মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১২ আগস্ট, ২০২৩ ১৬:২৪

আন্তঃধর্মীয় সংলাপ: অনুপম প্রেরণা

বিশ্বায়নের এ যুগে বিভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য, সভা-সমাবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষ পরস্পরের কাছে আসছে, একত্রিত হচ্ছে ও একসঙ্গে কথাবার্তা বলছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন যেমন সহজতর হয়ে উঠছে, তেমনি বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি ইত্যাদির মাঝে মতপার্থক্য দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও পরমত অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিস্থিতি অবসানপূর্বক পারস্পরিক অনুপম পরিবেশ সৃষ্টির অনন্য মাধ্যম হল সংলাপ; যার মাধ্যমে পরস্পরের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়ে মনে সংকীর্ণতা দূর করে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা যায়। ফলে বিভিন্ন মহলে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের প্রতি ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তঃধর্মীয় সংলাপ (Inter Religion Dialogue) ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি (Inter Religion Harmony) সাম্প্রতিক বিশ্বের একটি বহুল আলোচিত বিষয়। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, নিরাপদ সহাবস্থান, বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও সম্প্রীতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ পরিচিতি, গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং এ সম্পর্কে আল-কুরআনের দিক নির্দেশনা তুলে ধরা হয়েছে।

সংলাপ
বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যে ‘সংলাপ’ পদবাচ্যটির ব্যবহার লক্ষণীয়। বাংলা ভাষায় এটি বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়; যা দুটি শব্দ (সম্+লপ্+অ)- এর সমষ্টি। এর অর্থ: আলাপ, কথোপকথন, নাটকের চরিত্রসমূহের পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা ইত্যাদি। সংলাপ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ‘সং’ শব্দের অর্থ সম বা সমান। ইংরেজিতে ‘সংলাপ’ এর প্রতিশব্দ ডায়ালগ (Dialogue) ব্যবহৃত হয়। আরবিতে সংলাপ-এর প্রতিশব্দ ‘আল-হিওয়ার’ ব্যবহৃত হয়। ‘হিওয়ার’ শব্দটি ধাতুমূল থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ কোনো কিছু থেকে প্রত্যাবর্তন করা, কোনো কিছু বৃদ্ধির পর তা আবার কমে আসা পুনরায় পূর্বের অবস্থায় ফেরত আসা। কুরআন মাজিদে এ অর্থটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় সূরা ইনশিকাকে। মহান আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় সে মনে করেছে যে, তার কখনই পরিবর্তন নেই।” আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে আল্লামা শাওকানী বলেন: ‘লাঁই-ইয়াহূরা’ এর অর্থ হল: লান-ইয়ারজিআ “সে কখনই ফিরে যাবে না”।

পারিভাষিক দিক থেকে ‘সংলাপ’ এর বিভিন্ন অর্থ লক্ষ্য করা যায়। সংলাপ হল নিজের সত্যতা, ধর্মীয় মূল বিশ্বাস, ন্যায্যতা, তথা সমুদয় মূল্যবোধ বজায় রেখে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও মহানুভবতা প্রদর্শন করে পারস্পরিক যে আলাপ সহভাগিতা করা হয়, তাই সংলাপ।

‘সংলাপ’ হচ্ছে, অন্যদেরকে বুঝবার বাসনায় তাদেরকে শ্রবণের সামর্থ্যতা ও বিবেকের আদান-প্রদানের প্রকাশ ।

‘সংলাপ’ মানে একজন অন্যজনের সাথে অন্তর হতে কথা বলা ও তার কথা শোনা। এর অর্থ পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া, পারস্পরিক আদান-প্রদান, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, অভিজ্ঞতার পারস্পরিক সহভাগিতা।

আন্তঃধর্মীয় সংলাপ পরিচিতি

সাধারণত বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যকার সংলাপই আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনপূর্বক পারস্পরিক যে ধর্মীয় যে আলোচনা করা হয়; তাই আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। এ প্রসঙ্গে খালিদ মুহাম্মদ আল-মুগামিসি বলেন:

‘মালিক সত্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে দু’ বা ততোধিক ব্যক্তির মাঝে পারস্পরিক এমন আলাপ-আলোচনা যা প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থায় পরিচালিত এবং ঝগড়া বিবাদ ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ প্রীতিমুক্ত এবং তাৎক্ষণিক ফলাফল লাভের আকাঙ্ক্ষা বিমুক্ত ।

ড. মুহাম্মদ আলী জা‘লুক আরও বলেন, ‘সংলাপ’ হল বিরোধপূর্ণ কোনো বিষয়ে পরিপূর্ণ অথবা কাছাকাছি সমাধানে পৌঁছার লক্ষ্যে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মাঝে কথোপকথন।

আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি
সাম্প্রতিককালে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের ন্যায় আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি (Inter Religion Harmony)পরিভাষাটিও অত্যন্ত সুপরিচিত। আন্তঃসংলাপের পথপরিক্রমায় চূড়ান্তভাবে অর্জিত হয় আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি। বিশ্বায়নের এ যুগে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম যারাই নিজের ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্মকে আন্তরিকভাবে অধ্যয়ন করেছেন তাদের প্রায় সবাই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য কাজ করেছেন এবং করছেন। সারা পৃথিবীতে আজ অনেক খ্যাতনামা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ববিদ তাদের লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, ভণ্ডামি ইত্যাদি দূর করার চেষ্টায় নিয়োজিত। এদের মধ্যে বাংলাদেশের ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মাচারী, স্বামী অক্ষরানন্দ, সিস্টার ইউজিনিয়া, অধ্যক্ষ দেওয়ান মুহম্মদ আজরফ প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের দুইজন অধ্যাপক আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে ছিলেন পথিকৃৎ। এরা হলেন ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ও সাইয়েদ আব্দুল হাই। ভারতের ড. রাইমু- পানিকর, ড. এমন. এসা. এসা. রমন, ইংল্যান্ডের ড. কিনেথ ক্রাগ, ড. ফ্রান্সিস কার্ক, জাপানের নামামোরা হাজিমি, জার্মানি ড. সি. ডবিস্নউ, ট্রল, ইতালির ড. ফ্রান্সিস জান্নিনি, আমেরিকার ড. মোঃ আইয়ুব, ড. হুস্টান স্মিথ এবং ড. ক্যান্টওয়েল স্মিথের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের প্রত্যেকই মনে করেন যে, আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মাধ্যমেই ধর্মীয় সম্প্রীতির পথ অনেকটা সুগম হয়।

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্দেশ্য
আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্দেশ্য হলো পরস্পরকে জানা। এর উদ্দেশ্য অন্য ধর্মকে জয় করা নয়। অন্য ধর্মের সাথে সম্পূর্ণ একমত হয়ে বিশ্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠাও এর উদ্দেশ্য নয়। এর উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে অজ্ঞতাজনিত যে বিরোধ আছে তার মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিকে অনুধাবন করা। যার ফলে প্রত্যেকেই তার নিজেদের ভাষায় নিজস্ব বক্তব্যকে ব্যক্ত করতে পারবে । আধুনিক ধর্মতত্ত্ববিদ ড. কাজী নুরুল ইসলাম স্বীয় গবেষণা প্রবন্ধে তুলনামূলক ধর্ম ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্দেশ্য এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘‘তুলনামূলক ধর্ম ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্দেশ্য হচ্ছে একাত্মতা নয় বরং ঐক্য ও উপলব্ধি, কর্তৃত্ব বা প্রভুত্ব নয় বরং উন্নয়ন। সংলাপের মূল লক্ষ্য হলো প্রতিটি ব্যক্তি-হৃদয়ে অন্য সকলের জন্য কিছু জায়গা সৃষ্টি করা, সহানুভূতির উন্মেষ ঘটানো।

অতএব, বলা যায় যে, বিভিন্ন ধর্মানুসারীর মধ্যে সংলাপের উদ্দেশ্য কোনো ধর্মকে জয় করা নয়, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা নয়, বা সামগ্রিক চুক্তি সম্পাদন বা সর্বজনীন ধর্মপ্রতিষ্ঠাও নয়; বরং বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যকার পারস্পরিক অজ্ঞানতা ও ভ্রান্ত ধারণার ফলে সৃষ্ট বিশাল শূন্যতার ক্ষেত্রে একটা সেতু নির্মাণ করে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করার ব্যবস্থা করা। বস্তুত, আন্তঃধর্মীয় সংলাপের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, প্রত্যেককে তার নিজের কথা বলতে দেওয়া এবং নিজস্ব উক্তির মাধ্যমে স্ব স্ব অন্তর্দৃষ্টি বা মর্মকথা প্রকাশ করতে দেওয়া।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিশ্বায়নের ফলে ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। পৃথিবীর এক প্রান্তে কি ঘটছে এক নিমিষে শুধু খবরই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পৌঁছে না, তার দ্বারা প্রভাবিতও হয়। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বিভিন্ন বর্ণ, গোত্র ও ধর্মের লোক আজ একত্রে বাস করতে বাধ্য। পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহাবস্থান নিশ্চিত সহ বিভিন্ন কারণে আজ বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে আলোচনা এবং এ বিষয়ে গবেষণা অত্যন্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এসব কারণের মধ্যে রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ধর্মতাত্ত্বিক কারণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রকৃত কোনো অবদান রাখতে চাইলে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক সংলাপ এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরী। বিভিন্ন ধর্মের পর্যালোচনা, উন্নয়ন, পরিশোধন ও সঠিক ব্যাখ্যার জন্য আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বা বিনিময় অত্যাবশ্যকীয়। আমরা কে এবং কী তা জানার জন্য আমাদেরকে অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। অন্য ধর্মকে জানার একটা আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে আমাদের নিজেদেরকে জানা এবং আমাদের নিজেদেরকে জানার একটি আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানা। ভাষা সম্পর্কে যেমন বলা হয়, যে শুধু একটি ভাষা জানে সে দাবি করতে পারে না যে ঐ ভাষা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান আছে। ঠিক তেমনিভাবে বলা যায়, যে শুধু একটি মাত্র ধর্মকে জানে সে কোনো ধর্মই সঠিকভাবে জানে না। তাই ‘যোয়াকিম ওয়াচ’ বলেন, ধর্ম সম্পর্কে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এরূপ, যখন সবগুলি ধর্মকে অন্তত কিছুটা জানতে সক্ষম হবে একমাত্র তখনই আমরা কোনো একটি ধর্মকে যথার্থভাবে জানি বলে দাবি করতে পারবো।

আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি চাই তাহলে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, আমরা একটি বৃহৎ সত্তায় অন্তর্ভুক্ত একটি বিশাল পরিবারের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছি এবং আমরা সকলেই ভালোবাসা ও সত্যের আত্মিক বাস্তবায়নের দিকে ধাবমান। আন্তঃধর্মীয় সংলাপে বিশ্বাসী কেউ কেউ বলেন, জগদ্বাসীকে নতুন করে আবার আহ্বান জানাতে হবে: ‘‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয় পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।’’

ইসলামের দৃষ্টিতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ
ইসলাম আন্তঃধর্মীয় সংলাপের সমর্থক। সমগ্র মানবজাতির কাছে ইসলামকে বিশ্বজনীনরূপে প্রচার, প্রসার করতে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম মূলত সকল ধর্মের সহাবস্থানের স্বীকৃতি প্রদান এবং মানুষের প্রতি সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণের উৎসাহ প্রদান করে।

মানবজীবনের পরম কল্যাণ ও শান্তি নিশ্চিতকারী জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম সুপরিচিত। আল-কুরআনে যা ‘আদ-দ্বীন’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকলের মাঝে শান্তি স্থাপনে এর মূল লক্ষ্য। পরমত সহিষ্ণুতা ইসলামের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য; যা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুপম জীবনীতে লক্ষ্য করি। প্রায়শই তাঁর কাছে আলোচনার জন্য নাসারা ও ইয়াহুদিরা আসত। তিনি তাদের সাথে আলোচনা করতেন। তবে যে বর্ণনাটি খুব ঘটা করে বর্ণনা করা হয় যে, নাজরান থেকে আগত খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদলকে তার নিজ মসজিদের অভ্যন্তরে তাদের সান্ধ্য-আরাধনা সম্পাদন করতে অনুমতি প্রদান করেছিলেন। এ বর্ণনাটি শুদ্ধ নয়। কারণ ইসলাম কখনও তার কর্মকাণ্ড ও নিজস্ব গণ্ডিতে অন্য কোনো ধর্মের হস্তক্ষেপ মেনে নেয় না। মসজিদ ইসলামের নিজস্ব এলাকা, এখানে অন্যের হস্তক্ষেপ কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিজের দ্বীনের কোনো অংশ তর্কের খাতিরে ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতাও কোনো মুসলিম করতে পারে না। যারা এটা করবে তারা মূলত ইসলাম বিদ্বেষী, মুনাফিক ও যিন্দিক। এর বিপরীতে ইসলাম নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে আলোচনায় বিশ্বাসী, যদি তা ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়।

ইসলাম বিশ্বাস করে, মানুষ মানুষে ও জাতিতে জাতিতে বিভেদ থাকতে পারে; কিন্তু তারা সবাই একই স্রষ্টার সৃষ্টি। তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ভাষাগত পার্থক্য, ভৌগলিক অসংলগ্নতা ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কোনো অন্তরায় নয়। মানবজাতির বিশ্বজনীন ঐক্য বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে পারস্পরিক সদাচার, ন্যায়বিচার, সার্বজনীন মানবীয় মূল্যবোধ নিশ্চিত করে ইসলাম।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ: আন্তঃধর্মীয় সংলাপের শরয়ী বিধান আল-কুরআন মহান আল্লাহর বাণী। বিশ্বের সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিশুদ্ধতম গ্রন্থ। সংলাপের শর‘ঈ মর্যাদা বা ভিত্তি, বিষয়বস্তু, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কৌশল ও পদ্ধতিসমূহ, মূলনীতি, কাদের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে ইত্যাদি বিষয়ে আল-কুরআন দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে। আল-কুরআন মুসলিমদেরকে এভাবে উৎসাহ প্রদান করে মহান আল্লাহ বলেন, “ঈসা সম্বন্ধে তোমার সাথে যে তর্ক করে তাকে বল, এস আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে ও তোমাদের নারীগণকে আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের তারপর অন্তর দিয়ে প্রার্থনা করি, বিনীত আবেদন করি এবং রাখি মিথ্যাবাদীদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ।

আল-কুরআনের অনুপম প্রেরণায় উজ্জীবিত ইসলামে বিশ্বাসীগণ ভিন্ন বিশ্বাসীদের ধর্মীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ উৎসাহিত করেছে। মুসলিমরা সাধারণত কখনো কারোর ধর্মকে দমন করে রাখে নি বা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি, সম্মান দেখিয়েছে। ইসলামী সাম্রাজ্যে সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ ছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় পণ্ডিতদের উপস্থিতিতে আন্তঃধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলিম খলিফা হারুন অর রশীদ ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন ধর্মের স্কলার নিয়ে আলোচনা করতেন ধর্মনীতি। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপন এবং সংলাপীয় পদ্ধতিতে কুরআনের অবতরণ কুরআনুল কারিমের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।

সংলাপের ভিত্তি বা শরয়ী মর্যাদা
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে ইসলামকে গোটা মানবজাতির কাছে সার্বজনীনরূপে বিশ্বব্যাপী প্রচার, প্রসার করতে ইসলামে যে সকল আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে সংলাপ বা ‘হিওয়ার’ তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইসলাম সংলাপকে শুধু সমর্থনই করে না বরং সংলাপের ভিত্তি, বিষয়বস্তু, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কৌশল ও পদ্ধতিসমূহ, মূলনীতি, কাদের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে ইত্যাদি বিষয়ে নান্দনিক যে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংলাপ এর শর‘ঈ মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:আপনি আপনার রবের পথে আহ্বান করুন জ্ঞানগর্ভ কথা ও উত্তম উপদেশসমূহের দ্বারা এবং তাদের সহিত উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন। আপনার রব, তার পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়, সে সম্বন্ধে বিশেষ অবহিত এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি সবিশেষ অবগত।”

আয়াতে কারিমায় বর্ণিত আদেশসূচক ক্রিয়াপদ “জা-দিলহুম” পদবাচ্যটির উৎপত্তি হয়েছে ‘জাদলুন’ ধাতুমূল থেকে। এর অর্থ ঝগড়া করা, বিবাদ করা, বিতর্ক করা। অর্থাৎ আপনি তাদের সাথে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পদ্ধতিতে। আদেশসূচক এ ক্রিয়াপদকে কেউ কেউ সাধারণ পর্যায়ের নির্দেশ মনে করলেও এর উপর গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, সংলাপ শুধু জায়েজই নয় বরং ফরয এবং সংলাপের ব্যাপারে আমরা আদিষ্ট। উল্লেখিত আয়াতে কারিমায় একই সাথে দুটি আদেশসূচক বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে কুরআন মাজিদের অভিনব বাচনভঙ্গি ও অলংকারিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। আরবিতে আদেশ বুঝানোর জন্য ফি‘লুল আমর বা আদেশসূচক ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। উক্ত আয়াতে কারিমাতেও অনুরূপ আদেশ বুঝানোর জন্য যথাক্রমে এবং জাদিলহুম শীর্ষক দুটি আদেশসূচক ক্রিয়া উল্লেখ হয়েছে; যা ফরয হওয়া বা আবশ্যক হওয়াকে বুঝায়।

মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ড. ইউসুফ আল-কারযাভী পবিত্র মক্কা নগরীতে রাবেতা আলম আল ইসলামীর উদ্দেশ্যে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন: “সংলাপের ব্যাপারে আমরা আদিষ্ট। কেউ কেউ বলেন, সংলাপ জায়েজ। আমি আরেকটু বাড়িয়ে বলবো সংলাপ ফরয। আমরা সংলাপের ব্যাপারে নির্দেশিত। কেননা এটা দাওয়াতেরই একটি অংশ। সূরা আন-নাহলে যে আয়াতে দাওয়াতের নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে আপনি আপনার রবের পথে আহ্বান করুন জ্ঞানগর্ভ কথা ও উত্তম উপদেশসমূহের দ্বারা এবং তাদের সহিত উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে উত্তম উপদেশ ও জ্ঞানগর্ভ কথা এটি মুসলিমদের জন্য যারা দ্বীনকে সমর্থন করে; আর উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্কটি হল দীনের বিরোধীদের জন্য। ইসলামের সমর্থকদের জন্য উত্তম উপদেশ যথেষ্ট। কিন্তু ইসলামকে যারা সমর্থন করে না তাদের ব্যাপারে উত্তম উপদেশ যথেষ্ট নয় বরং তাদের সাথে বিতর্ক করতে হবে উত্তম পন্থায়। বিতর্কের সঠিক ব্যাপার হল উত্তম পন্থায়। অর্থাৎ নম্র পন্থায় ভদ্রোচিতভাবে, এমন ভাষায় যা অন্তরে দাগ কাটে ।

আন্তঃধর্মীয় সংলাপে আল-কুরআনের পদ্ধতি
মার্জিত ‘সম্বোধন’ সংলাপের প্রাণ। একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিষয়ের গুরুত্ব বুঝানো ও শ্রোতামণ্ডলীর মনোযোগ আকর্ষণই এর অন্যতম লক্ষ্য। আল-কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সংলাপগুলোতে যে সকল ‘সম্বোধন’ বিদ্যমান সেগুলোতে মানবজাতির জন্য রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা। এক্ষেত্রে কোনরূপ পার্থক্য ছাড়াই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষকে মহান আল্লাহ বিভিন্নভাবে সম্বোধন করেছেন, আন্তঃধর্মীয় সংলাপে সম্বোধনের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ কখনো ইয়া আয়্যুহান-নাছ বা হে মানবজাতি! কখনো ইয়া আয়্যুহান নাছ,এর পরিবর্তে ‘‘ইয়া আয়্যুহাল ইনসান’’ কখনো বা ইয়া আহলাল কিতাব বা হে কিতাবধারী! বলে সম্বোধন করেছেন। কুরআন মাজিদে ‘ইয়া আয়্যুহান-নাছ বা হে মানবজাতি! শীর্ষক পদবাচ্যটি ৯টি সূরার ১৯টি স্থানে ইয়া আয়্যুহাল ইনসান’’ শীর্ষক পদবাচ্যটি ২টি সূরায় ২টি স্থানে ও ইয়া আহলাল কিতাব বা হে কিতাবধারী! শীর্ষক পদবাচ্যটি ৩টি সূরার ১২টি স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া সম্বোধন ব্যতিরেকে শুধু ‘আন-নাছ’ (মানবজাতি) এ শব্দটি ৫৪ সূরায় ২৪০ স্থানে উল্লেখ রয়েছে!

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের ধারাবাহিকতায় আল-কুরআনে বর্ণিত মহান আল্লাহর অনুপম ও হৃদয়স্পর্শী সম্বোধন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। অবিশ্বাসীদের প্রতি আল-কুরআনের মর্যাদাপূর্ণ ও মার্জিত সম্বোধন মানব হৃদয়কে স্পর্শ করে। কুরআনে কারিমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কারো প্রতি অসম্মানজনক আচরণমূলক কোনো শব্দও খুঁজে পাওয়া যায় না।

সংলাপের উপাদানসমূহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার সাথে বক্তব্য উপস্থাপন। মহান আল্লাহ বলে, “কৌশল ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা তুমি তোমার রবের পথে আহ্বান কর এবং তাদের সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক কর।”

সূরা আন-নাহল-এর উল্লেখিত আয়াতে কারিমায় দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালাসহ মুসলিম এবং অমুসলিমদের মাঝে অনুষ্ঠিতব্য সংলাপের নীতিমালা ব্যক্ত হয়েছে; যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ তাদের সাথে দাওয়াতের পদ্ধতি হচ্ছে, নম্র পন্থায়, ভদ্রোচিতভাবে, এমন ভাষায় যা অন্তরে দাগ কাটে যেমন কুরআন আমাদের শিখিয়েছে।

অযাচিত তর্ক-বিতর্ক মানুষের সম্পর্ক বিনষ্ট করে এবং হৃদয়ের গভীর থেকে ভালবাসার সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য ধ্বংস করে। তাই সব সময়েই এ ধরণের তর্ক-বিতর্ক পরিত্যাজ্য। আন্তঃধর্মীয় সংলাপকে ফলপ্রসূ করতে হলে অযাচিত তর্ক-বিতর্ক বর্জন আবশ্যক। সংলাপে অংশগ্রহণকারী চাই সে ইয়াহুদি বা খ্রিষ্টান হোক বা ভিন্ন বিশ্বাসের হোক সকলের সাথে অযাচিত তর্ক বিতর্ক পরিহার করতে নির্দেশ প্রদান করে ইসলাম। সূরা আনকাবুতে এ প্রসঙ্গটি এভাবে এসেছে,‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবিদের সাথে বিতর্ক করবে না, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে সীমালংঘনকারী এবং বল, ‘আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তাকে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ একই এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’’

আয়াতে কারিমায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপের এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা ব্যক্ত করা হয়েছে। আহলে কিতাব বা ইয়াহুদি খ্রিষ্টানদের সাথে অকারণে জাদল (তর্ক-বিতর্ক) করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম রাযী স্বীয় তাফসীর আল-কাবীর-এ উল্লেখ করেন: আল-জিদাল বা বিতর্ক দু’প্রকার: ‘হক’ বা সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তর্ক বিতর্ক এবং বাতিল মিথ্যা প্রতিষ্ঠার জন্যে তর্ক-বিতর্ক। সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে জিদাল করা হয় তা মূলত: নবী রাসূলদের পেশা। আর মিথ্যা প্রতিষ্ঠায় যে তর্ক-বিতর্ক তা নিন্দনীয়।’ তাই জিদাল বা তর্ক করতে হলে অত্যন্ত সুন্দর পদ্ধতিতে হক প্রতিষ্ঠার জন্য করতে হবে, শুধুমাত্র তর্কের জন্য তর্ক যেন না করা হয়।

বিনয়-নম্রতা সংলাপের এক অন্যতম উপাদান। সংলাপকে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করে তুলতে বিনয়-নম্রতা ও কোমলতার অনুসরণ অপরিহার্য। বিশেষ করে আন্তঃধর্মীয় সংলাপে এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বর্ণিত মূসা আলাইহিস সালাম ও হারুন আলাইহিস সালাম এবং ফিরাউনের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য সংলাপ কিভাবে পরিচালিত হবে তার নির্দেশনা ব্যক্ত হয়েছে সূরা ত্বহায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তুমি ও তোমার ভ্রাতা আমার নিদের্শনাসহ যাত্রা কর এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করিও না। তোমরা উভয়ে ফির‘আউনের নিকট যাও, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’’

যে সকল বিষয় ঐক্যমত্য রয়েছে সেগুলি থেকেই সংলাপের শুভ সূচনা
আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হল, সংলাপে অংশগ্রহণকারী পক্ষদ্বয়ের কাছে যে সকল বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে সেগুলো থেকেই সংলাপের সূচনা হওয়া। সূরা আশ-শু‘আরা-এর ﴿“এবং আপনি আপনার নিকট আত্মীয়-স্বজনদেরকে ভীতি প্রদর্শন করুন।” শীর্ষক আয়াতে কারিমা অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতের প্রেক্ষিতে কুরায়শদের সাথে সাফা পর্বতের পাদদেশে তাদেরকে আহ্বান পূর্বক একটি গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ করেন; যা মূলত: দিকনির্দেশনা পূর্ণ একটি আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। এ প্রসঙ্গটি ইমাম বোখারি ইবন আব্বাস রা-এর উদ্ধৃতি এভাবে উল্লেখ করেন, তিনি বলেন: শীর্ষক আয়াতে কারিমা নাযিল হল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পর্বতে আরোহণ করে কুরায়শদের দুই গোত্রকে এভাবে আহ্বান করতে থাকেন, ওহে বনী ফিহর। ওহে বনী আদী! অর্থাৎ ওহে ফিহরের বংশধর! ওহে ‘আদীর বংশধরেরা! এরপর উভয় গোত্রের লোকজন আহ্বানে সাড়া দিয়ে একত্রিত হল। যারা উপস্থিত হতে পারল না তারা স্বীয় প্রতিনিধি প্রেরণ করল যাতে তারাও আহুত বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে। গোত্রপতি আবু লাহাবও সেখানে উপস্থিত হন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি আমি তোমাদেরকে এ সংবাদ দেই যে, পাহাড়ের পাদদেশে এমন এক অশ্বারোহী বাহিনী অবস্থান করছে যারা তোমাদেরকে নিশ্চিত আক্রমণ করবে, তোমরা কি আমার এ সংবাদটি বিশ্বাস করবে? তারা বলল; হ্যাঁ, আমরা সকলেই বিশ্বাস করব। কেননা তোমার ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা এ যে, তুমি সত্যবাদী। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আখিরাতের কঠিন শাস্তির ব্যাপারে আমি তোমাদের জন্য একজন ভীতি প্রদর্শনকারী।’ আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যায় বর্ণিত হাদিসে বনী ‘আদী ও বনী ফিহর ও কুরায়শদের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সংলাপ বর্ণিত হয়েছে তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ বিষয়ের উল্লেখের মাধ্যমে সংলাপ আরম্ভ করেছেন যে বিষয়ে সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের উভয় পক্ষ ঐকমত্য ছিলেন। সে বিষয়টি ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যবাদিতা।

মার্জনা, উদারতা ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন
পরমত সহিষ্ণুতা সংলাপের অনন্য ভূষণ। পারস্পরিক ক্ষমা, মার্জনা, উদারতা ইত্যাদি গুণাবলীর মাধ্যমেই পরমত সহিষ্ণুতা অর্জিত হয়। উল্লিখিত গুণাবলি অর্জনে মহান আল্লাহ এভাবে নির্দেশ করেছে : তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎকার্যের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদিগকে এড়িয়ে চল।

পারস্পরিক ক্ষমা, মার্জনা, উদারতা ও পরমত সহিষ্ণুতা অর্জনে ইসলামের নির্দেশনা সুস্পষ্ট। ইসলামের প্রাথমিক যুগে একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাসজিদুল হারামে অবস্থান করছিলেন। এ সময় কতিপয় মুশরিক দলবদ্ধভাবে ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সমবেত হন এবং তারা নানাভাবে তর্কবিতর্ক করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জ্ঞানগর্ভ, ধৈর্যপূর্ণ ও মনোজ্ঞ আলোচনায় মু হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন।

পরমত অনুসারীর প্রতি গালমন্দ বা কটাক্ষ বর্জন
কটাক্ষ বা গালমন্দ মানবমর্যাদা পরিপন্থী। আত্মসম্মানে আঘাত হানে এবং হৃদয়ে গভীর জখম সৃষ্টি করে। সংলাপের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনে গালমন্দ ও কটাক্ষ পরিত্যাজ্য। মহান আল্লাহ বলেন: আল্লাহকে ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞনতাবশত আল্লাহকেও গালি দিবে।

ইসলাম অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি খারাপ ব্যবহার পরিহারের নির্দেশ প্রদান করে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের শিরক, কুফর, দুর্নীতি ইত্যাদি কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করা হলেও তাদেরকে গালি-গালাজ, কটূক্তি বা দুর্ব্যবহার সর্বোতভাবে বর্জনের চেষ্টা করা হয়েছে।

বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রামাণ্য যুক্তি উপস্থাপন
সংলাপের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনে প্রয়োজন প্রামাণ্য, নির্ভরযোগ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও প্রমাণাদি উপস্থাপন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী: ‘বল, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুর ইবাদাত কর যারা তোমাদের কোনো ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা নেই? আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’’

অতএব, যে ধর্মের সাথে সংলাপ হবে তাকে অবশ্যই সে ধর্ম সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান রাখতে হবে। শুধুমাত্র ধর্মীয় জ্ঞান সেখানে যথেষ্ট মনে করার কোনো উপায় নেই।

নিজ বিশ্বাসসহ ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি জ্ঞানের গভীরতা সংলাপের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনের জন্য অত্যাবশ্যক। আল-কুরআন প্রসঙ্গটি এভাবে ব্যক্ত করেন, “মানুষের মধ্য কেউ কেউ আল্লাহ সম্বন্ধে বিত-া করে; তাদের না আছে জ্ঞান, না আছে পথ নির্দেশ, না আছে কোনো দীপ্তিমান কিতাব।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ: পবিত্র কুরআনে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ কুরআনে কারিম এমন এক গ্রন্থ যাতে পূর্ববর্তীদের কাহিনী ও পরবর্তীদের কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। এখানে একদিকে রয়েছে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের উত্থান-পতনের ইতিহাস অপরদিকে রয়েছে দীন ও আকিদার বর্ণনা। কুরআন একদিকে বর্ণনা করছে তাদের আচার-আচরণ লেন-দেন অপরদিকে তাদের সমসাময়িক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কাহিনীও বিধৃত হয়েছে।

এছাড়াও পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরোধ রয়েছে তারও উল্লেখ রয়েছে। এর বিভিন্ন স্থানে ইয়াহুদি, খ্রিষ্টান, সাবায়ী, মুশরিক, প্রকৃতিবাদী প্রভৃতি মতাদর্শ ও তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা দেখতে পাই। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, বল, হে কিতাবিগণ! এস সে কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা একমাত্র আল্লাহ্‌ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি এবং তার সাথে কাউকে শরীক না করি। আর আমাদের কেউ যেন আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ না করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল, তোমরা সাক্ষী থাক, অবশ্যই আমরা মুসলিম।’’

এ আয়াতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি বর্ণিত হয়েছে। তাহলো, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ঐক্যসূত্রের সন্ধান। আলোচ্য আয়াতে কিতাবিদেরকে বলা হয়েছে যে, যদি তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান এনে থাক তবে তোমাদের এবং মুসলিমদের মধ্যে এই ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু থেকেই সংলাপ ও আলোচনার সূত্রপাত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ: সুন্নাতে নববীতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদি, খ্রিষ্টান ও মুশরিকদের সাথে যেসব মুজাদালাহ বা সর্বোত্তম পন্থায় যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেগুলোর কিছু দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরা হলো: ইয়াহুদিদের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিতর্ক: মদিনায় বিভিন্ন সময়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদিদের সাথে ধর্মীয় বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। কারণ তারা তাঁর আশে-পাশেই থাকত। তারাও তাঁর সাথে ধর্মীয় বিষয়ে অনেক মতবিনিময় করত এবং বিভিন্ন ভ্রান্ত প্রশ্ন ও সন্দেহের অবতারণা করত। আর তিনি রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোর অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ জওয়াব দিতেন।

যার কিছু নমুনা নিম্নে উপস্থাপিত হলো: আব্দুল্লাহ ইবন্ সালাম এর সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথোপকথনের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে,আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন সালাম শুনলেন যে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করেছেন। তিনি তাঁর কাছে এসে বললেন, আমি আপনাকে তিনটি প্রশ্ন করব যা নবী ব্যতীত কেউ উত্তর দিতে পারে না। তারপর তিনি বললেন, কিয়ামতের প্রথম আলামত কি? জান্নাতিরা প্রথম কোনো খাবার খাবে? সন্তান কিভাবে পিতার মত এবং কিভাবে তার মাতুলদের মত হয়?তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,আমাকে এই মাত্র জিবরাঈল তা জানিয়েছে। তখন আব্দুল্লাহ বললেন, ইয়াহুদিদের নিকট এ ফেরেশতা তাদের শত্রু। তারপর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের প্রথম আলামত হচ্ছে, একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাবে। আর জান্নাতিদের প্রথম খাবার হবে মাছের কলিজা। আর সন্তান কারো সাদৃশ্য হওয়ার পিছনে যুক্তি হলো, যদি কেউ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন যদি পুরুষের বীর্য অগ্রণী হয় সন্তান পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে যদি স্ত্রীর বীর্য অগ্রণী হয় তখন সন্তান স্ত্রীর মত হয়। তখন তিনি বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আপনি আল্লাহর রাসূল। তারপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইয়াহুদিরা মিথ্যুক জাতি, যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করার আগে আমার ইসলামের কথা তারা জেনে যায় তবে আমাকে মিথ্যুক বানিয়ে ছাড়বে। তারপর আব্দুল্লাহ ইয়াহুদিদের কাছে আসলেন এবং তাদের ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদিদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম কেমন লোক? তারা বলল: আমাদের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি এবং জ্ঞানী ব্যক্তির সন্তান। আমাদের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি এবং উত্তম ব্যক্তির সন্তান। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে? তারা বলল, আল্লাহ তাকে এ ধরনের কাজ করা থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বের হয়ে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত হক কোনো মা‘বুদ নেই, আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তখন তারা বলল,সে আমাদের সবচেয়ে খারাপ লোক এবং খারাপ লোকের সন্তান। এভাবে তারা তার উপর আক্রমণাত্মক কথা বলতে লাগল ।

আব্দুল্লাহ ইবন্ উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘‘ইয়াহুদিরা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে এসে বলল: তাদের মধ্যে একজন পুরুষ ও মহিলা যিনা করেছে। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন: তোমরা কি তাওরাতে রজম সম্পর্কে কিছু পেয়েছ?তারা বলল: ‘‘তাদেরকে অপমানিত করব এবং তাদেরকে বেত্রাঘাত করা হবে।’’ তখন তাদের আব্দুল্লাহ ইবন্ সালাম বলেন: তোমরা মিথ্যা বলেছ, সেখানে রজমের কথা রয়েছে। তখন তারা তাওরাত নিয়ে এসে তা খুলে ধরল। অতঃপর তাদের একজন রজমের আয়াতের উপর হাত রেখে আগের ও পরের বাক্যাবলী পাঠ করল। তখন আব্দুল্লাহ ইবন্ সালাম বললেন: তুমি হাত উঠাও। অতঃপর যখন হাত উঠানো হলো তখনি সেখানে রজমের আয়াত দেখা গেল। তখন তারা বলল: হে মুহাম্মাদ! আপনি সত্য বলেছেন। এতে রজমের আয়াত রয়েছে। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে রজম তথা পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ দিলেন। আর তাদেরকে পাথর মারা হলো।’’

তাছাড়া, ধর্মীয় আলোচনার জন্য রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং ইহুদীদের ‘মিদরাস’ -এর গমন করেছেন। এ আলোচনায় সাধারণত উলুহিয়্যাত-ঈশ্বরতত্ত্ব, ধর্মীয় গ্রন্থ, রাসূলতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরূপ পারস্পরিক আলোচনার ফলে আবদুল্লাহ ইবন সালাম,সা‘লাবা ইবন সাঈদ,আসাদ ইবন উসাইদ-এর মত প্রভাবশালী ইহুদী পণ্ডিত ও নেতৃবৃন্দ ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘একবার রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদিদের একটি শিক্ষায়তনে প্রবেশ করলেন যেখানে একদল ইয়াহুদি অবস্থান করছিল। তিনি তাদেরকে আল্লাহর পথে আহ্বান করলেন। তখন নু’মান ইবন্ আমর এবং হারেস ইবন্ যায়দ বলেন: হে মুহাম্মাদ! তোমার দিন কোনটি? তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমি ইবরাহীমের দীনের উপর। তখন তারা উভয়ে বলল: ইবরাহীম তো ইয়াহুদি ছিল। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাহলে তাওরাত নিয়ে আস, আমাদের ও তোমাদের মাঝে সেটাকে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ কর। কিন্তু তারা উভয়ে তা করতে অস্বীকার করল। তখন আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন: ‘‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে কিতাবের অংশ প্রদান করা হয়েছিল? তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের দিকে আহ্বান করা হয়েছিল যাতে ওটা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়;তারপর তাদের একদল ফিরে দাঁড়ায়,আর তারাই পরাম্মুখ।’’

এ ছাড়াও ইয়াহুদিদের বিভিন্ন প্রতিনিধিদল রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসত, বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করত এবং বিতর্কে লিপ্ত হত ।

খ্রিষ্টানদের সাথে তাদের ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্ক
খ্রিষ্টানদের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদিদের তুলনায় স্বল্প পরিমাণ ধর্মীয় বিতর্ক করেছেন। কারণ তারা মূলত মদিনা থেকে দূরে অবস্থান করত। ফলে মুসলিমদের সাথে তাদের খুব কম সাক্ষাত হতো। তারপরও যখনি কোনো প্রতিনিধিদল রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আগমন করত তখনি তারা ধর্মীয় বিষয়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হত। এক্ষেত্রে হাবশা ও নাজরানের খ্রিষ্টানদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে।

সিরাতে ইবন্ হিশামে এ জাতীয় একটি ধর্মীয় সংলাপ এসেছে। যার বিষয়বস্তু হলো: খ্রিষ্টানগণ রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে ঈসা ইবন্ মারইয়াম সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি করল। তারা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঈসা আলাইহিসালামের পিতা সম্পর্কে প্রশ্ন করল এবং তারা আল্লাহ্‌ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার অপবাদ ও মিথ্যা বলে বেড়াতে লাগল। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘তোমরা জান যে, যত সন্তানই আছে তারা তাদের পিতার সদৃশ হয়? তারা বলল: অবশ্যই। তিনি বললেন: তোমরা কি জান না যে, আমাদের প্রভু চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই? অথচ ঈসার অস্তিত্ব বিলীন হবে? তখন তারা বলল: অবশ্যই। তিনি আরও বললেন: আমাদের রব সবকিছুর ধারক-বাহক,তিনি সবকিছুর সংরক্ষণ করেন ও রিযক দিয়ে থাকেন? তারা বলল: নিশ্চয়ই। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাহলে ঈসা ইবন্ মারঈয়াম কি এগুলোর কোনো কিছু করতে সক্ষম? তখন তারা বলল: না। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা কি জান না যে, আসমান ও জমিনের কোনো সৃষ্টিই তাঁর কাছে গোপন নেই? তারা বলল: নিশ্চয়ই। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আমার প্রভু ঈসাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে রেহেমের মধ্যে আকৃতি দান করেছেন। তিনি আরও বললেন: আর আমার প্রতিপালক খানা-পিনা করেন না এবং কোনো অপবিত্র কাজও ঘটান না?তখন তারা বলল: নিশ্চয়ই। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা কি জান না যে, অন্যান্য মহিলাদের মত ঈসাও মায়ের গর্ভে লালিত-পালিত হয়েছেন? তারপর অন্যান্য মহিলারা যেভাবে বাচ্চা প্রসব করে তিনি তার মাও তাকে সেভাবে প্রসব করেছেন এবং অন্যান্য বাচ্চাদের মত তাকেও খাওয়ানো হয়েছে। তারপর তিনি খাবারও খেয়েছেন, পানও করেছেন এবং অপবিত্রও হয়েছেন? তারা বলল: অবশ্যই। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাহলে তোমরা যা ধারনা করছ তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? এরপর তাদের সবাই চুপ হয়ে গেল। এ পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথম থেকে আশির অধিক আয়াত নাযিল হয়।

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে,হাবশা থেকে একদল খ্রিষ্টান রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করে। তারা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিভিন্ন দীনি প্রশ্ন করে দু’ধর্মের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ইসলাম গ্রহণ করে অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদী ইবন্ হাতিমের সাথে তার দীন খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে যুক্তিতে পরাস্ত করে আল্লাহর দীন মানতে উদ্বুদ্ধ করেন। যার ফলশ্রুতিতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ‘আদী ইবন্ হাতিম বলেন: ‘‘যখন আল্লাহ্‌ তা‘আলা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন,তখন তাঁকে এমন প্রচণ্ড আকারে ঘৃণা করলাম এবং তাঁর থেকে পালিয়ে জমিনের একপ্রান্ত রোমের পার্শ্বস্থ আরবভূমিতে আশ্রয় নিলাম। তারপর আমি আমার প্রথম স্থানের চেয়েও সে স্থানে অবস্থান করাটা অত্যধিক অপছন্দ করলাম। তারপর আমি স্বয়ং বললাম, আমি যদি লোকটির কাছে যেতাম এবং তার কাছ থেকে কিছু শুনতাম তাহলে কেমন হয়। তারপর আমি মদিনায় আসলাম। মানুষের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়ল। তারা বলাবলি করতে লাগল যে,আদী ইবন্ হাতিম আত-ত্বায়ী এসেছে। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হে ‘আদী! তুমি ইসলাম গ্রহণ কর তাহলে নিরাপত্তা পাবে। আমি বললাম আমি একটি দীনের উপর আছি। তিনি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার দীন সম্পর্কে আমি তোমার থেকেও অধিক জ্ঞাত। আমি বললাম: আপনি কি আমার দীন সম্পর্কে আমার থেকেও অধিক জ্ঞাত? তিনি বললেন: হ্যাঁ। ‘আদী ইবন্ হাতেম বলেন: রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি তিনবার উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বললেন: তুমি কি ‘রন্ডকুচী’ নও? (অর্থাৎ এমন সম্প্রদায় যারা খ্রিষ্টান ও সাবেয়ী এ দু’ধরনের ধর্মের মধ্য পন্থার অনুসারী) আমি বললাম, অবশ্যই। তিনি বললেন, তুমি কি তোমার সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দাও না? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন: তুমি কি ‘লুটের সম্পদের চারভাগে এক ভাগ নাও না? আমি বললাম: নিশ্চয়ই। তিনি বললেন: কিন্তু এটা তো তোমার ধর্মমতে অবৈধ। ‘আদী ইবন্ হাতিম বলেন: এতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তারপর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: সম্ভবত এটাই সম্ভবত তোমাকে আমাদের দীন থেকে দূরে রেখেছে, কারণ তুমি দেখতে পাচ্ছ যে, আমাদের এখানে অভাব-অনটন রয়েছে।’’

ইবনে কাইয়্যেম রাহেমাহুল্লাহ এ সমস্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিসের ভাষ্য এবং সিরাতের বিভিন্ন ঘটনা যেমন নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মীয় বিতর্ক এগুলোর শিক্ষা বর্ণনায় বলেন: এ ঘটনা থেকে যে শিক্ষা আমরা পাই তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: আহলে কিতাবদের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্ক করা জায়েজ বরং মুস্তাহাব। আবার ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিবও যখন এটা স্পষ্ট হবে যে,এ আলোচনায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে তাদের অনেকেই ইসলামের সুমহান আদর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। আর বুদ্ধিভিত্তিক ও জ্ঞান ভিত্তিক যুক্তি উপস্থাপন করে তাদের বিভিন্ন সন্দেহ ও প্রশ্নের অপনোদন করা প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।

তাছাড়া, মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের পর আরব-খ্রিষ্টানদের প্রধান কেন্দ্র-নাজরান থেকে একদল প্রতিনিধি মদিনায় আসেন। খ্রিষ্টানদের এক নেতার নেতৃত্বে চৌদ্দ জন পাদ্রীসহ ষাটজন প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করেন। তারা ইসলাম ও খ্রিস্টানধর্ম সম্পর্কে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাদের ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর সূরা আলে-ইমরান অবতীর্ণ হয়।

অনুরূপভাবে ইরানের অধিবাসী প্রখ্যাত সাহাবী সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও সত্যদীন অনুসন্ধানের জন্য বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে মদিনায় আসেন। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন মাজদাক ধর্মের অনুসারী। এ ধর্মমত তাঁকে পরিতৃপ্ত করে পারেনি। তাই তিনি খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু এতেও তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত সত্য লাভে অসমর্থ হন। পরিশেষে মদিনায় রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আগমন করেন এবং বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ইসলামের সত্যতায় স্থিরচিত্ত হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।

মুশরিকদের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মীয় বিতর্ক
বিভিন্ন বর্ণনায় প্রায়শই দেখা যায় যে, কতিপয় মুশরিক দলবদ্ধভাবে ধর্ম সম্পর্কে বিতর্ক-জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাঁর পাশে সমবেত হয়। মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে আলোচনায় তাঁরা সন্তুষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।

তুফাইল ইবন আমর আদ্-দাওসী ছিলেন ঘোর পৌত্তলিক। কেবল ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ নিয়ে তিনি মক্কায় রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে তিনি রাসূল রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সত্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করে কৃতার্থ হন। এভাবে অনেক পৌত্তলিক দলগত ও ব্যক্তিগতভাবে রাসূলের সাথে ধর্মালোচনায় মিলিত হন।

ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হে কুরাইশ সম্প্রদায়! নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদতে কোনো কল্যাণ নেই। কিন্তু কুরাইশগণ জানত যে, খ্রিষ্টানগণ ঈসা আলাইহিসালামের ইবাদত করত। সুতরাং মুহাম্মাদ সম্পর্কে তুমি কি বলবে? তখন তারা মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে উদ্দেশ্য করে বলল: হে মুহাম্মাদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! তুমি কি বিশ্বাস করনা যে, ঈসা নবী ছিলেন এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের মধ্যে একজন ছিলেন? যদি তুমি তোমার কথায় সত্য হও তাহলে তাদের ইলাহও তো তোমাদের বক্তব্যমত হওয়া উচিত। তখন কুরআনে ইরশাদ হলো, যখন মারইয়াম-তনয়ের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়, তখন আপনার সম্প্রদায় তাতে শোরগোল আরম্ভ করে দেয়, এবং বলে, ‘আমাদের উপাস্যগুলো শ্রেষ্ঠ না ‘ঈসা?’ এরা শুধু বাক-বিতণ্ডার উদ্দেশ্যেই আপনাকে এ কথা বলে। বস্তুত এরা তো এক বিতণ্ডাকারী সম্প্রদায়। তিনি তো ছিলেন আমারই এক বান্দা, যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং করেছিলাম বনী ইসরাইলের জন্য দৃষ্টান্ত।’’

অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমরান ইবন্ হুসাইনের পিতা হুসাইনকে বলেন: হে হুসাইন! তুমি আজ কয়জনের ইবাদত কর? হুসাইন উত্তর করলেন: সাতজনের, ছয়জন জমিনে আর একজন আসমানে। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার আবেগ ও ভীতির জন্য কাকে গণ্য করো? উত্তরে হুসাইন বলেন: যিনি আসমানে আছেন। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হে হুসাইন! তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো তবে আমি তোমাকে এমন দু’টি কালেমা শিক্ষা দেব যা তোমার উপকারে আসবে। তারপর যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে যে দু’টি কালেমা শেখানোর ওয়াদা করেছেন সে দু’টি শিক্ষা দিন। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: বল,হে আল্লাহ ! আমাকে সঠিক পথের দিশা মনে ঢেলে দিন এবং আমাকে আমার অন্তরের অকল্যাণ থেকে বাঁচান।

এখানেও আমরা দেখতে পাই যে, মুশরিকদের দীনের ব্যাপারে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্যক অবগত হয়ে তাদের সাথে দীনি বিতর্ক করে তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন।

অনুরূপভাবে ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন ‘‘তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদাত কর সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে।’’ [সূরা আল-আম্বিয়া: ৯৮] এ আয়াত নাযিল হলো, তখন মুশরিকরা বলতে লাগল, ফেরেশতা, উযাইর এবং ঈসা এরও তো ইবাদত করা হয়, তারাও কি জাহান্নামে যাবে? তখন আল্লাহ্‌ নাযিল করলেন, ‘‘যাদের জন্য আমার কাছ থেকে পূর্ব থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হবে।’’ [সূরা আল-আম্বিয়া: ১০১]

অন্য বর্ণনায় এসেছে,কাফের মুশরিকরা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে ঈসা আলাইহিস্ সালাম নিয়ে বাদানুবাদ শুরু করে দিল। বিশেষ করে ওলীদ ইবনে মুগীরাহ। তখন আল্লাহ্‌ নাযিল করলেন,‘যখন মারইয়াম-তনয়ের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়, তখন আপনার সম্প্রদায় তাতে শোরগোল আরম্ভ করে দেয়, এবং বলে, ‘আমাদের উপাস্যগুলো শ্রেষ্ঠ না ‘ঈসা?’ এরা শুধু বাক-বিত-ার উদ্দেশ্যেই আপনাকে এ কথা বলে। বস্তুত এরা তো এক বি-াকারী সম্প্রদায়। তিনি তো ছিলেন আমারই এক বান্দা, যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং করেছিলাম বনী ইসরাইলের জন্য দৃষ্টান্ত। আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের মধ্য থেকে ফিরিস্তা সৃষ্টি করতে পারতাম, যারা পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী হত।‘ঈসা তো কিয়ামতের নিশ্চিত নিদর্শন; কাজেই তোমরা কিয়ামতে সন্দেহ করো না এবং আমাকে অনুসরণ কর। এটাই সরল পথ।’’ [সূরা আয-যুখরুফ: ৫৭-৬১]

তদ্রূপ মুশরিকদের পুনরুত্থান সংক্রান্ত সংলাপ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ। পবিত্র কুরআনে ও রাসূলের হাদিসে তার বর্ণনা এসেছে, একবার উবাই ইবনে খালাফ রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসল। তার হাতে ছিল একটি পুরাতন হাড়। সে সেটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কি মনে কর যে, আল্লাহ্‌ এটারও পুনরুত্থান ঘটাবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তোমাকেও আল্লাহ্‌ মৃত্যু দিবেন এবং পুনরুত্থান করবেন তারপর তোমাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। তখন আল্লাহ্‌ আগত আয়াতসমূহ নাযিল করেন: ‘‘মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অথচ পরে সে হয়ে পড়ে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী। এবং সে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে, ‘কে অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে যখন তা পচে গলে যাবে?’ বলুন,‘তাতে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই যিনি তা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ তিনি তোমাদের জন্য সবুজ গাছ থেকে আগুন উৎপাদন করেন এবং তোমরা তা থেকে প্রজ্বলিত কর। যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সমর্থ নন? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ।’’ [সূরা ইয়াসিন: ৭৭-৮০]

বিশ্বায়নের এ যুগে বিভিন্ন ধর্মের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ ব্যবসা-বাণিজ্য, সভা-সমাবেশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষ পরস্পরের কাছে আসছে, একত্রিত হচ্ছে ও একসঙ্গে কথাবার্তা বলছে। মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন যেমন সহজতর হয়ে উঠছে, তেমনি বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি ইত্যাদির মাঝে মতপার্থক্য দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও পরমত অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিস্থিতি অবসানপূর্বক পারস্পরিক অনুপম পরিবেশ সৃষ্টির অনন্য মাধ্যম হল সংলাপ; যার মাধ্যমে পরস্পরের ভুল বুঝাবুঝির অবসান হয়ে মনে সংকীর্ণতা দূর করে সম্পর্ক সুদৃঢ় করা যায়। ফলে বিভিন্ন মহলে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের প্রতি ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তঃধর্মীয় সংলাপ (Inter Religion Dialogue) ও আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি (Inter Religion Harmony) সাম্প্রতিক বিশ্বের একটি বহুল আলোচিত বিষয়। পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, নিরাপদ সহাবস্থান, বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপ ও সম্প্রীতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ পরিচিতি, গুরুত্ব, তাৎপর্য এবং এ সম্পর্কে আল-কুরআনের দিক নির্দেশনা তুলে ধরা হয়েছে।
সংলাপ পরিচিতিবিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যে ‘সংলাপ’ পদবাচ্যটির ব্যবহার লক্ষণীয়। বাংলা ভাষায় এটি বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়; যা দুটি শব্দ (সম্+লপ্+অ)- এর সমষ্টি। এর অর্থ: আলাপ, কথোপকথন, নাটকের চরিত্রসমূহের পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা  ইত্যাদি। সংলাপ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ‘সং’ শব্দের অর্থ সম বা সমান। ইংরেজিতে ‘সংলাপ’ এর প্রতিশব্দ ডায়ালগ (Dialogue) ব্যবহৃত হয়। আরবিতে সংলাপ-এর প্রতিশব্দ ‘আল-হিওয়ার’ ব্যবহৃত হয়। ‘হিওয়ার’  শব্দটি ধাতুমূল থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ কোনো কিছু থেকে প্রত্যাবর্তন করা,  কোনো কিছু বৃদ্ধির পর তা আবার কমে আসা  পুনরায় পূর্বের অবস্থায় ফেরত আসা। কুরআন মাজিদে এ অর্থটির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় সূরা ইনশিকাকে। মহান আল্লাহ বলেন: “নিশ্চয় সে মনে করেছে যে, তার কখনই পরিবর্তন নেই।” আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে আল্লামা শাওকানী বলেন: ‘লাঁই-ইয়াহূরা’ এর অর্থ হল: লান-ইয়ারজিআ  “সে কখনই ফিরে যাবে না”।
পারিভাষিক দিক থেকে ‘সংলাপ’ এর বিভিন্ন অর্থ লক্ষ্য করা যায়। সংলাপ হল নিজের সত্যতা, ধর্মীয় মূল বিশ্বাস, ন্যায্যতা, তথা সমুদয় মূল্যবোধ বজায় রেখে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও মহানুভবতা প্রদর্শন করে পারস্পরিক যে আলাপ সহভাগিতা করা হয়, তাই সংলাপ।
‘সংলাপ’ হচ্ছে, অন্যদেরকে বুঝবার বাসনায় তাদেরকে শ্রবণের সামর্থ্যতা ও বিবেকের আদান-প্রদানের প্রকাশ ।
‘সংলাপ’ মানে একজন অন্যজনের সাথে অন্তর হতে কথা বলা ও তার কথা শোনা। এর অর্থ পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া, পারস্পরিক আদান-প্রদান, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, অভিজ্ঞতার পারস্পরিক সহভাগিতা।
আন্তঃধর্মীয় সংলাপ পরিচিতি : সাধারণত বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যকার সংলাপই আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাসীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শনপূর্বক পারস্পরিক যে ধর্মীয় যে আলোচনা করা হয়; তাই আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। এ প্রসঙ্গে খালিদ মুহাম্মদ আল-মুগামিসি বলেন:
‘মালিক সত্যে পৌঁছানোর লক্ষ্যে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে দু’ বা ততোধিক ব্যক্তির মাঝে পারস্পরিক এমন আলাপ-আলোচনা যা প্রজ্ঞাপূর্ণ পন্থায় পরিচালিত এবং ঝগড়া বিবাদ ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ প্রীতিমুক্ত এবং তাৎক্ষণিক ফলাফল লাভের আকাঙ্ক্ষা বিমুক্ত ।
ড. মুহাম্মদ আলী জা‘লুক আরও বলেন, ‘সংলাপ’ হল বিরোধপূর্ণ কোনো বিষয়ে পরিপূর্ণ অথবা কাছাকাছি সমাধানে পৌঁছার লক্ষ্যে দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মাঝে কথোপকথন।
আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতিসাম্প্রতিককালে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের ন্যায় আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি (Inter Religion Harmony)পরিভাষাটিও অত্যন্ত সুপরিচিত। আন্তঃসংলাপের পথপরিক্রমায় চূড়ান্তভাবে অর্জিত হয় আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি। বিশ্বায়নের এ যুগে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ‘হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম যারাই নিজের ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্মকে আন্তরিকভাবে অধ্যয়ন করেছেন তাদের প্রায় সবাই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য কাজ করেছেন এবং করছেন। সারা পৃথিবীতে আজ অনেক খ্যাতনামা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ববিদ তাদের লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, ভণ্ডামি ইত্যাদি দূর করার চেষ্টায় নিয়োজিত। এদের মধ্যে বাংলাদেশের ড. মহানামব্রত ব্রক্ষ্মাচারী, স্বামী অক্ষরানন্দ, সিস্টার ইউজিনিয়া, অধ্যক্ষ দেওয়ান মুহম্মদ আজরফ প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের দুইজন অধ্যাপক আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে ছিলেন পথিকৃৎ। এরা হলেন ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব ও সাইয়েদ আব্দুল হাই। ভারতের ড. রাইমু- পানিকর, ড. এমন. এসা. এসা. রমন, ইংল্যান্ডের ড. কিনেথ ক্রাগ, ড. ফ্রান্সিস কার্ক, জাপানের নামামোরা হাজিমি, জার্মানি ড. সি. ডবিস্নউ, ট্রল, ইতালির ড. ফ্রান্সিস জান্নিনি, আমেরিকার ড. মোঃ আইয়ুব, ড. হুস্টান স্মিথ এবং ড. ক্যান্টওয়েল স্মিথের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এদের প্রত্যেকই মনে করেন যে, আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মাধ্যমেই ধর্মীয় সম্প্রীতির পথ অনেকটা সুগম হয়।
আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্দেশ্যআন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্দেশ্য হলো পরস্পরকে জানা। এর উদ্দেশ্য অন্য ধর্মকে জয় করা নয়। অন্য ধর্মের সাথে সম্পূর্ণ একমত হয়ে বিশ্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠাও এর উদ্দেশ্য নয়। এর উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে অজ্ঞতাজনিত যে বিরোধ আছে তার মধ্যে সেতু বন্ধন রচনা করা এবং পৃথিবীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিকে অনুধাবন করা। যার ফলে প্রত্যেকেই তার নিজেদের ভাষায় নিজস্ব বক্তব্যকে ব্যক্ত করতে পারবে । আধুনিক ধর্মতত্ত্ববিদ ড. কাজী নুরুল ইসলাম স্বীয় গবেষণা প্রবন্ধে তুলনামূলক ধর্ম ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্দেশ্য এভাবে ব্যক্ত করেন, ‘‘তুলনামূলক ধর্ম ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের উদ্দেশ্য হচ্ছে একাত্মতা নয় বরং ঐক্য ও উপলব্ধি, কর্তৃত্ব বা প্রভুত্ব নয় বরং উন্নয়ন। সংলাপের মূল লক্ষ্য হলো প্রতিটি ব্যক্তি-হৃদয়ে অন্য সকলের জন্য কিছু জায়গা সৃষ্টি করা, সহানুভূতির উন্মেষ ঘটানো।
অতএব, বলা যায় যে, বিভিন্ন ধর্মানুসারীর মধ্যে সংলাপের উদ্দেশ্য কোনো ধর্মকে জয় করা নয়, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা নয়,  বা সামগ্রিক চুক্তি সম্পাদন বা সর্বজনীন ধর্মপ্রতিষ্ঠাও নয়; বরং বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যকার পারস্পরিক অজ্ঞানতা ও ভ্রান্ত ধারণার ফলে সৃষ্ট বিশাল শূন্যতার ক্ষেত্রে একটা সেতু নির্মাণ করে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করার ব্যবস্থা করা। বস্তুত, আন্তঃধর্মীয় সংলাপের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো, প্রত্যেককে তার নিজের কথা বলতে দেওয়া এবং নিজস্ব উক্তির মাধ্যমে স্ব স্ব অন্তর্দৃষ্টি বা মর্মকথা প্রকাশ করতে দেওয়া।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বিশ্বায়নের ফলে ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী। পৃথিবীর এক প্রান্তে কি ঘটছে এক নিমিষে শুধু খবরই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পৌঁছে না, তার দ্বারা প্রভাবিতও হয়। ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বিভিন্ন বর্ণ, গোত্র ও ধর্মের লোক আজ একত্রে বাস করতে বাধ্য। পারস্পরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহাবস্থান নিশ্চিত সহ বিভিন্ন কারণে আজ বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে আলোচনা এবং এ বিষয়ে গবেষণা অত্যন্ত আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এসব কারণের মধ্যে রাজনৈতিক, নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ধর্মতাত্ত্বিক কারণ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রকৃত কোনো অবদান রাখতে চাইলে প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পারস্পরিক সংলাপ এ মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরী। বিভিন্ন ধর্মের পর্যালোচনা, উন্নয়ন, পরিশোধন ও সঠিক ব্যাখ্যার জন্য আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বা বিনিময় অত্যাবশ্যকীয়। আমরা কে এবং কী তা জানার জন্য আমাদেরকে অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে। অন্য ধর্মকে জানার একটা আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে আমাদের নিজেদেরকে জানা এবং আমাদের নিজেদেরকে জানার একটি আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানা। ভাষা সম্পর্কে যেমন বলা হয়, যে শুধু একটি ভাষা জানে সে দাবি করতে পারে না যে ঐ ভাষা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান আছে। ঠিক তেমনিভাবে বলা যায়, যে শুধু একটি মাত্র ধর্মকে জানে সে কোনো ধর্মই সঠিকভাবে জানে না। তাই ‘যোয়াকিম ওয়াচ’ বলেন, ধর্ম সম্পর্কে যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এরূপ, যখন সবগুলি ধর্মকে অন্তত কিছুটা জানতে সক্ষম হবে একমাত্র তখনই আমরা কোনো একটি ধর্মকে যথার্থভাবে জানি বলে দাবি করতে পারবো।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি চাই তাহলে আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, আমরা একটি বৃহৎ সত্তায় অন্তর্ভুক্ত একটি বিশাল পরিবারের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছি এবং আমরা সকলেই ভালোবাসা ও সত্যের আত্মিক বাস্তবায়নের দিকে ধাবমান। আন্তঃধর্মীয় সংলাপে বিশ্বাসী কেউ কেউ বলেন, জগদ্বাসীকে নতুন করে আবার আহ্বান জানাতে হবে: ‘‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয় পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।’’
ইসলামের দৃষ্টিতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপইসলাম আন্তঃধর্মীয় সংলাপের সমর্থক। সমগ্র মানবজাতির কাছে ইসলামকে বিশ্বজনীনরূপে প্রচার, প্রসার করতে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম মূলত সকল ধর্মের সহাবস্থানের স্বীকৃতি প্রদান এবং মানুষের প্রতি সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ আচরণের উৎসাহ প্রদান করে।
মানবজীবনের পরম কল্যাণ ও শান্তি নিশ্চিতকারী জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম সুপরিচিত। আল-কুরআনে যা ‘আদ-দ্বীন’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকলের মাঝে শান্তি স্থাপনে এর মূল লক্ষ্য। পরমত সহিষ্ণুতা ইসলামের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য; যা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুপম জীবনীতে লক্ষ্য করি। প্রায়শই তাঁর কাছে আলোচনার জন্য নাসারা ও ইয়াহুদিরা আসত। তিনি তাদের সাথে আলোচনা করতেন। তবে যে বর্ণনাটি খুব ঘটা করে বর্ণনা করা হয় যে, নাজরান থেকে আগত খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদলকে তার নিজ মসজিদের অভ্যন্তরে তাদের সান্ধ্য-আরাধনা সম্পাদন করতে অনুমতি প্রদান করেছিলেন। এ বর্ণনাটি শুদ্ধ নয়। কারণ ইসলাম কখনও তার কর্মকাণ্ড ও নিজস্ব গণ্ডিতে অন্য কোনো ধর্মের হস্তক্ষেপ মেনে নেয় না। মসজিদ ইসলামের নিজস্ব এলাকা, এখানে অন্যের হস্তক্ষেপ কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিজের দ্বীনের কোনো অংশ তর্কের খাতিরে ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতাও কোনো মুসলিম করতে পারে না। যারা এটা করবে তারা মূলত ইসলাম বিদ্বেষী, মুনাফিক ও যিন্দিক। এর বিপরীতে ইসলাম নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে আলোচনায় বিশ্বাসী, যদি তা ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়।
ইসলাম বিশ্বাস করে, মানুষ মানুষে ও জাতিতে জাতিতে বিভেদ থাকতে পারে; কিন্তু তারা সবাই একই স্রষ্টার সৃষ্টি। তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ভাষাগত পার্থক্য, ভৌগলিক অসংলগ্নতা ও সাংস্কৃতিক বিভিন্নতার কোনো অন্তরায় নয়। মানবজাতির বিশ্বজনীন ঐক্য বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি নির্বিশেষে পারস্পরিক সদাচার, ন্যায়বিচার, সার্বজনীন মানবীয় মূল্যবোধ নিশ্চিত করে ইসলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ: আন্তঃধর্মীয় সংলাপের শরয়ী বিধান আল-কুরআন মহান আল্লাহর বাণী। বিশ্বের সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিশুদ্ধতম গ্রন্থ। সংলাপের শর‘ঈ মর্যাদা বা ভিত্তি, বিষয়বস্তু, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কৌশল ও পদ্ধতিসমূহ, মূলনীতি, কাদের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে ইত্যাদি বিষয়ে আল-কুরআন দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে। আল-কুরআন মুসলিমদেরকে এভাবে উৎসাহ প্রদান করে মহান আল্লাহ বলেন, “ঈসা সম্বন্ধে তোমার সাথে যে তর্ক করে তাকে বল, এস আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে ও তোমাদের নারীগণকে আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের তারপর অন্তর দিয়ে প্রার্থনা করি, বিনীত আবেদন করি এবং রাখি মিথ্যাবাদীদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ।
আল-কুরআনের অনুপম প্রেরণায়  উজ্জীবিত ইসলামে বিশ্বাসীগণ ভিন্ন বিশ্বাসীদের ধর্মীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ উৎসাহিত করেছে। মুসলিমরা সাধারণত কখনো কারোর ধর্মকে দমন করে রাখে নি বা ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি, সম্মান দেখিয়েছে। ইসলামী সাম্রাজ্যে সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ ছিল। বিভিন্ন ধর্মীয় পণ্ডিতদের উপস্থিতিতে আন্তঃধর্মীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলিম খলিফা হারুন অর রশীদ ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন ধর্মের স্কলার নিয়ে আলোচনা করতেন ধর্মনীতি। বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শনের মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপন এবং সংলাপীয় পদ্ধতিতে কুরআনের অবতরণ কুরআনুল কারিমের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।
সংলাপের ভিত্তি বা শরয়ী মর্যাদা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে ইসলামকে গোটা মানবজাতির কাছে সার্বজনীনরূপে বিশ্বব্যাপী প্রচার, প্রসার করতে ইসলামে যে সকল আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে সংলাপ বা ‘হিওয়ার’ তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।  ইসলাম সংলাপকে শুধু সমর্থনই করে না বরং সংলাপের ভিত্তি, বিষয়বস্তু, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কৌশল ও পদ্ধতিসমূহ, মূলনীতি, কাদের সঙ্গে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে ইত্যাদি বিষয়ে নান্দনিক যে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংলাপ এর শর‘ঈ মর্যাদা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:আপনি আপনার রবের পথে আহ্বান করুন জ্ঞানগর্ভ কথা ও উত্তম উপদেশসমূহের দ্বারা এবং তাদের সহিত উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন। আপনার রব, তার পথ ছেড়ে কে বিপথগামী হয়, সে সম্বন্ধে বিশেষ অবহিত এবং কারা সৎপথে আছে তাও তিনি সবিশেষ অবগত।” আয়াতে কারিমায় বর্ণিত আদেশসূচক ক্রিয়াপদ “জা-দিলহুম” পদবাচ্যটির উৎপত্তি হয়েছে ‘জাদলুন’ ধাতুমূল থেকে। এর অর্থ ঝগড়া করা, বিবাদ করা, বিতর্ক করা। অর্থাৎ আপনি তাদের সাথে বিতর্ক করুন সর্বোত্তম পদ্ধতিতে। আদেশসূচক এ ক্রিয়াপদকে কেউ কেউ সাধারণ পর্যায়ের নির্দেশ মনে করলেও এর উপর গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, সংলাপ শুধু জায়েজই নয় বরং ফরয এবং সংলাপের ব্যাপারে আমরা আদিষ্ট। উল্লেখিত আয়াতে কারিমায় একই সাথে দুটি আদেশসূচক বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে কুরআন মাজিদের অভিনব বাচনভঙ্গি ও অলংকারিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।  আরবিতে আদেশ বুঝানোর জন্য ফি‘লুল আমর বা আদেশসূচক ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। উক্ত আয়াতে কারিমাতেও অনুরূপ আদেশ বুঝানোর জন্য যথাক্রমে  এবং জাদিলহুম  শীর্ষক দুটি আদেশসূচক ক্রিয়া উল্লেখ হয়েছে; যা ফরয হওয়া বা আবশ্যক হওয়াকে বুঝায়।
মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ড. ইউসুফ আল-কারযাভী পবিত্র মক্কা নগরীতে রাবেতা আলম আল ইসলামীর উদ্দেশ্যে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ অনুষ্ঠানে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন: “সংলাপের ব্যাপারে আমরা আদিষ্ট। কেউ কেউ বলেন, সংলাপ জায়েজ। আমি আরেকটু বাড়িয়ে বলবো সংলাপ ফরয। আমরা সংলাপের ব্যাপারে নির্দেশিত। কেননা এটা দাওয়াতেরই একটি অংশ। সূরা আন-নাহলে যে আয়াতে দাওয়াতের নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে আপনি আপনার রবের পথে আহ্বান করুন জ্ঞানগর্ভ কথা ও  উত্তম উপদেশসমূহের দ্বারা এবং তাদের সহিত উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক করুন। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে উত্তম উপদেশ ও জ্ঞানগর্ভ কথা এটি মুসলিমদের জন্য যারা দ্বীনকে সমর্থন করে; আর উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্কটি হল দীনের বিরোধীদের জন্য। ইসলামের সমর্থকদের জন্য উত্তম উপদেশ যথেষ্ট। কিন্তু ইসলামকে যারা সমর্থন করে না তাদের ব্যাপারে উত্তম উপদেশ যথেষ্ট নয় বরং তাদের সাথে বিতর্ক করতে হবে উত্তম পন্থায়। বিতর্কের সঠিক ব্যাপার হল উত্তম পন্থায়। অর্থাৎ নম্র পন্থায় ভদ্রোচিতভাবে, এমন ভাষায় যা অন্তরে দাগ কাটে ।
আন্তঃধর্মীয় সংলাপে আল-কুরআনের পদ্ধতিমার্জিত ‘সম্বোধন’ সংলাপের প্রাণ। একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিষয়ের গুরুত্ব বুঝানো ও শ্রোতামণ্ডলীর মনোযোগ আকর্ষণই এর অন্যতম লক্ষ্য। আল-কুরআনে বর্ণিত বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সংলাপগুলোতে যে সকল ‘সম্বোধন’ বিদ্যমান সেগুলোতে মানবজাতির জন্য রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা। এক্ষেত্রে কোনরূপ পার্থক্য ছাড়াই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষকে মহান আল্লাহ বিভিন্নভাবে সম্বোধন করেছেন, আন্তঃধর্মীয় সংলাপে সম্বোধনের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ কখনো ইয়া আয়্যুহান-নাছ  বা হে মানবজাতি! কখনো ইয়া আয়্যুহান নাছ,এর পরিবর্তে ‘‘ইয়া আয়্যুহাল ইনসান’’  কখনো বা ইয়া আহলাল কিতাব  বা হে কিতাবধারী! বলে সম্বোধন করেছেন। কুরআন মাজিদে ‘ইয়া আয়্যুহান-নাছ  বা হে মানবজাতি! শীর্ষক পদবাচ্যটি ৯টি সূরার ১৯টি স্থানে ইয়া আয়্যুহাল ইনসান’’  শীর্ষক পদবাচ্যটি ২টি সূরায় ২টি স্থানে ও ইয়া আহলাল কিতাব বা হে কিতাবধারী! শীর্ষক পদবাচ্যটি ৩টি সূরার ১২টি স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। এছাড়া সম্বোধন ব্যতিরেকে শুধু  ‘আন-নাছ’ (মানবজাতি) এ শব্দটি ৫৪ সূরায় ২৪০ স্থানে উল্লেখ রয়েছে!আন্তঃধর্মীয় সংলাপের ধারাবাহিকতায় আল-কুরআনে বর্ণিত মহান আল্লাহর অনুপম ও হৃদয়স্পর্শী সম্বোধন নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। অবিশ্বাসীদের প্রতি আল-কুরআনের মর্যাদাপূর্ণ ও মার্জিত সম্বোধন মানব হৃদয়কে স্পর্শ করে। কুরআনে কারিমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কারো প্রতি অসম্মানজনক আচরণমূলক কোনো শব্দও খুঁজে পাওয়া যায় না।সংলাপের উপাদানসমূহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিচক্ষণতা ও প্রজ্ঞার সাথে বক্তব্য উপস্থাপন। মহান আল্লাহ বলে, “কৌশল ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ দ্বারা তুমি তোমার রবের পথে আহ্বান কর এবং তাদের সাথে উত্তম পদ্ধতিতে বিতর্ক কর।”সূরা আন-নাহল-এর উল্লেখিত আয়াতে কারিমায় দাওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালাসহ মুসলিম এবং অমুসলিমদের মাঝে অনুষ্ঠিতব্য সংলাপের নীতিমালা ব্যক্ত হয়েছে; যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ তাদের সাথে দাওয়াতের পদ্ধতি হচ্ছে, নম্র পন্থায়, ভদ্রোচিতভাবে, এমন ভাষায় যা অন্তরে দাগ কাটে যেমন কুরআন আমাদের শিখিয়েছে।অযাচিত তর্ক-বিতর্ক মানুষের সম্পর্ক বিনষ্ট করে এবং হৃদয়ের গভীর থেকে ভালবাসার সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য ধ্বংস করে। তাই সব সময়েই এ ধরণের তর্ক-বিতর্ক পরিত্যাজ্য। আন্তঃধর্মীয় সংলাপকে ফলপ্রসূ করতে হলে অযাচিত তর্ক-বিতর্ক বর্জন আবশ্যক। সংলাপে অংশগ্রহণকারী চাই সে ইয়াহুদি বা খ্রিষ্টান হোক বা ভিন্ন বিশ্বাসের হোক সকলের সাথে অযাচিত তর্ক বিতর্ক পরিহার করতে নির্দেশ প্রদান করে ইসলাম। সূরা আনকাবুতে এ প্রসঙ্গটি এভাবে এসেছে,‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত কিতাবিদের সাথে বিতর্ক করবে না, তবে তাদের সাথে করতে পার, যারা তাদের মধ্যে সীমালংঘনকারী এবং বল, ‘আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে, তাকে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ একই এবং আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’’ আয়াতে কারিমায় আন্তঃধর্মীয় সংলাপের এক গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা ব্যক্ত করা হয়েছে। আহলে কিতাব বা ইয়াহুদি খ্রিষ্টানদের সাথে অকারণে জাদল (তর্ক-বিতর্ক) করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইমাম রাযী স্বীয় তাফসীর আল-কাবীর-এ উল্লেখ করেন: আল-জিদাল বা বিতর্ক দু’প্রকার: ‘হক’ বা সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তর্ক বিতর্ক এবং বাতিল মিথ্যা প্রতিষ্ঠার জন্যে তর্ক-বিতর্ক। সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে জিদাল করা হয় তা মূলত: নবী রাসূলদের পেশা। আর মিথ্যা প্রতিষ্ঠায় যে তর্ক-বিতর্ক তা নিন্দনীয়।’ তাই জিদাল বা তর্ক করতে হলে অত্যন্ত সুন্দর পদ্ধতিতে হক প্রতিষ্ঠার জন্য করতে হবে, শুধুমাত্র তর্কের জন্য তর্ক যেন না করা হয়।
বিনয়-নম্রতা সংলাপের এক অন্যতম উপাদান। সংলাপকে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ করে তুলতে বিনয়-নম্রতা ও কোমলতার অনুসরণ অপরিহার্য। বিশেষ করে আন্তঃধর্মীয় সংলাপে এর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এর প্রসঙ্গে আল-কুরআনে বর্ণিত মূসা আলাইহিস সালাম ও হারুন আলাইহিস সালাম এবং ফিরাউনের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য সংলাপ কিভাবে পরিচালিত হবে তার নির্দেশনা ব্যক্ত হয়েছে সূরা ত্বহায়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘‘তুমি ও তোমার ভ্রাতা আমার নিদের্শনাসহ যাত্রা কর এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করিও না। তোমরা উভয়ে ফির‘আউনের নিকট যাও, সে তো সীমালঙ্ঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নম্র কথা বলবে, হয়তো সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে।’’
যে সকল বিষয় ঐক্যমত্য রয়েছে সেগুলি থেকেই সংলাপের শুভ সূচনা আন্তঃধর্মীয় সংলাপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা হল, সংলাপে অংশগ্রহণকারী পক্ষদ্বয়ের কাছে যে সকল  বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে সেগুলো থেকেই সংলাপের সূচনা হওয়া। সূরা আশ-শু‘আরা-এর ﴿“এবং আপনি আপনার নিকট আত্মীয়-স্বজনদেরকে ভীতি প্রদর্শন করুন।” শীর্ষক আয়াতে কারিমা অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ আয়াতের প্রেক্ষিতে কুরায়শদের সাথে সাফা পর্বতের পাদদেশে তাদেরকে আহ্বান পূর্বক একটি গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ করেন; যা মূলত: দিকনির্দেশনা পূর্ণ একটি আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। এ প্রসঙ্গটি ইমাম বোখারি ইবন আব্বাস রা-এর উদ্ধৃতি এভাবে উল্লেখ করেন, তিনি বলেন: শীর্ষক আয়াতে কারিমা নাযিল হল, তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পর্বতে আরোহণ করে কুরায়শদের দুই গোত্রকে এভাবে আহ্বান করতে থাকেন, ওহে বনী ফিহর। ওহে বনী আদী! অর্থাৎ ওহে ফিহরের বংশধর! ওহে ‘আদীর বংশধরেরা! এরপর উভয় গোত্রের লোকজন আহ্বানে সাড়া দিয়ে একত্রিত হল। যারা উপস্থিত হতে পারল না তারা স্বীয় প্রতিনিধি প্রেরণ করল যাতে তারাও আহুত বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে। গোত্রপতি আবু লাহাবও সেখানে উপস্থিত হন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি আমি তোমাদেরকে এ সংবাদ দেই যে, পাহাড়ের পাদদেশে এমন এক অশ্বারোহী বাহিনী অবস্থান করছে যারা তোমাদেরকে নিশ্চিত আক্রমণ করবে, তোমরা কি আমার এ সংবাদটি বিশ্বাস করবে? তারা বলল; হ্যাঁ, আমরা সকলেই বিশ্বাস করব। কেননা তোমার ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা এ যে, তুমি সত্যবাদী। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আখিরাতের কঠিন শাস্তির ব্যাপারে আমি তোমাদের জন্য একজন ভীতি প্রদর্শনকারী।’ আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যায় বর্ণিত হাদিসে বনী ‘আদী ও বনী ফিহর ও কুরায়শদের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সংলাপ বর্ণিত হয়েছে তাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ বিষয়ের উল্লেখের মাধ্যমে সংলাপ আরম্ভ করেছেন যে বিষয়ে সংলাপে অংশগ্রহণকারীদের উভয় পক্ষ ঐকমত্য ছিলেন। সে বিষয়টি ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যবাদিতা।
মার্জনা, উদারতা ও সহিষ্ণুতা অবলম্বনপরমত সহিষ্ণুতা সংলাপের অনন্য ভূষণ। পারস্পরিক ক্ষমা, মার্জনা, উদারতা ইত্যাদি গুণাবলীর মাধ্যমেই পরমত সহিষ্ণুতা অর্জিত হয়। উল্লিখিত গুণাবলি অর্জনে মহান আল্লাহ এভাবে নির্দেশ করেছে : তুমি ক্ষমাপরায়ণতা অবলম্বন কর, সৎকার্যের নির্দেশ দাও এবং অজ্ঞদিগকে এড়িয়ে চল।
পারস্পরিক ক্ষমা, মার্জনা, উদারতা ও পরমত সহিষ্ণুতা অর্জনে ইসলামের নির্দেশনা সুস্পষ্ট। ইসলামের প্রাথমিক যুগে একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাসজিদুল হারামে অবস্থান করছিলেন। এ সময় কতিপয় মুশরিক দলবদ্ধভাবে ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য সমবেত হন এবং তারা নানাভাবে তর্কবিতর্ক করতে থাকেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জ্ঞানগর্ভ, ধৈর্যপূর্ণ ও মনোজ্ঞ আলোচনায় মু হয়ে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন।
পরমত অনুসারীর প্রতি গালমন্দ বা কটাক্ষ বর্জন কটাক্ষ বা গালমন্দ মানবমর্যাদা পরিপন্থী। আত্মসম্মানে আঘাত হানে এবং হৃদয়ে গভীর জখম সৃষ্টি করে। সংলাপের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনে গালমন্দ ও কটাক্ষ পরিত্যাজ্য। মহান আল্লাহ বলেন: আল্লাহকে ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। কেননা তারা সীমালঙ্ঘন করে অজ্ঞনতাবশত আল্লাহকেও গালি দিবে।
ইসলাম অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি খারাপ ব্যবহার পরিহারের নির্দেশ প্রদান করে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের শিরক, কুফর, দুর্নীতি ইত্যাদি কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করা হলেও তাদেরকে গালি-গালাজ, কটূক্তি বা দুর্ব্যবহার সর্বোতভাবে বর্জনের চেষ্টা করা হয়েছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রামাণ্য যুক্তি উপস্থাপনসংলাপের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনে প্রয়োজন প্রামাণ্য, নির্ভরযোগ্য ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি ও প্রমাণাদি উপস্থাপন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী: ‘বল, তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত এমন কিছুর ইবাদাত কর যারা তোমাদের কোনো ক্ষতি বা উপকার করার ক্ষমতা নেই? আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’’
অতএব, যে ধর্মের সাথে সংলাপ হবে তাকে অবশ্যই সে ধর্ম সম্পর্কে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান রাখতে হবে। শুধুমাত্র ধর্মীয় জ্ঞান সেখানে যথেষ্ট মনে করার কোনো উপায় নেই।
নিজ বিশ্বাসসহ ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি জ্ঞানের গভীরতা সংলাপের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জনের জন্য অত্যাবশ্যক। আল-কুরআন প্রসঙ্গটি এভাবে ব্যক্ত করেন, “মানুষের মধ্য কেউ কেউ আল্লাহ সম্বন্ধে বিত-া করে; তাদের না আছে জ্ঞান, না আছে পথ নির্দেশ, না আছে কোনো দীপ্তিমান কিতাব।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ: পবিত্র কুরআনে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ কুরআনে কারিম এমন এক গ্রন্থ যাতে পূর্ববর্তীদের কাহিনী ও পরবর্তীদের কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। এখানে একদিকে রয়েছে পূর্ববর্তী জাতিসমূহের উত্থান-পতনের ইতিহাস অপরদিকে রয়েছে দীন ও আকিদার বর্ণনা। কুরআন একদিকে বর্ণনা করছে তাদের আচার-আচরণ লেন-দেন অপরদিকে তাদের সমসাময়িক নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিবর্গের কাহিনীও বিধৃত হয়েছে।
এছাড়াও পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরোধ রয়েছে তারও উল্লেখ রয়েছে। এর বিভিন্ন স্থানে ইয়াহুদি, খ্রিষ্টান, সাবায়ী, মুশরিক, প্রকৃতিবাদী প্রভৃতি মতাদর্শ ও তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা দেখতে পাই। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, বল, হে কিতাবিগণ! এস সে কথায়, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে একই; যেন আমরা একমাত্র আল্লাহ্‌ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি এবং তার সাথে কাউকে শরীক না করি। আর আমাদের কেউ যেন আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ না করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে বল, তোমরা সাক্ষী থাক, অবশ্যই আমরা মুসলিম।’’
এ আয়াতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি বর্ণিত হয়েছে। তাহলো, বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ঐক্যসূত্রের সন্ধান। আলোচ্য আয়াতে কিতাবিদেরকে বলা হয়েছে যে, যদি তোমরা এক আল্লাহতে ঈমান এনে থাক তবে তোমাদের এবং মুসলিমদের মধ্যে এই ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দু থেকেই সংলাপ ও আলোচনার সূত্রপাত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ: সুন্নাতে নববীতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদি, খ্রিষ্টান ও মুশরিকদের সাথে যেসব মুজাদালাহ বা সর্বোত্তম পন্থায় যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেগুলোর কিছু দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরা হলো: ইয়াহুদিদের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিতর্ক: মদিনায় বিভিন্ন সময়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদিদের সাথে ধর্মীয় বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। কারণ তারা তাঁর আশে-পাশেই থাকত। তারাও তাঁর সাথে ধর্মীয় বিষয়ে অনেক মতবিনিময় করত এবং বিভিন্ন ভ্রান্ত প্রশ্ন ও সন্দেহের অবতারণা করত। আর তিনি রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলোর অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ জওয়াব দিতেন। 
যার কিছু নমুনা নিম্নে উপস্থাপিত হলো: আব্দুল্লাহ ইবন্ সালাম এর সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথোপকথনের ঘটনা উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে,আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আব্দুল্লাহ ইবন সালাম শুনলেন যে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করেছেন। তিনি তাঁর কাছে এসে বললেন, আমি আপনাকে তিনটি প্রশ্ন করব যা নবী ব্যতীত কেউ উত্তর দিতে পারে না। তারপর তিনি বললেন, কিয়ামতের প্রথম আলামত কি? জান্নাতিরা প্রথম কোনো খাবার খাবে? সন্তান কিভাবে পিতার মত এবং কিভাবে তার মাতুলদের মত হয়?তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,আমাকে এই মাত্র জিবরাঈল তা জানিয়েছে। তখন আব্দুল্লাহ বললেন, ইয়াহুদিদের নিকট এ ফেরেশতা তাদের শত্রু। তারপর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কিয়ামতের প্রথম আলামত হচ্ছে, একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাবে। আর জান্নাতিদের প্রথম খাবার হবে মাছের কলিজা। আর সন্তান কারো সাদৃশ্য হওয়ার পিছনে যুক্তি হলো, যদি কেউ তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তখন যদি পুরুষের বীর্য অগ্রণী হয় সন্তান পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে যদি স্ত্রীর বীর্য অগ্রণী হয় তখন সন্তান স্ত্রীর মত হয়। তখন তিনি বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে,আপনি আল্লাহর  রাসূল। তারপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! ইয়াহুদিরা মিথ্যুক জাতি, যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করার আগে আমার ইসলামের কথা তারা জেনে যায় তবে আমাকে মিথ্যুক বানিয়ে ছাড়বে। তারপর আব্দুল্লাহ ইয়াহুদিদের কাছে আসলেন এবং তাদের ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদিদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম কেমন লোক? তারা বলল: আমাদের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি এবং জ্ঞানী ব্যক্তির সন্তান। আমাদের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি এবং উত্তম ব্যক্তির সন্তান। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি সে ইসলাম গ্রহণ করে? তারা বলল, আল্লাহ তাকে এ ধরনের কাজ করা থেকে বাঁচিয়ে রাখুন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বের হয়ে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত হক কোনো মা‘বুদ নেই, আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। তখন তারা বলল,সে আমাদের সবচেয়ে খারাপ লোক এবং খারাপ লোকের সন্তান। এভাবে তারা তার উপর আক্রমণাত্মক কথা বলতে লাগল ।
আব্দুল্লাহ ইবন্ উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘‘ইয়াহুদিরা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে এসে বলল: তাদের মধ্যে একজন পুরুষ ও মহিলা যিনা করেছে। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন: তোমরা কি তাওরাতে রজম সম্পর্কে কিছু পেয়েছ?তারা বলল: ‘‘তাদেরকে অপমানিত করব এবং তাদেরকে বেত্রাঘাত করা হবে।’’ তখন তাদের আব্দুল্লাহ ইবন্ সালাম বলেন: তোমরা মিথ্যা বলেছ, সেখানে রজমের কথা রয়েছে। তখন তারা তাওরাত নিয়ে এসে তা খুলে ধরল। অতঃপর তাদের একজন রজমের আয়াতের উপর হাত রেখে আগের ও পরের বাক্যাবলী পাঠ করল। তখন আব্দুল্লাহ ইবন্ সালাম বললেন: তুমি হাত উঠাও। অতঃপর যখন হাত উঠানো হলো তখনি সেখানে রজমের আয়াত দেখা গেল। তখন তারা বলল: হে মুহাম্মাদ! আপনি সত্য বলেছেন। এতে রজমের আয়াত রয়েছে। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তাদেরকে রজম তথা পাথর মেরে হত্যার নির্দেশ দিলেন। আর তাদেরকে পাথর মারা হলো।’’
তাছাড়া, ধর্মীয় আলোচনার জন্য রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং ইহুদীদের ‘মিদরাস’ -এর গমন করেছেন। এ আলোচনায় সাধারণত উলুহিয়্যাত-ঈশ্বরতত্ত্ব, ধর্মীয় গ্রন্থ, রাসূলতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরূপ পারস্পরিক আলোচনার ফলে আবদুল্লাহ ইবন সালাম,সা‘লাবা ইবন সাঈদ,আসাদ ইবন উসাইদ-এর মত প্রভাবশালী ইহুদী পণ্ডিত ও নেতৃবৃন্দ ইসলাম গ্রহণ করেন। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘একবার রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদিদের একটি শিক্ষায়তনে প্রবেশ করলেন যেখানে একদল ইয়াহুদি অবস্থান করছিল। তিনি তাদেরকে আল্লাহর পথে আহ্বান করলেন। তখন নু’মান ইবন্ আমর এবং হারেস ইবন্ যায়দ বলেন: হে মুহাম্মাদ! তোমার দিন কোনটি? তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আমি ইবরাহীমের দীনের উপর। তখন তারা উভয়ে বলল: ইবরাহীম তো ইয়াহুদি ছিল। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাহলে তাওরাত নিয়ে আস, আমাদের ও তোমাদের মাঝে সেটাকে ফয়সালাকারী হিসেবে গ্রহণ কর। কিন্তু তারা উভয়ে তা করতে অস্বীকার করল। তখন আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন: ‘‘আপনি কি তাদেরকে দেখেননি যাদেরকে কিতাবের অংশ প্রদান করা হয়েছিল? তাদেরকে আল্লাহর কিতাবের দিকে আহ্বান করা হয়েছিল যাতে ওটা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়;তারপর তাদের একদল ফিরে দাঁড়ায়,আর তারাই পরাম্মুখ।’’
এ ছাড়াও ইয়াহুদিদের বিভিন্ন প্রতিনিধিদল রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসত, বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করত এবং বিতর্কে লিপ্ত হত ।
খ্রিষ্টানদের সাথে তাদের ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কখ্রিষ্টানদের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াহুদিদের তুলনায় স্বল্প পরিমাণ ধর্মীয় বিতর্ক করেছেন। কারণ তারা মূলত মদিনা থেকে দূরে অবস্থান করত। ফলে মুসলিমদের সাথে তাদের খুব কম সাক্ষাত হতো। তারপরও যখনি কোনো প্রতিনিধিদল রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আগমন করত তখনি তারা ধর্মীয় বিষয়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হত। এক্ষেত্রে হাবশা ও নাজরানের খ্রিষ্টানদের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে।
সিরাতে ইবন্ হিশামে এ জাতীয় একটি ধর্মীয় সংলাপ এসেছে। যার বিষয়বস্তু হলো: খ্রিষ্টানগণ রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দরবারে এসে ঈসা ইবন্ মারইয়াম সম্পর্কে বিতর্ক সৃষ্টি করল। তারা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঈসা আলাইহিসালামের পিতা সম্পর্কে প্রশ্ন করল এবং তারা আল্লাহ্‌ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার অপবাদ ও মিথ্যা বলে বেড়াতে লাগল। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘তোমরা জান যে, যত সন্তানই আছে তারা তাদের পিতার সদৃশ হয়? তারা বলল: অবশ্যই। তিনি বললেন: তোমরা কি জান না যে, আমাদের প্রভু চিরঞ্জীব, তাঁর মৃত্যু নেই? অথচ ঈসার অস্তিত্ব বিলীন হবে? তখন তারা বলল: অবশ্যই। তিনি আরও বললেন: আমাদের রব সবকিছুর ধারক-বাহক,তিনি সবকিছুর সংরক্ষণ করেন ও রিযক দিয়ে থাকেন? তারা বলল: নিশ্চয়ই। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাহলে ঈসা ইবন্ মারঈয়াম কি এগুলোর কোনো কিছু করতে সক্ষম? তখন তারা বলল: না। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা কি জান না যে, আসমান ও জমিনের কোনো সৃষ্টিই তাঁর কাছে গোপন নেই? তারা বলল: নিশ্চয়ই। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বললেন: আমার প্রভু ঈসাকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে রেহেমের মধ্যে আকৃতি দান করেছেন। তিনি আরও বললেন: আর আমার প্রতিপালক খানা-পিনা করেন না এবং কোনো অপবিত্র কাজও ঘটান না?তখন তারা বলল: নিশ্চয়ই। রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমরা কি জান না যে, অন্যান্য মহিলাদের মত ঈসাও মায়ের গর্ভে লালিত-পালিত হয়েছেন? তারপর অন্যান্য মহিলারা যেভাবে বাচ্চা প্রসব করে তিনি তার মাও তাকে সেভাবে প্রসব করেছেন এবং অন্যান্য বাচ্চাদের মত তাকেও খাওয়ানো হয়েছে। তারপর তিনি খাবারও খেয়েছেন, পানও করেছেন এবং অপবিত্রও হয়েছেন? তারা বলল: অবশ্যই। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তাহলে তোমরা যা ধারনা করছ তা কিভাবে সম্ভব হতে পারে? এরপর তাদের সবাই চুপ হয়ে গেল। এ পরিপ্রেক্ষিতেই প্রথম থেকে আশির অধিক আয়াত নাযিল হয়।
অন্য এক বর্ণনায় এসেছে যে,হাবশা থেকে একদল খ্রিষ্টান রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করে। তারা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বিভিন্ন দীনি প্রশ্ন করে দু’ধর্মের মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে ইসলাম গ্রহণ করে অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদী ইবন্ হাতিমের সাথে তার দীন খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে যুক্তিতে পরাস্ত করে আল্লাহর দীন মানতে উদ্বুদ্ধ করেন। যার ফলশ্রুতিতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ‘আদী ইবন্ হাতিম বলেন: ‘‘যখন আল্লাহ্‌ তা‘আলা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন,তখন তাঁকে এমন প্রচণ্ড আকারে ঘৃণা করলাম এবং তাঁর থেকে পালিয়ে জমিনের একপ্রান্ত রোমের পার্শ্বস্থ আরবভূমিতে আশ্রয় নিলাম। তারপর আমি আমার প্রথম স্থানের চেয়েও সে স্থানে অবস্থান করাটা অত্যধিক অপছন্দ করলাম। তারপর আমি স্বয়ং বললাম, আমি যদি লোকটির কাছে যেতাম এবং তার কাছ থেকে কিছু শুনতাম তাহলে কেমন হয়। তারপর আমি মদিনায় আসলাম। মানুষের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়ল। তারা বলাবলি করতে লাগল যে,আদী ইবন্ হাতিম আত-ত্বায়ী এসেছে। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হে ‘আদী! তুমি ইসলাম গ্রহণ কর তাহলে নিরাপত্তা পাবে। আমি বললাম আমি একটি দীনের উপর আছি। তিনি  সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার দীন সম্পর্কে আমি তোমার থেকেও অধিক জ্ঞাত। আমি বললাম: আপনি কি আমার দীন সম্পর্কে আমার থেকেও অধিক জ্ঞাত? তিনি বললেন: হ্যাঁ। ‘আদী ইবন্ হাতেম বলেন: রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাটি তিনবার উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বললেন: তুমি কি ‘রন্ডকুচী’ নও? (অর্থাৎ এমন সম্প্রদায় যারা খ্রিষ্টান ও সাবেয়ী এ দু’ধরনের ধর্মের মধ্য পন্থার অনুসারী) আমি বললাম, অবশ্যই। তিনি বললেন, তুমি কি তোমার সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দাও না? আমি বললাম, হাঁ। তিনি বললেন: তুমি কি ‘লুটের সম্পদের চারভাগে এক ভাগ নাও না? আমি বললাম: নিশ্চয়ই। তিনি বললেন: কিন্তু এটা তো তোমার ধর্মমতে অবৈধ। ‘আদী ইবন্ হাতিম বলেন: এতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তারপর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: সম্ভবত এটাই সম্ভবত তোমাকে আমাদের দীন থেকে দূরে রেখেছে, কারণ তুমি দেখতে পাচ্ছ যে, আমাদের এখানে অভাব-অনটন রয়েছে।’’
ইবনে কাইয়্যেম রাহেমাহুল্লাহ এ সমস্ত কুরআনের আয়াত ও হাদিসের ভাষ্য এবং সিরাতের বিভিন্ন ঘটনা যেমন নাজরানের খ্রিষ্টানদের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মীয় বিতর্ক এগুলোর শিক্ষা বর্ণনায় বলেন: এ ঘটনা থেকে যে শিক্ষা আমরা পাই তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে: আহলে কিতাবদের সাথে ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্ক করা জায়েজ বরং মুস্তাহাব। আবার ক্ষেত্রবিশেষে ওয়াজিবও যখন এটা স্পষ্ট হবে যে,এ আলোচনায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রত্যক্ষ করার মাধ্যমে তাদের অনেকেই ইসলামের সুমহান আদর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে। আর বুদ্ধিভিত্তিক ও জ্ঞান ভিত্তিক যুক্তি উপস্থাপন করে তাদের বিভিন্ন সন্দেহ ও প্রশ্নের অপনোদন করা প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।
তাছাড়া, মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের পর আরব-খ্রিষ্টানদের প্রধান কেন্দ্র-নাজরান থেকে একদল প্রতিনিধি মদিনায় আসেন। খ্রিষ্টানদের এক নেতার নেতৃত্বে চৌদ্দ জন পাদ্রীসহ ষাটজন প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করেন। তারা ইসলাম ও খ্রিস্টানধর্ম সম্পর্কে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাদের ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়।  এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর সূরা আলে-ইমরান অবতীর্ণ হয়।
অনুরূপভাবে ইরানের অধিবাসী প্রখ্যাত সাহাবী সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও সত্যদীন অনুসন্ধানের জন্য বহু কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে মদিনায় আসেন। তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন মাজদাক ধর্মের অনুসারী। এ ধর্মমত তাঁকে পরিতৃপ্ত করে পারেনি। তাই তিনি খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু এতেও তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত সত্য লাভে অসমর্থ হন। পরিশেষে মদিনায় রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আগমন করেন এবং বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ইসলামের সত্যতায় স্থিরচিত্ত হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। মুশরিকদের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ধর্মীয় বিতর্কবিভিন্ন বর্ণনায় প্রায়শই দেখা যায় যে, কতিপয় মুশরিক দলবদ্ধভাবে ধর্ম সম্পর্কে বিতর্ক-জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য তাঁর পাশে সমবেত হয়। মহানবী  সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  সাথে আলোচনায় তাঁরা সন্তুষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। 
তুফাইল ইবন আমর আদ্-দাওসী ছিলেন ঘোর পৌত্তলিক। কেবল ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ নিয়ে তিনি মক্কায় রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে তিনি রাসূল রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সত্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করে কৃতার্থ হন।  এভাবে অনেক পৌত্তলিক দলগত ও ব্যক্তিগতভাবে রাসূলের সাথে ধর্মালোচনায় মিলিত হন।
ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হে কুরাইশ সম্প্রদায়! নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারও ইবাদতে কোনো কল্যাণ নেই। কিন্তু কুরাইশগণ জানত যে, খ্রিষ্টানগণ ঈসা আলাইহিসালামের ইবাদত করত। সুতরাং মুহাম্মাদ সম্পর্কে তুমি কি বলবে? তখন তারা মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে উদ্দেশ্য করে বলল: হে মুহাম্মাদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! তুমি কি বিশ্বাস করনা যে, ঈসা নবী ছিলেন এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের মধ্যে একজন ছিলেন? যদি তুমি তোমার কথায় সত্য হও তাহলে তাদের ইলাহও তো তোমাদের বক্তব্যমত হওয়া উচিত। তখন কুরআনে ইরশাদ হলো, যখন মারইয়াম-তনয়ের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়, তখন আপনার সম্প্রদায় তাতে শোরগোল আরম্ভ করে দেয়, এবং বলে, ‘আমাদের উপাস্যগুলো শ্রেষ্ঠ না ‘ঈসা?’ এরা শুধু বাক-বিতণ্ডার উদ্দেশ্যেই আপনাকে এ কথা বলে। বস্তুত এরা তো এক বিতণ্ডাকারী সম্প্রদায়। তিনি তো ছিলেন আমারই এক বান্দা, যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং করেছিলাম বনী ইসরাইলের জন্য দৃষ্টান্ত।’’
অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমরান ইবন্ হুসাইনের পিতা হুসাইনকে বলেন: হে হুসাইন! তুমি আজ কয়জনের ইবাদত কর? হুসাইন উত্তর করলেন: সাতজনের, ছয়জন জমিনে আর একজন আসমানে। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার আবেগ ও ভীতির জন্য কাকে গণ্য করো? উত্তরে হুসাইন বলেন: যিনি আসমানে আছেন। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: হে হুসাইন! তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো তবে আমি তোমাকে এমন দু’টি কালেমা শিক্ষা দেব যা তোমার উপকারে আসবে। তারপর যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে যে দু’টি কালেমা শেখানোর ওয়াদা করেছেন সে দু’টি শিক্ষা দিন। তখন রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: বল,হে আল্লাহ ! আমাকে সঠিক পথের দিশা মনে ঢেলে দিন এবং আমাকে আমার অন্তরের অকল্যাণ থেকে বাঁচান।
এখানেও আমরা দেখতে পাই যে, মুশরিকদের দীনের ব্যাপারে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্যক অবগত হয়ে তাদের সাথে দীনি বিতর্ক করে তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন।
অনুরূপভাবে ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন ‘‘তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ‘ইবাদাত কর সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সবাই তাতে প্রবেশ করবে।’’[সূরা আল-আম্বিয়া:৯৮] এ আয়াত নাযিল হলো, তখন মুশরিকরা বলতে লাগল, ফেরেশতা, উযাইর এবং ঈসা এরও তো ইবাদত করা হয়, তারাও কি জাহান্নামে যাবে? তখন আল্লাহ্‌ নাযিল করলেন, ‘‘যাদের জন্য আমার কাছ থেকে পূর্ব থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদেরকে তা থেকে দূরে রাখা হবে।’’ [সূরা আল-আম্বিয়া:১০১]
অন্য বর্ণনায় এসেছে,কাফের মুশরিকরা রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের  কাছে এসে ঈসা আলাইহিস্ সালাম নিয়ে বাদানুবাদ শুরু করে দিল। বিশেষ করে ওলীদ ইবনে মুগীরাহ। তখন আল্লাহ্‌ নাযিল করলেন,‘যখন মারইয়াম-তনয়ের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়, তখন আপনার সম্প্রদায় তাতে শোরগোল আরম্ভ করে দেয়, এবং বলে, ‘আমাদের উপাস্যগুলো শ্রেষ্ঠ না ‘ঈসা?’ এরা শুধু বাক-বিত-ার উদ্দেশ্যেই আপনাকে এ কথা বলে। বস্তুত এরা তো এক বি-াকারী সম্প্রদায়। তিনি তো ছিলেন আমারই এক বান্দা, যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং করেছিলাম বনী ইসরাইলের জন্য দৃষ্টান্ত। আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের মধ্য থেকে ফিরিস্তা সৃষ্টি করতে পারতাম, যারা পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী হত।‘ঈসা তো কিয়ামতের নিশ্চিত নিদর্শন; কাজেই তোমরা কিয়ামতে সন্দেহ করো না এবং আমাকে অনুসরণ কর। এটাই সরল পথ।’’ [সূরা আয-যুখরুফ: ৫৭-৬১]
তদ্রূপ মুশরিকদের পুনরুত্থান সংক্রান্ত সংলাপ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ। পবিত্র কুরআনে ও রাসূলের হাদিসে তার বর্ণনা এসেছে, একবার উবাই ইবনে খালাফ রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসল। তার হাতে ছিল একটি পুরাতন হাড়। সে সেটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কি মনে কর যে, আল্লাহ্‌ এটারও পুনরুত্থান ঘটাবেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তোমাকেও আল্লাহ্‌ মৃত্যু দিবেন এবং পুনরুত্থান করবেন তারপর তোমাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। তখন আল্লাহ্‌ আগত আয়াতসমূহ নাযিল করেন: ‘‘মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অথচ পরে সে হয়ে পড়ে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী। এবং সে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে, ‘কে অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে যখন তা পচে গলে যাবে?’ বলুন,‘তাতে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই যিনি তা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ তিনি তোমাদের জন্য সবুজ গাছ থেকে আগুন উৎপাদন করেন এবং তোমরা তা থেকে প্রজ্বলিত কর। যিনি আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি কি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করতে সমর্থ নন? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি মহাস্রষ্টা, সর্বজ্ঞ।’’ [সূরা ইয়াসিন:৭৭-৮০]

আপনার মন্তব্য

আলোচিত