আজমিনা আফরিন তোড়া

২৪ মে, ২০১৬ ০০:২৯

পড়া চোর

বয়স তখন কত হবে, বড় জোর ৪ কিংবা ৫! মলাট করা নতুন বই হাতে সারা বাড়ি ঘুরে বেরাতাম কিন্তু বইয়ের লেখাগুলো পড়তে পারতাম না। খুব কষ্ট হত পড়তে। ‘পড়তে’ বলতে তখন তো মাত্র শিখছি। স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ আর অ্যালফাবেট শেখার পরই পড়লাম আসল বিপত্তিতে। এবার বানান শেখো রে,তারপর ছড়া পড়ো রে। শুধু পড়েই নিস্তার নেই, করতে হবে মুখস্ত, ঠোঁটস্ত। পড়া রাখতে হবে ঠোঁটের গোড়ায়। যেন বাড়িতে কোন নতুন অতিথি বেরাতে এলেই হাত- পা নেড়ে দুটো ছড়া শুনিয়ে দিয়ে বাহ্ বা কুড়াতে পারি! এসবে আমার কোন কালেই মন ছিল না। মন না থাকলে কি হবে? পড়তেই হবে। মধ্যবিত্ত পরিবারের গাড়ি-ঘোড়া চড়ার স্বপ্ন বলে কথা!

কোন কালেই খুব একটা ডানপিটে ছিলাম না। কিন্তু জোর করে ঘাড়ে কেউ কিছু চাপিয়ে দিলেই সেরেছে! কোন দিনই সেই দূরভিসন্ধি ব্যক্তির উদ্দেশ্য হাছিল হয় নি। তবুও কিভাবে কিভাবে জানি আমার বড় বোন একদিন আমাকে পড়তে শিখিয়ে ফেললেন। কত যে কান্নাকাটি করেছি! কেন মুখস্ত করতে হবে, শুধু এই ভয়ে। আমি পড়তে বসলেই বাড়িতে রাজ্যের হাহাকার বিরাজ করত আর খানিক্ষণ পর পর চিৎকারের আওয়াজ শোনা যেত। ও কিছু না, ওই পিঠের ওপর দুই একটা তাল পড়ত আর কি! একবার তো বড় বোন রাগ সা্মলাতে না পেড়ে কপালে লিখেই দিল “পড়া চোর”। তারপর সারা পাড়া না ঘোরালেও ওই লেখা নিয়ে পুরো বাড়ি চক্কর দিতে হয়েছিল আমাকে। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে কেবল হাসি পায়।

মা ভয় দেখাতো, পড়ালেখা না করলে মানুষের বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে পাঠিয়ে দেবে। সেই ভয়েই কি না জানি না, ঠেলেঠুলে কোন মতে পড়াশোনা টা শিখেই ফেললাম।  ভাগ্যিস সেদিন পড়তে শিখেছিলাম! নইলে আজ আমার এই তথাকথিত শিক্ষিত আর হওয়া হত না!

ছোট থাকতে মা শান্তনা দিত, “এখন একটু কষ্ট করে মুখস্ত কর, বড় হলে যখন বুঝতে শিখবে তখন আর কেউ তোমাকে মুখস্ত করতে বলবে  না” ! সুনীল বাবুর মত এখন আমারও বলতে ইচ্ছে করে, “মা,আমি আর কত বড় হব?”

স্কুল পাস দিয়ে বোর্ড পরীক্ষায় বসলাম। খুব বড় হয়ে গেছি একটা ভাব নিয়ে এস এস সি পরীক্ষা দিলাম। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী আমি গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেলাম। আগেই বলে রাখা ভালো,আমাদের ব্যাচই প্রথম বারের মত সৃজনশীল পরীক্ষা ব্যবস্থার গিনিপিগ। এখনো খুব স্পষ্ট মনে পড়ে,প্রতি বিষয়ের জন্য খুব  বেশী হলে ৫০০ এর মত বহু নির্বাচনী প্রশ্ন পড়তাম। তাতেই গোল্ডেন এ প্লাস। বুঝতেই পারছেন, পড়া চোরের গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া বলে কথা!

সেই আনন্দে গায়ে বাতাস লাগিয়ে বেড়ালাম ২ বছর। আমার কলেজে মোটে পরীক্ষা হয় ৪ বার। প্রথম পর্ব, ইয়ার চেঞ্জ, প্রাক নির্বাচনী আর নির্বাচনী।  দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী আমি ইয়ার চেঞ্জ আর নির্বাচনী পরীক্ষায় গড়ে মাত্র ৪০% নম্বর নিয়ে পাস করলাম। বাকি ২ পরীক্ষায় গায়ে বাতাস লাগানোর ফল স্বরূপ যথারীতি ডাব্বা মারলাম।

বাড়ির সবাই যখন আমাকে নিয়ে হতাশ তখন আমিও গণিত,রসায়ন আর পদার্থ বিদ্যার সাত খন্ড পড়ে সীতা রামের কে তা উদ্ধার করতে পারছি না। পরীক্ষার ২০ দিন আগে যখন মনে মনে সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেললাম রসায়ন বাদে বাকি পরীক্ষাগুলো এ বছর দেব। সামনের ১ বছর রসায়ন মুখস্ত করার মত যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে!

