দেব দুলাল গুহ

০৮ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ১২:৩৭

রমিজ রাজাদের মানসিকতা ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের হিসেব নিকেশ

রমিজ রাজা কী ভাবেন নিজেকে? কী ভাবেন আমাদেরকে? আমরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারি না? আমাদেরকে হেয় করতে চায়?  তিনি কি জানেন না, অনেক অনেক দিক থেকেই এই মুহূর্তে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে? তাঁরা তো স্কুলের কচি শিশুদেরকেই জীবনের নিরাপত্তা দিতে না পেরে উল্টো স্কুল বন্ধ করে দেন একের পর এক। যেন, পায়ের ব্যথা তাই পা-টাই কেটে ফেলো! আমরা সে তুলনায় অনেক ভালো আছি, থাকবো। তাহলে, কোন সাহসে রমিজ তামিমকে উর্দুতে কথা বলার ইঙ্গিত দেন? কে দিয়েছে তাঁকে এই স্পর্ধা? এমনকি 'বাংলা' শব্দটা উচ্চারণ না করে তিনি বললেন "your language"! তাঁর এটাও জানা উচিৎ ছিলো, তামিম ইংরেজি মাধ্যমেই পড়ালেখা করা ছেলে। পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের ক’জন ইংরেজি জানে? ক’জন অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পারে?

ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিৎ। কিছুটা হলেও এদের আক্কেল থাকা উচিৎ। বাংলাদেশ এখন এক ক্রিকেট পরাশক্তিরও নাম। ছেলেরা ভালো খেলছে, একের পর এক পরাশক্তিকে হোয়াইটওয়াশ করেছে। অনূর্ধ্ব ১৯ দল বিশ্বসেরা হবার দ্বারপ্রান্তে। এমন অবস্থায়, বাংলাদেশকে ছোট করার অপচেষ্টা মেনে নেয়া উচিৎ হবে না। আমরা বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি। যে উর্দুকে স্বীকার না করায় এত রক্ত বইলো, শহীদ মিনার হলো, সেই উর্দুতেই আমরা কথা বলি, এত বছর পরে? এটাই ওরা চায়?

আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। দ্বিতীয় কোন ভাষা হিসেবে বাইরে কথা বলতে হলে ইংরেজিই সই। তামিম সেটাই করেছেন। তবে পাকিস্তানের লিগে পাকিস্তানের একটি দলের হয়ে খেলাটা অনেকের চোখেই ভালো ঠেকেনি। যখন ওদের নিজেদের মাটিতে বাংলাদেশীদের যোগ্যতা (এক্ষেত্রে ইংরেজি বলার) নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখন সে প্রশ্ন আরও জোরালো হয়। তবে কী ওখানে খেলতে যাওয়া ভুল ছিল? যেখানে সাকিব একাই করাচিকে জেতালো, তামিমের অপরাজিত ৫৫ রানই জেতালো পেশোয়ার জালমিকে, সেখানে এ কেমন ব্যবহার? সাকিবকেও প্রথমে ম্যাচ সেরার পুরস্কার দিতে গিয়ে ঝামেলা পাকিয়েছে, মনে হয়েছে ইচ্ছা করেই। বাংলাদেশের কেউ ভালো করুক, এটা রমিজের ভালো লাগে না।  

ওরা আমাদের গর্বের ইতিহাসকে, ওদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার এবং এগিয়ে যাওয়াকে সহ্য করতে পারছে না বলেই বারবার কটাক্ষ করার চেষ্টা করছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। অনতিবিলম্বে রমিজ রাজার কাছে কৈফিয়ত দাবি করছি। আর তামিম ইকবালকে ধন্যবাদ, এমন সুন্দর করে অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে রমিজের মুখে কালি লেপনের জন্য।


স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি খুব স্পষ্ট। বাংলাদেশ সবার সাথে বন্ধুত্ব এবং কারো সাথে শত্রুতা নয়- এই নীতিতে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ অন্য কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনা এবং অন্য কোন দেশও বাংলাদেশের একান্তই নিজস্ব বিষয়গুলোতে অযথা নাক না গলাক -এমনটাই বাংলাদেশের কামনা। আমরা শত্রুতা নয়, বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই।

কিন্তু, আমরা শান্তি চাইলে কি হবে? গায়ে পরে কেউ ঝগড়া করতে এলে, সমুচিত জবাব দেয়াটা তখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে লাল কালির দাগে লেখা আছে একটি দেশের নাম। এই দেশটির অংশ ছিলাম একসময় আমরা, ভাবতেই অনেক সময় ঘৃণা হয়।

অনেকভাবেই একাত্তর-পূর্ব সময়ে ওরা দাবিয়ে রাখতে চেয়েছে আমাদের। এমনকি সংখ্যায় আমরা বেশি হলেও, আমাদের অধিকার ওরা রক্ষা করেনি, বঞ্চিত করেছে সকল ক্ষেত্রে। দমন-নিপীড়ন-শোষণ ছিলো আমাদের নিত্য সহচর। এমনকি নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও আমাদের সরকার গঠন করতে দেয়নি। ২৫ মার্চ চালিয়েছে গণহত্যা। বীর বাঙালি অস্ত্র ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে ঠিকই, কিন্তু ওদের হিংসা, আমাদের এগিয়ে যাওয়া দেখে ভেতরে ভেতরে জ্বলে-পুড়ে মরা এখনও কমেনি। আমরা যখন এগিয়ে যাচ্ছি, দিনকে দিন সকল ক্ষেত্রে ওদেরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি, তখন ওদের দেশে এখনও স্কুলের নিরীহ শিশুদের ওপর জঙ্গি হামলা হয়। আমাদের এই উন্নতি ওদের সহ্য হয়না। একাত্তরে হানাদারদের দোসরদের আমরা শাস্তি দেই -এটাও ওদের ভালো লাগেনা।

লাগবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এটা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায়ের বাস্তবায়ন। এ নিয়ে অন্য কারও কোন ধরণের উস্কানিমূলক মন্তব্য গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসার সামিল। শুধু কি তাই? বাংলাদেশে পাকিস্তানের হাইকমিশনার এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এদেশে জঙ্গি মদদদানের এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টার প্রমাণ মিলেছে। সাহসী ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশ তাঁকে সেদেশে ফেরতও পাঠিয়েছে। পাকিস্তান অতীত ভুলে নতুন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে, বিষয়টিকে ভালোভাবে নিতো। কিন্তু তারা উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখলো।

বাংলাদেশেরও এক কর্মকর্তাকে বিনা কারণে অব্যাহতির জন্য বললো। কূটনৈতিক স্বার্থে আমরা সে দাবি মেনে নিয়ে তাঁকে অন্যত্র সরিয়ে নিলাম। কিন্তু সম্প্রতি দুই দেশের হাইকমিশনের কর্মীদের পাল্টাপাল্টি আটক ও পরে ছেড়ে দেয়ার ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্ক একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়টি এখনও নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে, ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকও এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এখানে 'সম্পর্ক' কথাটা কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তা বুঝতে হবে। দুই ধরণের সম্পর্ক হয়- ভালো অথবা খারাপ। নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, এতকিছুর পরেও কি পাকিস্তানের সাথে আমাদের সম্পর্ক কি না রাখলেই নয়? পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিচক্ষণ জবাব দিয়েছেন। আপাতত সম্পর্কচ্ছেদের কথা ভাবছেন না জানিয়ে তিনি যুক্তি দিয়েছেন, এমনকি যুদ্ধের সময়েও দুটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক টিকে থাকে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যেও ‘সম্পর্ক’ টিকে আছে।

আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ ব্যক্তি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও এসব ব্যাপারে সচেতন। কূটনৈতিক সমস্যা তাঁরা কূটনৈতিকভাবেই দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করবেন বলে বিশ্বাস করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয়ই উচিৎ কাজটিই করবেন। যদিও পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে দূতাবাস না থাকলেও হয়তো কিছু যায় আসে না, তবুও ‘সম্পর্ক’টা আপাতত রাখা যায়। একাত্তরের গণহত্যার জন্য ওরা আজও ক্ষমা চায়নি। একাত্তর এবং তার পূর্বের সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের যে পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি ওরা করেছে, তার কিছুই এখনো পরিশোধ করেনি। ‘সম্পর্ক’ না থাকলে এর কোনটাই আদায় করা হয়তো সম্ভব হবে না।

তাই, আমি মনে করি, ‘সম্পর্ক’ অবশ্যই থাকবে। ক্ষতিপূরণ আদায় এবং ওদের ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি নিয়ে আমরা আরও এগিয়ে যাবো। সম্ভব হলে যুদ্ধাপরাধীর মতো হানাদারদের বিচারও করা হবে, হোক সেটা প্রতীকী। তবে, ‘সম্পর্ক’ এর ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকা চাই।  

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত