কয়েছ আহমদ বকুল

০৪ মে, ২০১৬ ০১:১২

রবিশঙ্কর মৈত্রীকে ফিরতে দাও

পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো সরল ও সৎ মানুষগুলোকে আপাতদৃষ্টিতে বোকা মনে হয়। রবিশঙ্কর মৈত্রী, কবিতার মানুষ, কবিতা আবৃত্তির মানুষ, মন ও মগজে আদিঅন্ত বাঙালি এই মানুষটি তাদেরই একজন।

দুর্ভাগ্যের নির্মম শোষণপিষ্ট এই মানুষটি আমাদের অনেকের মতোই আজ দেশ ছাড়া, সপরিবারে গৃহত্যাগী, ফরাসী রাষ্ট্রে আশ্রয়প্রার্থী। কিন্তু মন তাঁর বাঁধা পড়ে আছে পলাশ শিমুলের বনে, সেই দূর উজানে।

রবিশঙ্কর মৈত্রী কেন এমন? আমি মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই। এতো কিছুর পর, তার বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়ে যাওয়া এতোগুলো অন্যায়ের পরও দৃপ্ত সরল সহজ উচ্চারণে কিভাবে মানুষটি বলতে পারেন 'আমি দেশে ফিরবই'। আমার দেশ, আমাদের প্রাণের স্বদেশ বাংলাদেশ আজকের এই ক্লীষ্টকরুণ সময়ে রবিশঙ্কর মৈত্রীর মতো মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কত বেশী অনুপযোগী হয়ে উঠেছে রবিদা তা বুঝেন না কেন? কেউ কি নেই এই মানুষটিকে এই সত্যটি উপলব্ধি করতে শেখায় হাতের মুঠো ফসকে আমাদের লাল সবুজ এখন পরাগত নীলের দিকে ছুটে চলা এক অশুদ্ধ অন্যায়ের নাম।

রবিদা আমার প্রিয় মানুষ, শ্রদ্ধার মানুষ। বাংলাসাহিত্য সংস্কৃতির এই সময়ের প্রবল সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাবান এই মানুষটি কেবল কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ীর অশুভ আক্রোশ ও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় আক্রান্ত হয়ে এক সময় নানা রকম হত্যার হুমকিতে বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়েন। দাদার এই দেশ ছাড়া নিয়ে অনেকে অনেক ভাবে মন্তব্য করতে পারেন বা করেছেন কিন্তু আমার বিবেচনায় সেটা ছিলো নিজেকে নিজের পরিবার ও নিজের সাহিত্য সাংস্কৃতিক মানসিকতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত। অন্তত ঠিক সেই সময়টাতে সাংবাদিক প্রবীর শিকদারের জেলে যাওয়া ও নাটকীয় মুক্তিলাভ অতঃপর তাঁর বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলাগুলো বহাল তবিয়তে থেকে যাওয়াকে যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা মেনে নিতে বাধ্য বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক, আবৃত্তিকার হয়েও প্রাণ ও পরিবার বাঁচানোর উদ্দেশ্যে সেই সময়ে রবিদার দেশ ছাড়া কোন ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো না।

দেশ ছেড়েও খুব শান্তিতে থাকতে পারেননি মানুষটি। প্রিয় স্বদেশ প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে এসে একটা মানসিক ক্লেশের মধ্যে তো ছিলেনই, হুট করে তাঁর স্ত্রী সুস্থ মানুষ নীলু মৈত্রীর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়া একটা শক্ত ঝাঁকুনি দেয় তাঁকে। এতো খারাপ সময়েও নিজের ভেতরকার রবিশঙ্কর মৈত্রীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তিনি, বইমেলা ২০১৬ তে এসেছে তাঁর বেশ কয়টি বই। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য 'মনভাসির টান' নিয়ে শিল্প সাহিত্যের নগরী প্যারিসে একটি অনুষ্ঠানে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয় প্রিয় মানুষটিকে। লেখা পড়ে আবৃত্তি শুনে চেনা এই মানুষটির ভেতরের আগুন দেখে আসলেই কেবল চোখ মুছে দূরে সরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।

রবিদার সাথে আসলে কী হয়েছিলো, ঠিক কী কারণে তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন এখানে খুব ভালো করে হয়তো আমি লিখতে পারবো না। শুধু এটুকু বলতে পারি 'গান বাংলা' টিভি চ্যানেলের মালিকানা নিয়ে প্রভাবশালীদের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হয় উনার। ক্ষমতাসীনদের প্রচ্ছন্ন ক্ষমতার ব্যবহারে 'গানবাংলা' হাতছাড়া হয় রবিদার। বিষয়টা এখানে থেমে থাকলে হয়তো উদ্বাস্তু হয়ে নিজের দেশে ফিরে যাবার আকুল প্রার্থনায় আজ এভাবে চিৎকার করে করে কাঁদতে হতো না উনাকে। 'গানবাংলা' কেড়ে নিয়ে ষড়যন্ত্রমুলক মামলায় জর্জরিত করা হয় তাঁকে। মিথ্যা মামলার পাশাপাশি চলে নিশ্চিহ্ন করে দেবার পাঁয়তারা। সর্বস্বান্ত রবিদা দেশ ছাড়েন, বাধ্য হোন এক সময়ে একমাত্র মেয়েটির কথা ভাবতে, পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতা তাঁকে যাযাবর বানিয়ে দেয়।

