তপোধীর ভট্টাচার্য: প্রজ্ঞা যেখানে হৃদয়াবেগে মেশে

 প্রকাশিত: ২০২৩-০২-০৫ ১৪:২৩:৩৮

 আপডেট: ২০২৩-০২-০৬ ১১:১২:৫৮

তুষার গায়েন:

একই সাথে প্রখর পণ্ডিত, সৃষ্টিশীল এবং গভীর হৃদয়াবেগ সম্পন্ন মানুষ পৃথিবীতে খুব কম দেখতে পাওয়া যায়। তেমন কিছু বিরল মানুষ, যাদের কীর্তির পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হবার ও সান্নিধ্য পাবার সুযোগ হয়েছে— তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যতাত্ত্বিক, সমালোচক ও অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্যের সাথে প্ৰথম সাক্ষাৎ ঘটে ঢাকায় ১৯৯৫ সালে, 'একবিংশ' পত্রিকার দশম বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইন্সটিটিউটের অডিটোরিয়ামে। 'বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতা' শিরোনামে আমি একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম সেই সভায়, যার সভাপতিত্ব করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তপোধীর ভট্টাচার্য। সে দফায় তপোধীরদার সাথে খুব একটা কথা বলার সুযোগ না হলেও, ২০০০ সালে বগুড়ায় লিটল ম্যাগাজিন 'নিসর্গ' আয়োজিত জীবনানন্দ দাশের জন্মশতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে অন্তরঙ্গভাবে আড্ডা দেয়ার সুযোগ ঘটে। জীবনানন্দের বিখ্যাত কবিতা 'শ্যামলী' নিয়ে আমি যে অনুসন্ধানী আলোচনা করেছিলাম সেটি তাঁকে মুগ্ধ করেছিল এবং ঐ সভাতেই তিনি আমার আলোচনা ও বিশ্লেষণের দারুণ প্রশংসা করেছিলেন।

ঢাকা থেকে আমন্ত্রিত আমার আরও দু'জন কবিসতীর্থসহ বগুড়ায় যে হোটেলে আমরা ছিলাম, সেখানেই অবস্থান করছিলেন তপোধীর ভট্টাচার্য এবং তাঁর সুযোগ্য সহধর্মিণী স্বপ্না ভট্টাচার্য। আমার এখনও মনে আছে, তিনি নিজে থেকে আমাদের রুমে এসে উচ্ছ্বসিত কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন, "নীলভবহ্রদ কী? নীলভবহ্রদ কী?" 'একবিংশ' পত্রিকায় প্রকাশিত আমার 'নীলভবহ্রদ' কবিতাটি তিনি পড়েছিলেন আমি বুঝতে পারলাম এবং বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে তাঁর মতো একজন পণ্ডিত লেখক, অধ্যাপক একজন তরুণ কবির কবিতা পড়ে এতটা গুরুত্বসহকারে মুগ্ধতার কথা জানান দিচ্ছেন যা গভীর অন্তঃকরণ ছাড়া সম্ভব না। আমি সকৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর হাতে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ তুলে দিলাম যেটি কিনা ওই কবিতার নামে নামাঙ্কিত, 'নীলভবহ্রদ'। বাংলাদেশের কবিতা, বিশেষত তরুণ কবিদের কবিতার গতিপ্রকৃতি নিয়ে তিনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল লিটল ম্যাগাজিনে যে গভীর বিশ্লেষণ ও তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন, সেটা তাঁর বয়স ও পর্যায়ের আর কোনো বাঙালি লেখক, প্রাবন্ধিককে আমি করতে দেখিনি। আমার অত্যন্ত সৌভাগ্য যে সেসব আলোচনায় আমার কবিতা তাঁর মনীষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়নি।