সেই সময় আমার জীবনে দেবদূতের আগমন। সাইফুল স্যার। সত্যি বলছি স্যার।আপনি না থাকলে পরীক্ষাটা পরের বছরই দিতাম। এক হলফ মিথ্যা বলছি না। স্যার যে সাজেশন দিলেন আমার কাছে মনে হল উনি কোন উপায়ে পরীক্ষার প্রশ্ন পত্র ফাঁস করে ফেলেছেন। রসায়ন ১ম পত্রে ৫০ টা আর ২য় পত্রে ৪০ টা প্রশ্ন। সত্যিই অবিশ্বাস্য। প্রশ্নপত্র ফাঁস নয়,স্যার প্রতি বছরই এমন সংক্ষিপ্ত সাজেশন তৈরী করেন।
 
যেহেতু রসায়ন আর গণিত নিয়েই বেশী ভয় ছিল তাই সরাসরি এই দুই পরীক্ষার অভিজ্ঞতাতেই চলে যাচ্ছি। রসায়নের প্রশ্ন হাতে পেয়ে মনে হল প্রশ্ন রেখে আগে স্যার এর পা ছুঁয়ে আসি, লেখার জন্য তো অনেক সময় পাওয়া যাবে! আর গণিতের দিনে? পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আমার উত্তর করা একটা অঙ্কের সমাধানো আমি করতে পারিনি। আজ বুঝি, সেদিন অঙ্ক মুখস্ত করেছিলাম। সেদিনও মুখস্ত করা আমার পেছন ছাড়েনি।  এবারও সাফল্য আমার হাত ছাড়েনি। এবারও জিপিএ ৫ তবে শুধু পদার্থ বাদে। ফলাফলে উল্লাস করব কি, অবাক আমি হিসেব মেলাতে পারি না রসায়ন আর গণিতে কিভাবে এ প্লাস পেলাম!

আজ অনেক ছাত্র ছাত্রীকে দেখি রেজান্টের পর এ প্লাস না পাওয়ায় খাতা পুনঃবিবেচনার জন্য আবেদন করে। আমার ও খুব ইচ্ছে করে খাতা পুনঃবিবেচনা করে দেখতে। না, পদার্থ বিদ্যায় এ প্লাস পাবার আশায় না। বাকি বিষয়গুলোতে কিভাবে এ প্লাস পেলাম তা জানার জন্য।

সাইফুল স্যারের দোষ দেখি না আমি এখানে। বছর ঘুরলে একই প্রশ্ন যারা রিপিট করে, এ দায় তাদের। স্যার রা দেখেই বলে দিতে পারেন কোন বছর কোন প্রশ্ন আসবে।
জানি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। পাশের হার বাড়াতে হবে। গ্রামের ছেলে মেয়েদের পাস করাতে হবে। তাদের দায়বদ্ধতা মেনে নিয়ে পা রাখলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। মার খুব ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হই। ওরে বাবা, পাগল নাকি?আবার সেই মুখস্ত করার পথ মারাব! ভূতে পেয়েছে?

অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে ক্যম্পাসে আশা।  আমি বড় হয়েছি, মার কথা মত আমাকে আর কারো মুখস্ত করবার কথা বলবার কথা নয়। এখানে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সীমাবদ্ধতা নেই,চলে স্বায়ত্ত শাসন। স্যারেরা ক্লাসে পড়াবেন, আমরা লাইব্রেরিতে সবাই একসাথে পড়ব। পরীক্ষায় বই থেকে হুবহু লেখা যায় এমন কোন প্রশ্ন আসবে না ।গবেষণা হবে, পরীক্ষাগারে দিনের আধাবেলা কাটবে। আর বিকেল টা না হয় বন্ধু বান্ধবের জন্য বরাদ্দ থাক!

হায় রে আমার অধরা স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আমাকে শিখিয়ে দিল জীবনে মুখস্ত করার বিকল্প নেই। ছোটবেলায় মা ভুল বলেছেন, মিথ্যে বলেছেন।

সরকার অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছে গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনের। তার প্রথম দিককার পদক্ষেপ গুলোর মধ্যে ছিল গাইড বইগুলো বাজার থেকে তুলে দেওয়া, স্কুল শিক্ষকদের বাড়িতে বা কোচিং এ পড়ানোতে নিষেধ জারি ইত্যাদি। অথচ এখনো ছুটির দিনে নিজের হাইস্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখি কোমলমতি শিশুদের ভিড়। জিজ্ঞেস করতেই উত্তর মেলে, স্যার এর কাছে পড়তে এসেছে।স্যারদের বাড়িতে পড়ানো নিষেধ কি না, তাই ওনারা স্কুলেই ব্যাচ করে পড়ান।

নিজের জন্য আফসোস নেই। আমি তো সেই ছোট বেলা থেকেই পড়া চোর। আফসোস শুধু তন্ময়ের মত ছেলেদের জন্য। যারা যারা ভুল সময়ে ভুল দেশে প্রচুর মেধা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে। যার কাছে টেলিস্কোপ বানানোর পথে প্রথম অন্তরায় মেধা নয়,অর্থ। যার কিনা  শাবিপ্রবির মত প্রথম সারির একটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও গবেষণার অর্থ না পেয়ে কেবল গণিতের সূত্র মুখস্ত করেই হতাশায় দিন কাটে! মার কথা টা এখনো কানে খুব বাজে, “এখন একটু কষ্ট করে মুখস্ত কর, বড় হলে যখন বুঝতে শিখবে তখন আর কেউ তোমাকে মুখস্ত করতে বলবে  না”…

আপনার মন্তব্য

আলোচিত