রবিদা, রবিশঙ্কর মৈত্রী ফ্রান্সে আছেন। জীবন ধারণের শতভাগ নিশ্চয়তার মধ্যে আছেন তিনিও তাঁর পরিবার, তাঁকে এখানে একটি ভাল বাড়ি দেয়া হয়েছে, একটি উন্নত অত্যাধুনিক হাসপাতালে চলছে বৌদির চিকিৎসা, মেয়ে পড়ছে একটি ভালো স্কুলে। অন্য অনেকের জন্য এই ভালো থাকাটাকে রবিদা ভালো থাকা বলেননা, মানেননা। একটি পরিস্থিতির শিকার হয়ে দেশ ছাড়া এই মানুষটির অন্তর মনে কেবল লাল সবুজ, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ব্যাপ্ত আকাশটার বাহিরের পৃথিবীতে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসে। তিনি দেশে ফিরতে চান। না, 'গান বাংলা' নিয়ে আর কোন আগ্রহ নেই তাঁর। এমন কি আমার সাথের ৫/৬ মাস আগের এক আলাপচারিতায় দ্বিধাহীন বলেছেন মানুষটি তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির সবটুকু সরকার সংশ্লিষ্ট ঐ লোভী চক্রকে দিয়ে হলেও তিনি দেশে ফিরতে চান। নির্ভেজাল নির্বিঘ্ন একটি সুন্দর জীবন পেতে চান তিনি বাংলাদেশে।

রবিদা যখন দেশে ফিরে যাবার আকুল কান্নায় মেতে ঠিক তখনই তাঁর প্রিয় স্বদেশের একটি আদালত তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করে। কোথায় ফিরবেন রবিদা, কার জন্যে ফিরবেন! জেলে যাবার জন্য ফিরবেন নাকি ক্রসফায়ারে নিহত হবার জন্য! নাকি ঐ দুষ্টচক্রের প্ররোচিত চাপাতির নীচে গলা ঢেলে দেবার জন্য তাঁর এই ফিরে যাবার বাসনা?

রবিশঙ্কর মৈত্রীর বর্ণাঢ্য সাহিত্যিক জীবনে তিনি কিছু গুণগ্রাহী ভক্ত সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তাঁর গ্রেফতারী পরোয়ানা জারীতে তাদের কেউ কেউ একটি অনলাইন পেজ ওপেন করে, 'রবিশঙ্করকে দেশে চাই, গণশত্রুর মুখে ছাই' শিরোনামে একটি মোটিভেশন সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন তারা। ৩রা মে, শাহবাগে একটি মানব বন্ধনের মাধ্যমে রবিশঙ্কর মৈত্রীর উপর জারী করা গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহারের পাশাপাশি সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে তাঁকে দেশে ফেরার সুযোগ করে দেবার দাবী উঠানোর কথা ছিলো। কিন্তু ক্ষমতার কালো থাবাতে হারিয়ে গেছে সেই আয়োজন। আয়োজকদের কাউকে কাউকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে, কেউ কেউ মামলায় পড়ার হুমকি পেয়েছেন। জলের মতো পরিষ্কার হয়েছে রবিশঙ্কর মৈত্রীকে যারা দেশ ছাড়া করেছে, যারা তাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছে তারা কত শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান।

রবিদাকে এক সময় পরামর্শ দিয়েছিলাম দেশে ফিরতে হলে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করুন, আমাদের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল তো উনিই। আজ আর সে রকম বলতেও সাহস হয় না। আমি আজ আর বিশ্বাস করতে চাই না প্রধানমন্ত্রী এসবের কিছুই জানেন না। আসলে আজ খুবই দুঃখাক্রান্ত মন নিয়ে লিখতে বসে রবিদাকে কিছু বলার মতো ভাষা আমার নেই। শুধু এইটুকু বলতে পারি রবিদার মতো একজন আগাগোড়া ভালো মানুষ, সাহিত্যের মানুষ, স্বাধীনতার পক্ষের একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠ, আজন্ম নৌকা মার্কার ভোটার অসহায় এই মানুষটি যে প্রধানমন্ত্রীর কিছু কাছের মানুষের দৌরাত্ম্যে দেশ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীকে সেই কথাটি জানানোর কি সত্যি কেউ নেই?

রবিশঙ্কর মৈত্রীর স্ত্রী অসুস্থ, তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছেন। নিশ্চিতভাবে ফ্রান্সের চেয়ে ভালো চিকিৎসা বাংলাদেশে হবার কথা নয়, মেয়ে ফরাসী ভাষা শিখে ভালই স্কুল করছে এখানে, তার পড়াশুনায় ব্যত্যয় ঘটবে, নিজে দেশে গেলেই জেলে যাবেন, মারা পড়তে পারেন আততায়ীর হাতে। তবু মানুষটি দেশে ফিরতে চান। কারো প্রতি কোন প্রতিহিংসা নেই, সহজভাবে সহজ মানুষটি তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বদেশে গিয়েই মরতে চান, মরার আগে তাঁর জীবনকে আস্তাঁকুড়ে নিক্ষেপকারী মানুষগুলোকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে চান সুন্দর ও সত্যের পথে।

আমি প্রার্থনা করি একজন কেউ এমন মানুষ উদ্যোগী হোক যে প্রধানমন্ত্রীকে আসল সত্যগুলো জানিয়ে সকল অনিশ্চয়তা দূর করে রবিশঙ্কর মৈত্রীকে দেশে ফিরিয়ে নিতে পারে। ভাল থাকুন রবিদা, ভালো থাকুক বাংলাদেশ।

কয়েছ আহমদ বকুল : ফ্রান্স প্রবাসী কবি, লেখক।
এ বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

আলোচিত