন তার এই উদ্যোগের  বিশ্বাসযোগ্যতা  বুঝতে পারেনি। ২৫ মার্চে অতর্কিতে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানী সৈন্যরা। বিমূঢ় হয়ে যায় দেশবাসী। বাবা বললেন- নির্বাচনে জেতার পরে এইরকম নৃশংসতা মানে হচ্ছে বাঙালির মেরুদন্ড এইবার ভাঙ্গবে তারা। ব্যস্ত থাকলেন হাসপাতালে দিন রাত অসংখ্য গুলিবিদ্ধ মানুষের সাহায্যে। এপ্রিলের দুই তারিখ সিলেট ক্যান্টমেন্টের পাকিস্তানীরা তাদের দুই জন বাঙালি অফিসারকে গুলি করে হাসপাতালে ফেলে যায়। একজন ক্যাপ্টেন মাহবুব মারা যান তবে লেফটেন্যান্ট ডাঃ সৈয়দ  মাইনুদ্দিন বেঁচে যান। সেই দিন আমি প্রথম বর্ষ মেডিকেলের ছাত্র এবং আমার এমসি কলেজের ছাত্র বন্ধু সালাম [কর্নেল (অব:) বীর প্রতীক] ঠিক করলাম আর বসে থাকা যাবে না। তখনও কে কোথায় যুদ্ধে আছে জানি না। ঠিক করলাম বিয়ানীবাজারে পুলিশ তখন অস্ত্র জমা দেয়নি।  তাদের অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবো। বিয়ানীবাজারে গিয়ে দেখি কর্ণেল (অবঃ) আব্দুর রব যিনি তখন একজন এমপি।  তিনি আমাদের তক্ষুনি তেলিয়াপাড়া গিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিতে আদেশ করলেন। আমরা তখন করিমগঞ্জ হয়ে আগরতলা দিয়ে আবার বর্ডার দিয়ে ঢুকে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে পৌঁছলাম।

যেহেতু আমরা আগে থেকে রাইফেলে পারদর্শী ছিলাম তাই শুধু গ্রেনেড এবং সাবমেশিনগান চালনা শেখানো হয়। এরপর আমরা মাধবপুর এলাকায় কাপ্তাই নাসিমের সাথে এবং পরে লেফটেন্যান্ট হেলাল মুর্শেদের সাথে সম্মুখ সমরে ঝঁপিযে পড়ি। সিলেটে কি হয়েছে তখনও আমরা জানি না।
 
এদিকে এপ্রিলের তিন তারিখে সিলেটে যখন সেকেন্ড ইস্ট বেঙল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনানীরা ক্যাপ্টেন আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে সিলেট আক্রমণ করে তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা সিলেট থেকে সালুটিকর ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান নেয়। এই ভয়াবহ যুদ্ধে যখন হাসপাতালে যুদ্ধাহত সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে ততই শহরের মানুষ সিলেট ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে যেতে থাকেন। প্রায় জনশূন্য এবং ডাক্তারবিহীন হাসপাতালে আগলে রাখলেন মেডিকেল কলেজের সবচেয়ে প্রবীণ অধ্যাপক, সার্জারির প্রধান ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ। তরুণ ইন্টার্ন ডা. শ্যামল কান্তি লালা তার অধ্যাপককে ছেড়ে গেলেন না। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে ডা. শামসুদ্দিন অনেক রোগী, মেয়ে নার্স, রোগীর স্বজনদেরকে হাসপাতাল ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে যাবার নির্দেশ দিলেন। নিজের পরিবারকেও আগেই গ্রামে পাঠিয়েছিলেন তবে স্ত্রীকে বাড়িতে থেকে যেতে বললেন। কারণ নার্সরা চলে গেলে তাকে কাজে লাগাতে হবে।  এম্বুলেন্স ড্রাইভার আলী, পুরুষ নার্স মাহমুদুর রহমান তার সাথে থেকে গেলেন। ৯ এপ্রিলে বিপ্লবীরা ভয়ানক যুদ্ধে শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হল এবং সেই সময় হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা হাসপাতালে ঢুকে আহতদের সেবায় কর্মরত অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ, ডা. শ্যামল কান্তি লালা, এম্বুলেন্স ড্রাইভার  আলী, পুরুষ নার্স মাহমুদুর রহমানসহ আরো কয়েকজন রোগী তাদের পরিজনদের হাসপাতালের ভিতর হত্যা করে। তিনদিন পর তিন ঘন্টার জন্য কার্ফু ভাঙলে তার চাচা তৎকালীন এইডেড স্কুলের প্রধান শিক্ষক মঈনুদ্দিন হোসাইন তাকে এবং অন্যান্যদের হাসপাতালের ভিতর রাস্তার পাশে মহিলা কলেজের দারোয়ান তৈয়ব  আলী ও স্বল্প কিছু মানুষকে নিয়ে কবরস্থ করেন।

