এম. গোলাম মোস্তফা ভূইয়া

০৮ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ২১:২৭

কাগমারী সম্মেলন বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা

ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের ৫৯তম বার্ষিকী

মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মসূচীর আয়োজন করেছিলেন, এর মধ্যে তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি এবং উপ-মহাদেশের তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে ১৯৫৭ সালের ‘কাগমারী সম্মেলন’। উপ-মহাদেশ ও পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর তাৎপর্য অনাগত কালের গবেষকদের কাছে স্বীকৃত।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা মধ্যে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিনদিন ব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় রূপমহল সিনেমা হলে। এই অধিবেশনে বলা হয়েছিল-“...... পাকিস্তান সরকারের গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হইয়াছে, যে সব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হইয়াছে।” ৫৬-র ১৯-২০ মে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনেও যুদ্ধজোটের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেয়া হয়। তাতে বলা হয়, “কোনো বৈদেশিক শক্তির লেজুড়”-হিসাবে না থেকে পাকিস্তান সরকারের উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। এই জাতীয় প্রস্তাব আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার বিতৃষ্ণার কারণ হয় এবং মওলানা ভাসানী হন তাদের বিরাগভাজন।

দুটি প্রধান প্রধান বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতপার্থক্য শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য বিরোধে পর্যবসিত হয়, যার একটি অবহেলিত শোষিত পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আর অপরটি সকল সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ। এই দুটি বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আপোষ প্রবণ ও নমনীয় পক্ষান্তরের ও মওলানা ভাসানী ছিলেন অনড় ও আপোষহীন। অবশ্য এই দুটি বিষয় কোন ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, এগুলো ছিল আওয়ামী লীগেরই নীতি। দলের দুই প্রধান নেতার মধ্যে যখন মতবিরোধ চরমে তখনই মওলানা ভাসানী দলীয় প্রধান হিসাবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারী। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যখন কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেছেন তখন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও পূর্বপাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল।

তদুপরি ঐসময়ে বৈদেশিক নীতি বিশেষ করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদন ও সামরিক চুক্তি সম্পাদন সমূহ তথা ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সামরিক চুক্তি’ ও ‘বাগদাদ চুক্তি’ সংস্থার সদস্য ভুক্তির প্রশ্নে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মত দ্বৈততার চরম আকার ধারণ করেছিল বলে কাগমারী সম্মেলনটির বিশেষ গুরুত্ব দেখা দিয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে মতবিরোধ নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে কাগমারী সম্মেলনের ঘোষণা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর অন্তরে আতংক সৃষ্টি করেছিল। কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক কাম রাজনৈতিক সম্মেলনে রূপ নেয়। এই সম্মেলনকে ঘিরে যেমন পাকিস্তানী ‘দর্শনে’র সমর্থকরা বিরূপ সমালোচনায় মুখর ছিলো, তেমনই আওয়ামী লীগের মুখপাত্র বলে পরিচিত এবং প্রকৃত প্রস্তাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিত্বের সমর্থক পত্র-পত্রিকাগুলোও কাগমারী সম্মেলনকে সুনজরে দেখেনি, বরং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিরূপ সমালোচনা করেছিল। উল্লেখ্য যে, কাগমারী সম্মেলনের মাত্র স্বল্প সময়ের মাথায় আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অপসারণ এবং সবশেষ ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ও সামরিক শাসন জারির মত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এসব কারণেই স্বাধীন জাতি রূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি ভিত ভূমি নির্মাণে কাগমারী সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষে উপলক্ষে ১৯৫৭ সালের ১৩জানুয়ারী পূর্ব বাংলার গরীব চাষি, মজুর, ছাত্র, যুবক ও জনসাধারণের প্রতি এক আবেদনে মওলানা ভাসানী বলেন - “এদেশে শুধু মন্ত্রী, মেম্বার, সরকারী কর্মচারীদের নহে এদেশ অগণিত জনসাধারণের দেশ। যাহারা এদেশ পরিচালিত করেন, তাহারা শতকরা ৯৫ জন গরীব চাষি, মজুর,কামার, কুমার প্রভৃতি শ্রেণীর জনসাধারণের টাকা দিয়াই চলে। ............ পূর্ব বাংলার বাঁচার দাবী পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের দাবী এবং ২১দফার বাকী ১৪দফা দাবী পূরণের জন্য বিচ্ছিন্ন জনশক্তিকে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করিয়া তুমুল আন্দোলন গড়িয়া তুলিতে হবে।  

দেশের নানাবিধ সমস্যার সমাধানের উপায় উদ্ভাবন এবং আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমি আগামী ৭ ফেব্রুয়ারী হইতে সপ্তাহব্যাপী সনোতাষ কাগমারীতে এক বিরাট সম্মেলন আহ্বান করিয়াছি। দল-মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উক্ত সম্মেলনে যোগদান করিয়া জনগণের দাবী আদায়ের আন্দোলন জোরদার করুন।”

  • ৩ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আর একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়-
  • সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবী আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক,
  • ঐতিহাসিক ২১দফা আদায়ের ডাকা,
  • চাষি-মজুর, কামার-কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সকল শ্রেণীর মিলনের ডাকা,
  • পূর্ব বাংলার ৬০হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ডাক,
  • ২১দফার পূর্ণ রুপায়নের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। ইহা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত হইতে মুক্তির মহান সনদ, ইহা যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই। ---মওলানা ভাসানী

তখন তাঁর দল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং আতউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তখন এই বক্তব্য দিয়ে একটি মহাসম্মেলনের আয়োজন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং সহজবোধ্যও বটে। কাগমারী সম্মেলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান-সহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রী সভার প্রায় সকল মন্ত্রীই যোগ দিয়েছিলেন। কাগমারী সম্মেলন সফল করতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে প্রস্তুতি কমিটি গঠন হয়েছিল তার অন্যতম সদস্যরা হলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান, কাজী মোঃ ইদরীস, ফকির সাহবুদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সদর ইস্পাহানী, আবু জাফর শামসুদ্দিন। সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এই সম্মেলন উপলক্ষে টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় ৫কিলো মিটার রাস্তায় যে অসংখ্য তোরণ নির্মিত হয়েছিল। আবার সেই তোরণগুলির নামকরণ করা হয়েছিল বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) থেকে শুরু করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং ব্রিটিশ বিরোধী উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশ গ্রহণকারী নেতাদের নামে। উল্লেখযোগ্য তোরণগুলোর নাম হলো হযরত মোহাম্মদ (সা:) তোরণ, মহাত্মা গান্ধী তোরণ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, কাজী নজরুল ইসলাম, মহাকবি ইকবাল, নেতাজী সুভাস বোস, হাজী শরিয়তউল্লাহ, শহীদ তিতুমির, পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু, হাজী মোহাম্মদ মহসীন, সি.আর.দাস, লেলিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুং, ওয়ার্ড ওয়ার্থ, বায়রন, শেলী, মাওলানা রুমী, হযরত ঈমাম আবু হানিফা, হযরত ঈমাম গাজ্জালী এভাবে ৫১টি তোরণের নাম করণ করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সর্বশেষ তোরণটি ছিল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তোরণ।

এই সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র নায়কদের। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন-ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্নো অথবা তার প্রতিনিধি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও বৃটেনের বিরোধী দলের নেতা। জহরলাল নেহেরু, বিধান চন্দ্র রায় ও জামাল আবদুল নাসের চিঠি দিয়ে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে মওলানা ভাসানীকে ব্যক্তিগত চিঠি দিয়েছিলেন। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে তাঁর সুপরিচিত ও সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। ঐ ‘আসসালামু আলাইকুম’-এর তাৎপর্য উপস্থিত শ্রোতা যাদের মতে, “বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবী এবং তার জন্যে প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প ঐ ‘আসসালামু আলাইকুম’ ধ্বনির মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল।” সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্যে মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দ‘ধরনের বক্তব্যই রেখেছিলেন। উপ-মহাদেশের হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপরও দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলেও সামরিক-বেসামরিক চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্য নীতি পালিত না হইলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলিবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে। ৮ ফেব্রুয়ারী মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. কাজী মোতাহের হোসেন।

কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইল ফলক-বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের সময় মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল-কাগমারী সড়কের নাম দিয়েছিলেন বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা সড়ক। এ নামকরণ যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তা আলোচনার প্রয়োজন নেই। কাগমারী সম্মেলনে অধিবেশনের আলোচনা ও প্রস্তাবসমূহ সর্বসম্মত না হলেও সাংস্কৃতিক সম্মেলনটি সুচারু রূপে সমাপ্ত হয়। এই সম্মেলনের পর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও তার সমর্থিত নেতা কর্মীদের আওয়ামী লীগের সাথে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠে।

প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং তাদের সহকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে নীতির প্রশ্নে আপোষের কোন সুযোগ ছিল না। তাঁরা বলেছিলেন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন হয়েই গেছে এবং মার্কিনপন্থী জোট ভুক্ত পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিলেও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনীহা ছিল। আর অন্যদিকে এসব প্রশ্নে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন অবিচল ও আপোষহীন। তিনি তাঁর মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তবে দল ত্যাগের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোন উচ্চবাচ্য করেননি। যে দলটির তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাই নন-আপ্রাণ চেষ্টায় দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, যে দলটির পতাকার নিচে সমবেত করেছেন দেশের সকল এলাকার সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে, যে দলটি কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি স্বত্বেও পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কিছু প্রগতিশীল কাজও করেছে, যে দলের প্রধান তিনি, সেই দল পরিত্যাগ করার মুহূর্তে তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়ে ছিলেন বটে, কিন্তু আদর্শের ও নীতির সঙ্গে আপোষ করা তাঁ পক্ষে সম্ভব ছিলো না।  

কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর কঠোর ভাষণ এবং তাঁর ‘আসসালামু আলাইকুম’ যে বিতর্কের সূচনা করে তাতে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও বটে, বিব্রত হন, পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে তিনি মওলানা ভাসানীর সমর্থনে একটি নমনীয় বিবৃতিও প্রদান করেন, যা ৫৭-র ১৬ ফেব্রুয়ারী দেশের সমস্ত পত্র-পত্রিকার প্রকাশিত হয়। কাগমারী সম্মেলন মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবী তুললেন পক্ষান্তরে সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে সলিমুল্লাহ হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন যে-পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮% স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে। এই নিয়ে দুই দল ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারিও হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় বামপন্থীদের সাথে একটি বোঝা পড়ার চেষ্টা চালান, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ১৯৫৫ সালের মে অধিবেশনের প্রস্তাবাবলী যেমন পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি, বাগদাদ চুক্তি বাতিলের দাবী ইত্যাদি নিয়ে সে সভায় দীর্ঘ আলোচনা চলে। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তাঁর সমর্থকদের মার্কিন ঘেঁষা ও পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ও তাঁর অনুগতরা অবিচল থাকেন। উভয় পক্ষই তাদের এই অনমনীয় মনোভাবের পরিণতি কি তাও তাঁরার জানতেন। তবুও আদর্শগত অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

সম্মেলনের পর ২৬মার্চ ১৯৫৭ মওলানা ভাসানী একটি প্রচারপত্র বিলি করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লীগ কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আবেদন’- “ভাইসব, উভয় পাকিস্তানের সংহতি ও মিলন নির্ভর করে একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের উপর। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ব্যতীত সাড়ে চার কোটি বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সমাজ জীবনে মুক্তি অসম্ভব। ..................... গদির মোহে মুসলিম লীগের সহিত হাত মিলাইয়া সাড়ে চার কোটি বাঙালিকে চিরকালের জন্য কৃতদাস বানাইতে, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসনের দাবী বিসর্জন দিয়া পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পাশ করিয়া ছিল, তাহারাই পুনরায় সাম্রাজ্যবাদী ও কোটিপতি শোষকদের সহিত হাত মিলাইয়া বর্তমানে আমার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিবৃতি, পোষ্টার, বিজ্ঞাপন ছড়াইয়া সারা দেশময় মিথ্যা প্রচার শুরু করিয়াছে। এসব কুচক্রিদের দেশবাসী ভাল করিয়াই চিনে। তাহারাইগত ৯ বছর ধরিয়া পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলিয়া দিয়াছে।”

কাগমারী সম্মেলনের পরই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং এক পর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং আওয়ামী লীগের ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে জনমত প্রতিষ্ঠা ও পাকিস্তানের মেহনতি জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহলে নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ।

ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করতে এই সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। কাগমারী সম্মেলনে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে গুরুত্বপূর্ণ ও জ্বালাময়ী বক্তব্য রেখেছিলেন তা আজো আমাদের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, পতাকা-মানচিত্র রক্ষার সংগ্রামে এবং সাম্রাজ্যবাদ-আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে ও লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা যোগায়।  

শেষ করতে চাই এইভাবে যে, বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তুলতে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী যে অবদান রেখেছেন-যে সম্মানী তিনি প্রাপ্য ছিলেন স্বাধীনতার ৪৫ বছরের সরকারগুলো তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের প্রয়োজনে মওলানা ভাসানীকে ব্যবহার করলেও প্রকৃত অর্থে তাকে তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার কোন কর্মসূচীই গ্রহণ করেনি। নিরপেক্ষ চিন্তায় অবশ্যই তিনি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী।

এম. গোলাম মোস্তফা ভূইয়া : রাজনীতিবিদ, কলামনিস্ট ও মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য লেখকের নিজস্ব। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত, মন্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য

আলোচিত