২০০৫ সালে আমি কানাডায় অভিবাসী হয়ে চলে আসার পর যাদের খুব বেশি করে মনে পড়েছে তাঁর মধ্যে তপোধীর ভট্টাচার্য অন্যতম। প্রায়শই ভাবতাম, দেশে থাকলে মাঝে মধ্যে তাঁর সাথে দেখা সাক্ষাৎ হবার সুযোগ হতো, কিন্তু এত দূরত্বে থেকে কীভাবে সেই যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব? যুগাধিক কাল পর ফেসবুকের কল্যাণে তপোধীরদার সাথে আমি বন্ধু তালিকায় যুক্ত হলাম বটে, কিন্তু তাঁর মতো একজন গভীর চিন্তাশীল লেখকের পক্ষে তো সব সময় ফেসবুকের লঘু হাওয়ায় ভেসে বেড়ানো সম্ভব না। ফেসবুকে আমার বিভিন্ন পোস্টে তপোধীরদাকে ট্যাগ করতে গিয়ে তাঁর নাগাল পাই না। আবার তপোধীরদার কোনো পোস্ট যেমন আমি দেখি না, তেমনি অন্য কারো লেখাতেও তাঁর কোনো পাঠ-প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না। শুধু 'দ্বিরালাপ' নামে তাঁর সঞ্চালনায় মননঋদ্ধ সাহিত্য আলোচনার কিছু ভিডিও মাঝে মাঝে আমার নিউজফিডে ভেসে আসে।

এদিকে আমার খুব ইচ্ছা শেষবার তাঁর সাথে দেখা হবার পর, আমার যেসব কাব্যগ্রন্থ ও প্রবন্ধের বইটি বেরিয়েছে সেগুলো তাঁর হাতে পৌঁছে যাক। অবশেষে ২০২২ সালে আমার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ উপলক্ষে আমি যখন ঢাকা যাই, একুশের বইমেলা থেকে একজন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকের মাধ্যমে তাঁর ঠিকানা ও টেলিফোন পাই। বহু বছর পর ফোনে কথা হয়, স্মৃতিচারণা করি এবং ডাক মারফত আমার বইগুলো তাঁর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই। তিনি বইগুলোর প্রাপ্তি স্বীকার করেন এবং হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে যুক্ত করে নেন। দীর্ঘ বছরের বিচ্ছিন্নতা কেটে যায়, মাঝে মাঝে কথা হয় এবং বিভিন্ন সেমিনারে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতার লিংক পেতে থাকি।

সম্প্রতি তিনি অনেকগুলো বইয়ের প্রচ্ছদ পাঠিয়েছেন আমাকে, যেগুলো কলকাতা বইমেলা ২০২৩-এ প্রকাশিত হওয়ার কথা, অর্থাৎ এতদিনে তা আলোর মুখ দেখেছে বলে আমার বিশ্বাস। বইগুলোর শিরোনাম নির্দেশ করে এর বিষয়ব্যাপ্তি এবং গুরুত্ব। বইগুলো যথাক্রমে— মিখায়েল বাখতিন: দ্বিরালাপের নন্দন, সমকাল সাহিত্য ও সমাজ, স্বপ্নের সোভিয়েতে, নির্বাচিত কবিতা— প্রথম খণ্ড, ভাসো অনন্তের ভেলা এবং নয়ানজুলির জীবন। তাঁর ৬টি বইয়ের মধ্যে চতুর্থ এবং পঞ্চম বই দু'টি কবিতার। আমার আশ্চর্য হওয়ার পালা, কারণ এতকাল ধরে তাঁকে জেনে এসেছি একজন তুখোড় তাত্ত্বিক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে। কিন্তু তাঁর নির্বাচিত কবিতার বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়ে জানতে পারলাম তিনি নিয়মিত কবিতা লেখেন এবং এ পর্যন্ত তাঁর ৩৫টি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর হৃদয়াবেগের উৎস সম্পর্কে আমার যে কৌতূহল ছিল, তার উত্তর পেলাম।

তবে আরও যে-বিস্ময় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল সেটি হলো তাঁর 'নয়ানজুলির জীবন' নামের আত্মজীবনীমূলক বই। প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে তিনি পিছন ফিরে দেখছেন তাঁর জীবন পরিক্রমা। স্ক্যান করে আমাকে পাঠানো তাঁর বইয়ের সূচনাপর্ব 'কথামুখ'-এ তিনি মাঝে মাঝেই উচ্চারণ করেছেন কিছু কবিতার পঙক্তি, গানের কলি, নাটকের সংলাপ এবং পৌরাণিক গ্রন্থের বাণী যা তাঁর শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য-প্রৌঢ়ত্বের বিভিন্ন বাঁকে, বর্ণিল জীবনানুভবের সাথে মিশে আছে। রবীন্দ্রনাথ, বাউল শাহ আবদুল করিম, সোফোক্লিস ও ঋগ্বেদ থেকে উদ্ধৃত অমর সেসব শব্দাবলীর সাথে তিনি গেঁথেছেন আমার একটি কবিতা 'রূপান্তরবিধি'-র কিছু পঙক্তি যা কিনা আমার 'দ্বিমেরুযোজন' কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা সিরিজ 'বোধিনিরালার জল'-এর অন্তর্ভুক্ত। এর থেকে বড় প্রাপ্তি একজন কবির জন্য আর কি হতে পারে? এটা তো অনুরোধ-উপরোধ অথবা লাইনঘাট করে বড় লেখকের কাছ থেকে নিজের কবিতার ওপর লেখা আদায় করা নয়, বরং তাঁর সংবেদন-প্রজ্ঞা বাহিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হৃদয়-মনীষায় জায়গা করে নেওয়া।

আমি লিখলাম তপোধীরদাকে, "এক নিঃশ্বাসে আপনার নতুন বইয়ের পাঠানো কয়েকটি পৃষ্ঠা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে ফেললাম। অপূর্ব মায়া এবং প্রজ্ঞায় জড়াজড়ি করে লেখা পুরো বইটি হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। আপনার এই বইয়ে আমার একটি কবিতার অংশ বিশেষ স্থান পেয়েছে দেখে বিস্মিত এবং আনন্দিত হয়েছি।"

তিনি প্রত্যুত্তরে লিখলেন, "তোমার ঐ পঙক্তিগুলি অনিবার্যভাবে কলম নিয়ে এসেছে।"

অপেক্ষায় আছি কবে তপোধীরদার বইগুলো হাতে পাব এবং নিবিষ্ট মনে ডুব দিতে পারব মগ্ন পাঠে।

তপোধীর ভট্টাচার্যের 'নির্বাচিত কবিতা (প্রথম খণ্ড)'-এ তাঁর যে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি রয়েছে, সেটা পাঠকের সাথে শেয়ার করছি:
বাংলা গদ্যসাহিত্যের জীবন্তকিংবদন্তি সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাহিত্যতাত্ত্বিক ও সমালোচক অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য তাঁর মৌলিকতা ও ব্যাপক বিদ্যাবত্তার জন্যে অনন্য সুনাম অর্জন করেছেন। আন্তর্জাতিক সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যস্রষ্টাদের সম্পর্কে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নের নিদর্শন হিসেবে অজস্র বই ইতিমধ্যে প্রকাশিত। ইংরেজি ও বাংলা ভাষা ছাড়াও অসমিয়ায় তাঁর দুটি বই অনূদিত হয়েছে। বিশেষভাবে সাহিত্যতত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর নিরন্তর প্রকাশনা বাংলা সমালোচনা সাহিত্যে নতুন ধারার সূচনা করেছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাখতিন: তত্ত্ব ও প্রয়োগ, মিশেল ফুকো, জাক দেরিদা, রোলাঁ বার্ত, জাঁ বদ্রিলার, টেরি ঈগলটন, হ্যান্স গিয়র্গ গাদামা্র সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলি উল্লেখযোগ্য।

অধ্যাপক ভট্টাচার্য (জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯, শিলচর, ভারত) সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সমান স্বচ্ছন্দ এক কিংবদন্তি শিক্ষক ও গবেষক। তিনি গৌহাটি, উত্তরবঙ্গ, বর্ধমান ও আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। এছাড়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের মর্যাদাবান “রবীন্দ্র অধ্যাপক হিসেবে বৃত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বের নানা দেশে তুলনামূলক সাহিত্য ও সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন।

আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব শেষ হওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগ তাঁকে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ করেন। অধ্যাপক ভট্টাচার্য নিয়মিত কবিতা লেখেন। এখনও পর্যন্ত তাঁর ৩৫টি কবিতা সংকলন প্রকাশিত। শতক্রতু সাহিত্যপত্র সম্পাদনা করছেন বহু বছর ধরে । তিনি লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে চলেছেন। অধ্যাপক ভট্টাচার্য চলমান জীবন ও নান্দনিকতা এবং ভাবাদর্শ ও সামাজিক ইতিহাসের নিরন্তর দ্বিরালাপে চিরপ্রত্যয়ী।

আপনার মন্তব্য