আমি তখন মনতলা এলাকায় যুদ্ধরত। বন্ধু সালামসহ সেক্টর কমান্ডার মেজর শাফিউল্লাহ সবাই জানেন আমার বাবার কথা কিন্তু তারা আমাকে জানায়নি। যুদ্ধের অনিশ্চয়তায় সবাই দিশেহারা। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই তখন একমাত্র লক্ষ্য। একদিন আমি একটি অপারেশনের পর ক্লান্ত ক্ষুধার্ত হয়ে ক্যাম্পে ফিরে এসেছি বিকেলে ভাত খাবার জন্য। দেখি একজন যুদ্ধাহত পায়ে প্লাস্টার বাধা সৈনিক ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলো।  আমাকে গভীর কণ্ঠে বললো আপনার বাবা বড় ভালো মানুষ ছিলেন, আমাদের বড় গৌরব। আজকে উনার জন্য আমি এখনো জীবিত। আল্লাহ উনাকে শাহাদাতের মর্যাদা প্রদান করুন। আমি যেন বজ্রাহত, মাথা ঘুরতে লাগলো, মা-ভাই-বোন  কে কোথায় আছে কি ভাবে আছে। হঠ্যাৎ পিঠে হাত রাখলো কে।  দেখলাম সালামের চোখে জল। বুঝতে চেষ্টা করলাম আমরা কোথায় আছি।  একটা মহাশূন্যতা গ্রাস করার চেষ্টা  করলো।  আবার বাবার কথা মনে পড়লো। তার মনুষের জন্য গভীর ভালোবাসার কথা, তার দেশের জন্য উদ্বিগ্নতার কথা। মনে হল বাবা তো যেন সঙ্গেই  আছেন। তার তো কোথাও পালাবার যো নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে, জেগে থাকবেন প্রজন্মদের মাঝে। যারা নিষ্ঠভাবে, নিঃস্বার্থভাবে মানুষের দুঃখ দেখে এগিয়ে আসবে তাদের মাঝে।

বাবা বলতেন তুমি যে দেশে জন্মেছ, যে পরিবারে থেকে পড়াশুনা করে বড় হবার সুযোগ পেয়েছো তা থেকে তোমার উপর একটি বড় দায়িত্ব এসে গিয়েছে। শুধু ডাক্তারি করলে চলবে না, সমাজের যেভাবে যখন প্রয়োজন হবে তোমাকে সবার আগে ছুটে যেতে হবে। প্রতিদান আশা করবে না কারণ এটি তোমার দায়িত্ব। আর সৃষ্টিকর্তার দয়া করে দেয়া বিদ্যা বুদ্ধি অপব্যবহার করবে না।  বহু বছর থেকে আমি আমেরিকাতে আছি।  শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবার সুযোগ হয়নি চিকিৎসা শাস্ত্রের কিডনি সহ পাঁচটি বিষয়েও আজ বিশেষজ্ঞ। পেশাগত কার্যকক্রমের বাইরে দেশ, সমাজ, বাংলা সংস্কৃতি, মেডিকেল এসোসিয়েশন এবং আন্তর্জাতিক চিকিৎসা ক্ষেত্রেও সমানভাবে বিচরণ করছি। গত ১৫ বছর থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে গিয়ে চিকিৎসা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি।  আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করে আপনি এত কিছু করার কোথায় সময় পান। উত্তর দেই না তবে ঠিক বুঝি আমার মা ও বাবা  সবসময়  আমার সাথে, কোথাও আমার বুকের মাঝে সারাক্ষণ জেগে আছেন।  

কয়েক মাস আগে আমার মা নিউইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন। সিলেটের নারী শিক্ষার অগ্রদূত আমার মার আত্মত্যাগ একটি বিরল দৃষ্টান্ত।  তার মৃত্যুর কিছু দিন পূর্বে আমেরিকার কংগ্রেস অনুমোদিত পেশাগত ও সমাজ  উন্নয়ন কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আমাকে "এলিস আইল্যান্ড মেডেল অনার" প্রদান করা হয়। আমার মা খুশি হয়েছিলেন তবে মৃদু হেসে বলেছিলেন তোমার কাজ কিন্তু বেড়ে গেলো, এটা কে পুরস্কার মনে না করে আরেকটা দায়িত্ব হিসেবে মাথায় নিও। আজ মনে হয় যত দিন বেঁচে থাকব তত দিন তাড়িত হবো তাদের  অনুপ্রেরণায়। আর কোন যেন উপায় নেই।

বাবা সিলেটে যেখানে চিরনিদ্রায় আজ শায়িত সেখানে গড়ে উঠেছে  মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ। পাশে গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার। সিলেটে মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয় পথচারীকে।  শহীদ ডা. শামসুদ্দিন ও তার সহযোদ্ধাদের ইতিহাস সর্বস্থরের মানুষের ও প্রজন্মদের ভিতর এই অবিস্মরণীয় আত্মত্যাগ আরো যেন স্মরণ করিয়ে দিবে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের অজানা ইতিহাস।  যারা বেঁচে আছেন, যারা স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে চলার অধিকার পেয়েছেন তাদের কাছে এই ঋণের অঙ্গীকার হবে শুধু একটুখানি নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম আর মানুষের জন্য ভালোবাসা।

লেখক : শহীদ ডা. শাসসুদ্দিন আহমদের ছেলে, আমেরিকা প্রবাসী চিকিৎসক।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত