অরূপ চক্রবর্তী

২৭ ফেব্রুয়ারি , ২০১৬ ০৩:১৫

তবু এক দীপ্তি রয়ে গেছে

এই মৃতের শহর, যাকে আমরা ডাকি, ঢাকা। ঢেকে যাই মুখোশে, যেমন মুখোশে রোজ ঢেকে ফেলতে হয় আমাদের লজ্জা আর দুঃখগুলো। হয়ত এ শহর এমন ছিল না। এখন মনে হয় সেসব বহু আগের কথা, অনেক চিহ্ন চিন্তা রীতি ক্ষয় হয়ে গেছে এরই মধ্যে, যেভাবে একটা পৃথিবী মরুময় হওয়া এড়াতে পারে না হয়ত মানুষও তাই।

প্রায় পাঁচ-ছয় বছর আগের একটা ছেলের কথা মনে পড়ছে। ভীষণ লাইভলি যার তখনও ডিজায়ার, নিজেই মাঝে মাঝে তার মনে হয় এত তীব্র এই জীবন। এই শহরটাকে তখন যার মনে হয় নিয়নের শহর, এক হলুদ বন্ধু। এই প্রকৃতি, মহাবিশ্বের দিকে অনিচ্ছুক দৃষ্টি মেলে রাখা চোখ, তাকাচ্ছে চারদিক আরো একটু ভাল করে। নতুন নতুন পরিচয় ইন্টারনেট ফেসবুক, এসব সমুদ্রের সাথে। শব্দ তখন তার ঝলমলিয়ে আসে। শব্দের হাহাকারহীন সময়ে, বেঁচে থাকা যেন স্বতঃই সুন্দর। বিবিধ সমুদ্রের অগণিত আলোড়নের মধ্যে একটা বিচ্ছিন্ন ঢেউ এসে ঝাপটে দিল একদিন চোখমুখ; সংশয়।

যে কথাগুলো ধীরে ধীরে একটা কিশোরের চোখকে বলছিল,মহাবিশ্ব ধারণাতীতভাবে অন্ধকার। এখানে শাশ্বত আলো খোঁজার চেষ্টা বৃথা। আমি মনে মনে কল্পনা করতে পারি তার একাকী দিনগুলোর কথা, পরিচিত পৃথিবীর সাথে সংঘাতের ইতিহাস, লেখা হচ্ছে অনেকটাই সংগোপনে। এই অন্তর্দীপ্তির ইতিহাসে, যে লোকটা, যার লেখাগুলো উসকে দিচ্ছে মস্তিষ্কের গ্রে-সেলগুলোকে তিনি,অভিজিৎ রায়। সর্বোপরি 'অবিশ্বাসের দর্শন' বইটার কয়েকটা পিডিএফ চ্যাপ্টার। পৃথিবী ফুটে উঠছিল কুয়াশার অন্যপাশে, যেভাবে আকাশ উঠে আসে অন্ধকার থেকে।সমুদ্রের অন্তর্নিহিত আলোড়নে যেরকম স্থির থাকে না কিছুই, তেমনি। তবু মন ভরে আছে তার কোন এক কিশোরীর মুখে, আর মনন এক অন্য দীপ্তিতে। সময়টা ছিল এরকমই অদ্বিতীয়, হয়ত অনিবার্য।

২০১২। এরই মধ্যে পরিচয় হবে, কিশোরের অভিজিৎ রায়ের সাথে, ফেসবুকে। তর্ক জমবে আশেপাশের সহপাঠীদের সাথে। ফেসবুকে সে দেখবে, তর্কের লোক নেহাৎ কম না। রায়হান দা বলবেন, ওহে মূঢ় বালক, বইমেলা পর্যন্ত ওয়েট করো হে, বইখানি তোমাকে অটোগ্রাফসমেত গিফট করিব। কিশোর অতঃপর ভাববে, সবই 'গুল'দস্তি হয়ত, এবং সত্যি সত্যি যেদিন বইমেলায়, বইখানা অটোগ্রাফ সমেত বগলদাবা করবে, তখন সে উদ্বেলিত হয়ে রায়হানদা কে বলবে, চলেন ঘুরি। তখন সে শুনবে, অভিজিৎদা আসতেছেন এইবার। তখন সে খাসাও বলতে পারে চমৎকারও বলতে পারে। এই লোকটির সাথে সাক্ষাতের ভাবী তাড়নায় আরেকটু উদ্বেলিত হয়েও উঠতে পারে।

দিনটা কবে ছিল মনে নাই।১৫/১৬/১৭/২১।কোন এক বিকালবেলা, আমি প্রথম অভিজিৎ দা কে দেখি শুদ্ধস্বরের স্টলের সামনে, আরো কিছু লোক পরিবৃত হয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। আর তার সিগনেচার হাসি।আমি উশখুশ করছি, বই দেখতেছি। একসময় ভিড়টা একটু আলগা হলে তাকে বললাম, আপনাকে আমি চিনি। তিনি বোধহয় রহস্য করলেন, এ পৃথিবীতে কে কারে চিনতে পারে? আর সেই হাসি। তারপর আমি বললাম আমি এরকম হ্যানত্যান এবং কেউ না, ইত্যাদি। ওখানে সম্ভবত তখন ছিলেন আর দুজন জনাব ফারসীম মান্নান আর লেখক শাখাওয়াৎ নয়ন।

কিছু সাধারণ আলাপের পর, আমি হয়ত বললাম, আমি কি পারি আপনাদের সাথে ঘুরতে। 'শিওর শিওর, চলেন যাই' এরকম কিছু হয়ত বললেন। তারপর দু তিনঘণ্টার ঘোরাঘুরি। এর মধ্যেই স্কুল কলেজ পড়াশোনা বিষয়ক আলাপ চলেছে। এভাবেই হয়ত আরোকিছু, অন্যভাবে অন্যরকম। চা এবং সিঙ্গারার সন্ধ্যা। সেবার, 'ভালোবাসা কারে কয়' বের হয়েছে। কিন্তু আমার আর পয়সা নাই। বললাম, পরেরবার অইটা কিনব। টাকা শেষ এইবার। তিনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, 'আচ্ছা, তোমাকে বইটা আমি দিব।' আমি সত্যি ভীষণই অবাক হয়েছিলাম। একটা ছেলে, যার সাথে কোনই আলাপ নাই। এত সহজে কীভাবে বলা যায়? যদিও স্টল বন্ধ হয়ে গেছিল তখন। বইটা ওইদিন আর হয় নি। আমাকে বললেন, তাহলে পরেরদিন। আমার ঘোর তখনো চলছে। আমি বোঝার চেষ্টা করছি, কী হচ্ছে এসব।

একসময় সবাইই চলে গেলেন। শুধু আমি আর অভিজিৎ দা। তিনি সিদ্ধেশ্বরী যাবেন, আমি মোহাম্মদপুর। শাহবাগ থেকে বাস বা রিকশা দুজনের। বাংলা একাডেমি থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ধাক্কার জায়গাটা কী ছিল? আমি বললাম, বিজ্ঞানবিষয়ক ধর্মীয় পরস্পরবিরোধী ভার্সগুলো। যা আগে কখনো দেখার ইচ্ছা হয় নি।এইসব। তাকে কলেজের এক বিজ্ঞানশিক্ষকের কথা বললাম, যিনি ক্ষণে ক্ষণে ঐশীবাণীতে নীত হন। তখন তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছিলেন বিজ্ঞানমনস্কতা আর বিজ্ঞান জানা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবং কীভাবে সেটাও। এরকমভাবে বলার ছলে বুঝিয়েছিলেন অনেককিছুই। আমি একসময় তাকে বললাম, এক বন্ধুর কথা, যে তার বইটা পড়ে বলেছিল, ইনি এখনো চাপাতি খান নাই! তিনি হাসছিলেন। সেই, যে অকৃত্রিম হাসিটা লেপ্টে আছে তার প্রায় সব ফটোগ্রাফে। কাকতালীয়ভাবে আমরা তখন ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে তিনবছর পর তার ঘাড়ে চাপাতি পড়বে, মগজ লেপ্টে থাকবে, ধূসর কংক্রিটে, যেন এক বিষাদ রাগ অস্তিত্ব পেয়েছে মৃত সূর্যের সরোদে। আর ভূতের মত এই স্মৃতি ফিরে আসবে সেদিন, যে ভুল হয়ে যাওয়া তারিখটা আমার ভীষণ আহ্লাদের, প্রার্থনার।

অই দিনটা ছাব্বিশ তারিখ ছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম পঁচিশ। পঁচিশে আমি খুঁজে ফিরি কমলা রোদ, একটা বিকেলের রঙ ধরার চেষ্টা করি। এরকম বিকেলযাপন শেষে যখন বাসায় ফিরেছি। মা ফোন করে জানালেন। আমি ভাল শুনতে পাচ্ছিলাম না। টিভি খুলে মুখ শাদা হয়ে গেল। কোথায়? ওখানে। কোনখানে? ওখানে। কিছুক্ষণ পর, নেই। অনেকক্ষণ বুঝতেই পারছিলাম না। আমি বসেছিলাম অন্ধকারে, ঘরে। অন্ধকারই তো ভাল, অন্ধকার ছাড়া চোখ আর কী পারে ধারণ করতে। ...'অই মিয়া, যোগাযোগ রাইখো, দেখা তো আর হইল না'...

এসব হয়ত কাউকে বলার নয়। শুধুই নিজের স্মৃতিতে গোপন করে রেখে দেবার। তবু,স্মৃতিও তো ভীষণ প্রতারক। যারা তাকে চিনতেন, তাদের রিফ্লেকশনের বিস্তৃতি হয়ত বিভিন্নরকম। কিন্তু কেউই হয়ত সেই বোধটা বুঝবেন না, একটা কাকতালীয় চাপাতি-কথন আমার স্মৃতিতে কতটা জ্বলজ্বলে। আমি কোনদিনই ভুলব না, ঠিক অই জায়গাতেই, তার সাথে এই আলাপটুকু হয়েছিল। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারব না, তার হাসিটা তখন কতখানি অমলিন ছিল। যার কাছে লেখা ছিল অন্তত সহস্র চাপাতি-ভয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যিনি হয়ত এরকম আমার মত, আরো কত কত মনে না রাখার মানুষদের কাছে রেখে গেছেন তার সহজ সঙ্গতার স্মৃতি। এবং এই স্মৃতিবিষাদের অবসর এখন শুধুই হয়ত বিষণ্ণতার।জীবনে ফুরিয়ে গেছে আরো একটা বছর। মানুষের জীবন রয়ে গেছে একইরকম। হয়ত একটা শহর হয়েছে মৃত্যুমুখী। মিস্টার ক্রিডিরা হয়ত আরো রক্ত ছোটাবেন শরীর থেকে, কিন্তু বারবার এখানেই ভুল হয়ে যাবে। তারা বারবার ভুলে যান, আইডিয়া ইজ বুলেটপ্রুফ। যেরকম করে, এক অচেনা কিশোর, তার একাকী বিকেলগুলো থেকে খুঁজে পেয়েছিল কিছু বিপ্রতীপ ভাবনার আকাশ। সেরকম কিশোর হয়ত এখনো আছে, কোথাও না কোথাও, তারা আকাশটা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছে, আপনার মধ্যে দিয়ে। আপনিও হয়ত সেখানে আছেন, হে আঁধারের পথিক।

অন্ধকারে ইতিহাসপুরুষের সপ্রতিভ আঘাতের মত মনে হয়
যতই শান্তিতে স্থির হয়ে যেতে চাই
কোথাও আঘাত ছাড়া --তবুও আঘাত ছাড়া অগ্রসর সূর্যালোক নেই।

অরূপ চক্রবর্তী :  শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত