পিযুষ চক্রবর্তী

০৫ জুন, ২০১৬ ০০:২৪

বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা

পরিবেশ বাংলা শব্দ ইংরেজি প্রতিশব্দ Environment. Environment. শব্দটি ফরাসি Environner  থেকে উৎপত্তি। Environner  অর্থ বেষ্টন করা বা ঘেরা। অর্থাৎ আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তাই নিয়ে পরিবেশ। একটি জীবের পরিবেষ্টক এবং প্রভাব বিস্তারকারী জীবী উপাদানের মোট সমষ্টিকে এই জীবের পরিবেশ বলে।

কোন জীবের চারপাশে অবস্থানকারী জীবিত ও জড় উপাদানগুলো এবং এগুলোর মিলিত সবরকমের প্রভাব ও ঘটনা প্রবাহের সামগ্রিক অবস্থাকে পরিবেশ বলা হয়। ভূগোলবিদগণ মূলত মানুষের পরিবেশ বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়েই অনুশীলন করেন। সময় ও স্থানের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবেশও পরিবর্তিত হয়। ভূমি বায়ু পানি ও প্রাণী এগুলো নিয়েই ছিল মানুষের পরিবেশ। কিন্তু বর্তমান সময়ে এগুলোর সাথে সাথে মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কার্যাবলি যুক্ত হয়ে নতুন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

K.RDIKSHIT  (১৯৮৪) এর ভাষায় মানুষ যেখানে বসবাস করেন, তার গুণাগুণ তার শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য বায়ু, খাদ্য পানি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সম্পদ প্রভৃতি সবকিছুই পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত। দুটি উপাদানের সমন্বয়ে পরিবেশ গঠিত- সজীব উপাদান, জড় উপাদান এবং শক্তি উপাদান। পরিবেশ অবক্ষয় ও ব্যাপক দূষণের ফলে বিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। মানবজীবন, প্রাণিজগৎ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের জুনে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশের ওপর ১ম জাতিসংঘের সম্মেলনে এ অবস্থার ওপর আলোচনার সূত্রপাত ঘটে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৭তম অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হবে। এই অনুভূতির ভিত্তিতেই গঠিত হয় UNITED NATIONS ENVIRONMENT PROGRAMME বা জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি। আজ একই চেতনায় বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে পৃথিবীর সর্বত্র।

১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে এই দিবস ঘোষণার পর দুই দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু দুই দশকে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থায়ীভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ এবং গণসচেতনতা অগ্রগতি খুবই ধীর। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণে চলমান আছে বিভিন্ন কার্যক্রম। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলনে গৃহীত এজেন্ডা ২১ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাস্তবায়নাধীন আছে জাতীয় বিশ্ব পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম (নমাপ)। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর আওতায় নিয়মিতভাবে পানি মাটি বায়ু দূষণের মনিটরিংয়ের কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

বাংলাদেশে ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রণীত হয় পরিবেশ নীতি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন কার্যকর হয় ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে জারিকৃত বিধিমালার অধীনে দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণ ও সেসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নতুন শিল্পকারখানার ক্ষেত্রে পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণে ‘ছাড়পত্র’ গ্রহণ প্রথা একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। শুধু শিল্পক্ষেত্রেই নয় সরকারি ও বেসরকারি যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেই ‘ছাড়পত্র’ গ্রহণ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর ৪ (চার) টি শিল্প সেক্টরের জন্য পরিবেশ ব্যবস্থাপনা নির্দেশিকা প্রণয়ন করেছে। অত্যধিক জনসংখ্যা সম্পদের সীমাবদ্ধতা, অভিজ্ঞতা, নদ-নদীর পানি দূষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, এসব সমস্যার মুখোমুখি বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণে প্রয়োজন সকল মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টা। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই করতে হলে প্রয়োজন পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখা। সাধারণত পরিবেশ প্রাকৃতিক ও সামাজিক উপায়ে পরিলক্ষিত। আর মানুষের উচিত এই দুই উপায়ের পরিবেশ সম্পর্কে নিজেকে সচেতন রাখা এবং সুস্থ ধারার পরিবেশ বজায় রাখা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিশ্বমণ্ডলের কিছু কিছু শিল্পোন্নত দেশ যেমন আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, জার্মান, চীন, ভারত এবং ইংল্যান্ড সহ দেশগুলো পরিবেশের উপর ব্যাপক ক্ষতিসাধন ঘটাচ্ছে নিজেদের শিল্পে বাজারজাতকরণ ও অধিক মুনাফার প্রত্যাশায়। এতে শুধু তাদের দেশগুলোর পরিবেশের উপরই ক্ষতির চাপ পড়ছেনা, গোটা বিশ্ব পরিবেশ ব্যবস্থাতেই ক্ষতির সঞ্চার ঘটাচ্ছে।

রাসায়নিক ও আণবিক বোমা ফাটানো হচ্ছে মানুষ মানুষকে হত্যার জন্য এতে কি শুধু মানুষেরই ক্ষতি হচ্ছে? না এ ক্ষতি মাটি পানি বায়ু সহ গোটা জীব বৈচিত্র্যের জন্য তথা বিশ্ব পরিবেশের ক্ষতি করছে। এছাড়া আমাদের বাংলাদেশের শিল্প ব্যবস্থাতে ও রয়েছে অনিয়ম এবং পরিবেশ ঘাত মূলক পরিস্থিতি। যেমন রাজধানী ঢাকা নগরীর বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক বর্জ্য ক্ষতিকর পদার্থ প্রতিনিয়ত নিক্ষেপ হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীর উপর। এতে বায়ু দূষণ, পানি দূষণ সহ নদীর মৎস্য সম্পদের উপর নেমে এসেছে বিপর্যয়।

দেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে যেমন- সিলেট, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন ও অন্যান্য পাহাড়ি এলাকায় প্রতিনিয়ত পাহাড়, টিলা কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সারাদেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরাজি নিধন করা হচ্ছে এমনকি প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে ও প্রতিনিয়ত বৃক্ষ কেটে উজাড় করা সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বহনকারী বন্য জীবজন্তু নিধন করা হচ্ছে অবাধে। এতে জাতীয় পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিনিয়ত ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে। যেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে অসময়ে শিলা-বৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিঝড়, আচমকা বজ্রপাত ও বন্যা সহ নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেয় এবং ধন সম্পদ ও প্রাণহানি সহ সারাদেশে নানাবিধ ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয় দেশবাসীকে।

এছাড়া যত্রতত্র অনিয়মে চলছে ইট ভাটা, কয়লা পুড়ানো যান্ত্রিক কালো ধুয়া সহ অবাধে খাল ও ছড়া ভরাট করে পানি নিষ্কাশনে ব্যাঘাত ঘটিয়ে নানা বিধ সমস্যা সৃষ্টি করা হচ্ছে এতে জন জীবন পদে পদে বিপর্যস্ত হচ্ছে। এই পৃথিবীর বুকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ মান ও হুশ নিয়ে প্রতিনিয়ত চলার কথা এবং নিজহিত ও পরোপকারী এমনকি স্রষ্টা ভীতি সহ ইহকাল ও পরকাল সম্পর্কে সচেতনতা রাখা প্রয়োজন। স্রষ্টার অসীম ক্ষমতা প্রবাহিত হচ্ছে জীবের বংশ গতির মধ্য দিয়ে। সে সম্পর্কে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা না ভেবে শিল্পোন্নত কিছু দেশ সহ আমাদের বাংলাদেশেও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্বার্থান্বেষী মহল আবহাওয়া-জলবায়ু সহ পরিবেশের নানাবিধ বিপর্যয় ডেকে আনছে। এতে শুধু তাদের নয় গোটা বিশ্ব জীব বৈচিত্র্যের জন্য আবাসস্থল পৃথিবীকে অনাবাসের দিকে ঢেলে দিচ্ছে।

এভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশ সহ সামাজিক পরিবেশ অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে চলতে থাকলে জীবের বসবাস বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে অনুপযোগী হয়ে উঠবে। তাই এখন থেকেই বিশ্ব মানব সমাজকে পরিবেশ সম্পর্কে বুঝতে হবে এবং সচেতন হতে হবে। এই জীব বৈচিত্রময় বিশ্ব বা মেদিনী আপনার, আমার, এমনকি সকল জীবের বসবাসের একমাত্র আবাস স্থল এর ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের সবার রক্ষা।

আবহাওয়া ও জলবায়ু বিকৃত হলে গোটা বিশ্ব ব্যবস্থায় সময়ে-অসময়ে নেমে আসবে সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, আচমকা বজ্রপাত, খরা, অকাল বন্যা, শিলা-বৃষ্টি আরো অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিবে যা জীবের বসবাসের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। অশনি সংকেত লক্ষ্য করা যায় হিমালয়ে বরফগলা এবং বাতাসে শীশা ও কার্বনডাইঅক্সাইড এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। আর এ লক্ষ্যেই একটি প্রতিপাদ্য বিষয়ের আলোকে জনসচেতনতার আহ্বান জানায় বিশ্ব পরিবেশ দিবস।   

লেখক: কলাম লেখক, প্রাক্তন শিক্ষক

আপনার মন্তব্য

আলোচিত