প্রণবকান্তি দেব

০৫ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩ ১১:৫০

‘ফিরে এসো স্কুল লাইব্রেরি’

শুরুটা করছি বিনয় মজুমদারের কাছে ঋণ স্বীকার করে। শিরোনামটা তাঁর 'ফিরে এসো, চাকা' কবিতার ভাব থেকে নেয়া। এবার আসা যাক মূল আলোচনায়। একটা মানুষের জীবনে, তার বেঁড়ে ওঠার পথে পথে একটা লাইব্রেরি কিংবা গ্রন্থাগারের গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। অন্যদিকে, মানুষ তার জীবন ও জগতকে চেনা-জানার প্রথম আনুষ্ঠানিক পাঠ শুরু করে স্কুল থেকেই। কাজেই এটা নিঃসংকোচেই বলা যায় যে, 'স্কুল লাইব্রেরি' শব্দযুগলের ভেতর মিশে আছে দীঘল এক স্বপ্ন-সম্ভাবনার ভুবন। এটি একটি স্কুলের সবচেয়ে দীপ্যমান জায়গা যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেকে গড়ে, ভাঙে; স্বপ্নের সৌধ রচনা করে আপন আলো দিয়ে। বস্তুতপক্ষে, লাইব্রেরি হচ্ছে জ্ঞান সংগ্রহ, সংরক্ষণ, অনুসন্ধান, জ্ঞান বিতরণ এবং বিকাশের আদর্শ স্থান। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মরণযোগ্য। কবিগুরু তাঁর 'শিক্ষার হেরফের' প্রবন্ধে বলেন, "হাওয়া খাইলে পেট ভরে না, আহার খাইলে পেট ভরে, কিন্তু আহারটি রীতিমত হজম করিবার জন্য হাওয়া খাওয়ার দরকার। তেমনি একটা শিক্ষাপুস্তককে হজম করিতে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের আবশ্যক। আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে পড়িবার শক্তি অলক্ষিত বৃদ্ধি পাইতে থাকে ; গ্রহণশক্তি, ধারণাশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বললাভ করে।" এই যে 'একটা শিক্ষাপুস্তককে হজম করিতে অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের আবশ্যক'- সেই 'অনেকগুলি পাঠ্যপুস্তকের' সমাহার হল লাইব্রেরি যেখানে 'আনন্দের সহিত পড়িতে পড়িতে পড়িবার শক্তি অলক্ষিত বৃদ্ধি পাইতে থাকে ; গ্রহণশক্তি, ধারণাশক্তি, চিন্তাশক্তি বেশ সহজে এবং স্বাভাবিক নিয়মে বললাভ করে।"

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের স্কুল লাইব্রেরিগুলো কেমন আছে? সব স্কুলে কি লাইব্রেরি আছে? প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিকে? এসবের হিসাব কি কোথাও আছে? বাংলাদেশের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এমনিতেই আছে শ্রেণীকক্ষ সংকটে। একটা সময় দেখা যেতো প্রধান শিক্ষকের কক্ষে একটা আলমারিতে কিছু বইপত্র দিয়ে লাইব্রেরির কাজ চালানো হতো। এখনো অনেক স্কুলে লাইব্রেরির জন্য আলাদা কক্ষ বরাদ্দ দেয়ার সুযোগ নেই। একই চিত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও। মুজিববর্ষে দেশজুড়ে বিভিন্ন স্কুলে 'মুজিব কর্নার' স্থাপিত হলেও এগুলোর ব্যবহার কেমন হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে সে খবর আর পাওয়া যায় নি। অনেক স্কুলে ভর্তির সময় 'পাঠাগার ফি' নেয়া হয় কিন্তু বাস্তবে পাঠাগার চর্চার সুযোগ নেই। ক'বছর আগে স্কুলগুলোতে 'লাইব্রেরি পিরিয়ড' রাখার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি নির্দেশনা দিয়েছিল কিন্তু তার প্রয়োগ হচ্ছে কোথায়?

একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে মাধুর্য্যময় স্থান হচ্ছে তার লাইব্রেরি। স্কুল লাইব্রেরিতেই বিকাশ ঘটে একজন শিক্ষার্থীর সৃজনশীল ভাবনার। ছেলেমেয়েদের মনোজগতের বিকাশ ঘটে লাইব্রেরির আড্ডায়। বিশেষ করে আমাদের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য লাইব্রেরির অপরিহার্যতা অনেক। সরকারী স্কুলগুলোর অনেক শিক্ষার্থী সিলেবাসের বইপত্র কিনতেই হিমশিম খান। বাইরের বই কিনে পড়া তাদের কাছে বিলাসিতা মাত্র। সেখানে প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিই তাদের কাছে 'আউট বইয়ের' স্পর্শ পাওয়ার একমাত্র উপায়। যে স্পর্শ আসলে জীবনের অপার, অসীম আনন্দকে ছুঁয়ে দেখার, ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি দেয়া শিশুকিশোরের অবাক চোখে পৃথিবীকে জানার। লাইব্রেরিতে থাকা বিচিত্র বই, সংবাদপত্র, সাময়িকী এসব শিক্ষার্থীদের সামনে ভবিষ্যতের স্বপ্নদূয়ার উন্মোচন করে দেয়, শিখিয়ে দেয় চিন্তা-চেতনার ধরন। স্কুলের লাইব্রেরিতেই তারা খুঁজে পায় নানাবিধ জ্ঞানের পথ। ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য, আত্মজীবনীতে তারা খোঁজে নেয় ভবিষ্যতের দিশা।

কিন্তু সেই লাইব্রেরির অবস্থা এখন হতাশাজনক। অনেক স্কুলে লাইব্রেরিয়ান পদ শূন্য। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরিয়ান আছে তো লাইব্রেরি নেই। অনেক জায়গায় লাইব্রেরিও আছে, লাইব্রেরিয়ানও আছে কিন্তু পর্যাপ্ত বই নেই। আবার কোথাও কোথাও সব আছে কিন্তু শিক্ষার্থীরা 'আউট' বই পড়লে পরীক্ষার ফলাফল ভালো হবে না-এই আশংকায় প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের ঐ পথে যেতে উৎসাহ দেয় না। অনেক পুরনো প্রতিষ্ঠানে শত শত বই থাকলেও লাইব্রেরি কক্ষটি থাকে দিনের পর দিন বন্ধ। লাইব্রেরিয়ান নিয়োজিত থাকেন অন্যান্য কাজে। এভাবেই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাইব্রেরি চর্চা দিন দিন হতাশাজনক পর্যায়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র পাঠ্যবই মুখস্থ করে যে শিক্ষা অর্জন সম্ভব নয়, এ কথা বক্তৃতা, বিবৃতিতে বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও বাস্তবে সে চর্চা নেই। আমরা যে মানবিক, হৃদয়বান, মননশীল একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার কথা প্রায়শই বলি সেটির সূচনা কিন্তু স্কুল লাইব্রেরি থেকেই হয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের আলোকময় একটি জীবনের সমস্ত আয়োজন কিন্তু থাকার কথা বৈচিত্র্যময় বিষয়ভিত্তিক বইয়ের তাকে তাকে। শিক্ষার্থীদের কোমল, কচি মনে শিল্প-সংস্কৃতিবোধ জাগিয়ে তুলে রুটিন মাফিক ক্লাসের ফাঁকে পাওয়া একটি 'লাইব্রেরি পিরিয়ড'। একটি 'লাইব্রেরি পিরিয়ড' শিশু-কিশোর মনে ভাবনার যে সলতে জ্বালিয়ে দেয়, সেই আলোই তাকে পথ দেখায় বাকীটা জীবন। উপরন্তু, ভবিষ্যতের একজন রুচিস্নিগ্ধ পাঠক হিসেবে গড়ে তোলার কাজটি সহজ করে প্রতিদিনের লাইব্রেরি চর্চা।

কিন্তু যেদিন থেকে আমাদের শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য স্থির হয়ে গেছে এ প্লাস আর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়াতে, যেদিন থেকে শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষের চেয়ে বেশী সময় দেয়া শুরু করেছেন কোচিং-এ, প্রাইভেট পড়ানোতে, যেদিন থেকে শিক্ষকেরা নিজেরা হারিয়ে গেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পথ থেকে, মূলত সেদিন থেকেই হারিয়ে গেছে স্কুল লাইব্রেরি। চাকচিক্যময় ক্যারিয়ার গড়ার দৌড়ে ভুল পড়ে গেছে 'মানুষ' হওয়ার প্রস্তুতির কথা, বিত্তের ঝনঝনাটি হারিয়ে গেছে চিত্তের শুশ্রূষা।

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা তরুণদের নিয়ে যে হাপিত্যেশ করি, আশাভঙ্গের বেদনায় জর্জরিত হই ক্ষণে ক্ষণে সেই তারুণ্যকে গড়ে তুলতে হলে লাইব্রেরি চর্চার বিকল্প নেই। আশার কথা, দেশজুড়ে ব্যক্তি উদ্যোগে পাঠাগার নির্মিত হচ্ছে, কিশোর-তরুণদের বইমুখী করতে নানা উদ্যোগ-আয়োজন চলছে। সরকারী উদ্যোগও আছে। পাশাপাশি এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে পাঠাগার আন্দোলন বেশ ছড়িয়ে গেছে। যদিও সরকারী গ্রন্থাগারগুলো পাঠক আকৃষ্ট করতে পারে না বিবিধ কারণে। অন্যদিকে, প্রযুক্তির আসক্তিতে পাঠাভ্যাস কমে যাওয়া নিয়ে এক ধরনের হাহাকার চলছেই। গত বছরের ১৪ মার্চ বিবিসি 'পাবলিক লাইব্রেরি: বিমুখ পাঠক ফেরাতে কী করছে কর্তৃপক্ষ?' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদে বলা হয় 'বাংলাদেশে গত এক দশকে পাবলিক লাইব্রেরিতে পাঠকের সংখ্যা অনেক কমেছে। ঢাকাসহ দেশের ৬৪ জেলাতেই তরুণদের পাঠাভ্যাসে যেমন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, তেমনি অনেক জায়গাতেই পাড়া-মহল্লার গত এক দশকে পাবলিক লাইব্রেরিতে পাঠকের সংখ্যা অনেক কমেছে। ঢাকাসহ দেশের ৬৪ জেলাতেই তরুণদের পাঠাভ্যাসে যেমন ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, তেমনি অনেক জায়গাতেই পাড়া-মহল্লার পুরনো ছোট লাইব্রেরিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে দেশে মোট ৭১টি পাবলিক লাইব্রেরী আছে। এর বাইরে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাথে যুক্ত লাইব্রেরির সংখ্যা প্রায় এক হাজারের মত। এছাড়া বিশেষ গ্রন্থাগার এবং ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা লাইব্রেরি আছে আরও প্রায় দেড় হাজারের মত। কিন্তু এইসব গ্রন্থাগারের বেশিরভাগই পাঠক আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছে। যারা পড়তে যান তাদেরও বড় অংশ যান চাকরির পরীক্ষা বা বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে'।

এমন বাস্তবতায়, স্কুল-কলেজ লাইব্রেরির কোনো বিকল্প নেই। তাই, ফিরে আসতেই হবে 'স্কুল লাইব্রেরি'কে। শিক্ষা অধিদপ্তর তথা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের এ নিয়ে ভাবতে হবে। 'লাইব্রেরি পিরিয়ড' চালু এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য তদারকি জোরদার করতে হবে। তাছাড়া স্কুলগুলোতে শুধু নামকাওয়াস্তে কয়েকটা বুক সেলফ সাজিয়ে না রেখে শিক্ষার্থীদের বৃহৎ কল্যাণের কথা মাথায় রেখে লাইব্রেরি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবে, আমাদের এটা মনে রাখতে শুধুমাত্র সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না। একজন শিক্ষক মন থেকে চাইলে অনেক কিছুই করতে পারেন। শুধুমাত্র ফলাফলমুখী শ্রেণি কার্যক্রমে আটকে না থেকে ছেলে মেয়েদের সামনে স্বপ্নমাখা পৃথিবীকে উন্মোচনের সুযোগ করে দিতে। এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, শিক্ষকের কাজ শুধু সিলেবাস সম্পন্ন করা না, সিলেবাসের বাইরে যে অনন্ত সম্ভাবনার জীবন, সে জীবনের রূপ-সৌন্দর্য, ঘাত-প্রতিঘাত সম্পর্কেও জানার আগ্রহ তৈরি করে দেয়া। নিয়মিত লাইব্রেরি চর্চা কিংবা বইসঙ্গ আমাদের শিশু-কিশোরদের মনোজগতে জাগাতে পারে অযুত স্বপ্নের কুহুতান। স্কুল লাইব্রেরিতে বসেই উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করতে পারে বিস্ময়ভরা জীবনের পৃষ্ঠাগুলো।

তাই বলি যেমন করেই হউক, ফিরে আসুক স্কুল লাইব্রেরি।

প্রণবকান্তি দেব, সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নির্বাহী সঞ্চালক, ইনোভেটর।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত